সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন অথচ ইমোজি বা Emoticons ব্যবহার করেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। ইমোজি হলো বেশি লেখালেখি না করে মনের ভাব প্রকাশ করার সহজ উপায়। অনেকের মতে ইমোজি মানুষের সৃজনশীলতাকে ধ্বংস করছে (মানে ইমোজি ব্যবহারের ফলে লিখে লিখে মনে ভাব প্রকাশ না করায় সৃজনশীলতা হারাচ্ছে)। তবে বলা চলে এর ইতিবাচক প্রভাব-ই বেশি। এটা আমাদের মূল্যবান সময়কে বাঁচায়। তবে আমরা আজকের যেমন ইমোজি ব্যবহার করি, শুরুর দিকে কিন্তু ইমোজি গুলো এমন ছিল না। বলা চলে, আজকের ইমোজি গুলো এসেছে একটা দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে।
১৮৮১ সালে অর্থাৎ আমাদের পরিচিত ইমোজির জন্মের প্রায় ১০০ বছর পূর্বে অ্যামেরিকান হিউমার ম্যাগাজিনে ইমোজির প্রাচীন পূর্বপুরুষ ইমোটিকন (Emoticon) প্রকাশিত হয়। যেগুলো বিভিন্ন বিরাম চিহ্ন এবং টাইপোগ্রাফিক ক্যারেক্টার দিয়ে তৈরি করা হতো এবং আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট ইত্যাদি অর্থ বহন করত। তবে এগুলোকে প্রথমে ‘টাইপোগ্রাফিক আর্ট‘ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বহু দশক পরে, ১৯৯০ সালের দিকে এটি চ্যাট রুম গুলো তে যোগাযোগের অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে ইমোটিকন নামে পুনরূত্থান ঘটায়।
তবে আধুনিক ইমোজির জন্ম সম্পর্কে ভিন্নমত আছে (মানে জন্মসাল সম্পর্কে)। কারো মতে সর্বপ্রথম আধুনিক ইমোজি তৈরি করে ১৯৯৭ সালে সফটব্যাংক মোবাইল কোম্পানি। তবে সবচেয়ে সুপ্রসিদ্ধ ইমোজির সেট তৈরি করেন জাপানের সিগেতাকা কুরিতা (Shigetaka Kurita), বিখ্যাত মোবাইল কোম্পানি ডোকোমোর (DoCoMo) জন্য।
কুরিতা ১৯৯৯ সালে ডোকোমোর মোবাইল প্লাটফর্ম ‘i-mode‘ এর জন্য ১৭৬ ক্যারেক্টারের একটা ইমোজি (Emoticons) এর সেট তৈরি করেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল, ব্যবহারকারীরা যাতে করে সংক্ষিপ্ত উপায়ে একটা বিশেষ ক্যারেক্টারের সেটের মাধ্যমে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। এই বিস্তৃত পরিসরের ইমোজি গুলো ডিজিটাল মাধ্যমে কথোপকথনকারিদেরকে সহজে আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের সুযোগ দেয়। কয়েক দশক ধরে, ইমোজি গুলো জাপানে জনপ্রিয় হতে থাকে।
আর এই ইমোজির জনপ্রিয়তা দেখে ডোকোমোর প্রতিযোগি যে কোম্পানি গুলো ছিল তারাও তাদের পণ্য গুলোতে ইমোজি ব্যবহার শুরু করে। তারপরে ইমোজি গুলো যুক্তরাষ্ট্রেও ছড়িয়ে পড়ে, যখন ২০১১ সালে অ্যাপল কোম্পানি তাদের আইওএস-এ একটি অফিসিয়াল ইমোজি কীবোর্ড যুক্ত করে এবং কয়েক বছর পরে অ্যান্ড্রয়েড তাদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে। আজকের দিনে, ইমোজি গুলো এতটাই মর্যাদাপূর্ণ যে মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট (এমওএমএ) কুরিতার আসল ইমোজি সেটটি সংরক্ষণ করে রেখেছে।
প্রতি বছর, ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম (একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান যা কম্পিউটারে বিশ্বব্যাপী টেক্সট স্ট্যান্ডার্ড বজায় রাখতে কাজ করে) তাদের অনুমোদিত তালিকায় কয়েকশত নতুন ইমোজি যুক্ত করে। ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের একটি ইমোজি বা Emoticons-এর উপকমিটি রয়েছে যেটা ইমোজি সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়ে ঐক্যমত্যে আসতে সাপ্তাহিক দু’বার একত্রিত হয়।
যায-ই হোক, ২০১৪ তে, ইমোজি ব্যবহারকারীরা খেয়াল করেন, যে ইমোজি গুলো কোনো পেশা কে (যেমন: পুলিশ, গোয়েন্দা, স্কুল টিচার, শ্রমিক) উপস্থাপন করে সবাই-ই সাদা পুরুষ মানুষ। যদিও ইমোজি স্বাভাবিক ভাব প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিলো, কিন্তু এটি ছিলো এমন একটি মাধ্যম যেখানে মহিলা বা ভিন্ন বর্ণের ব্যক্তিদের ভাব প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ততা ছিলো না। আর এটা যখন ইউনিকোডের কান পর্যন্ত পৌঁছায় তখন তারা ইমোজি গুলো তে ত্বকের রং পরিবর্তনের সুযোগ দেয় এবং বিভিন্ন মহিলা পেশাজীবীদেরকেও সংযুক্ত করে।
পৃথিবীর নানা সংস্কৃতি এখন অসংখ্য ইমোজিতে চিত্রিত হয়েছে। ইমোজির ব্যবহার দিয়ে এখন অনেক সময় মানুষের ব্যক্তিত্বও বোঝার চেষ্টা করা হয়। আর তাই, বলা যায় ইমোজি গুলো এখন আন্তর্জাতিক ভাষাতে পরিণত হয়েছে, যেটা আমরা সবাই সহজেই বুঝতে পারি।