নিউটনের চিরায়ত বলবিদ্যা দিয়ে আমাদের চারপাশের সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হলেও পরমাণুর জগতে নিউটনীয় বলবিদ্যা অচল। পরমাণুর জগতে সিংহাসনে রাজ করে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা।
কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বুঝতে হলে, আমাদের কল্পনা করতে হবে এমন এক জগতের, যেখানকার অণু-পরমাণুগুলো ভেঙে দেয় প্রচলিত বিজ্ঞানের সকল নিয়মনীতি আর গড়ে তুলে এক ভিন্ন জগত, রহস্যময়ী পরমাণুর জগত।
আলো তুমি কে কণা না তরঙ্গঃ
আলো কণা ও তরঙ্গ উভয় আচরণ করতে পারে। তবে এটি প্রমানিত হতে বেশ সময়ই লেগেছিল। আলোর কণার এই ডুয়েলিটি প্রমাণের ইতিহাস একটু জেনে নেওয়া যাক। এই ইতিহাস সর্ম্পকে জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে নিউটনের সময়কালে। নিউটন ভেবেছিলেন, আলো একটি ভরহীন কণা। তবে সেইসময় বিজ্ঞানী হাইগেনস বলেন, আলো কণা নয় বরং এটি তরঙ্গ। কিন্তু হাইগেনসের ধারণাটি কালের গর্ভে হারিয়ে যায়, ঠিকই টিকে ছিল নিউটনের আলোর কণা তত্ত্ব।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিজ্ঞানী থমাস ইয়ং তাঁর ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট বা দুই চিড় পরীক্ষা নিয়ে হাজির হন। তার পরীক্ষায় তিনি দুই চিড় দিয়ে একই তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট আলো প্রবেশ করানোর পর অপরপাশে ব্যাতিচার প্যার্টানের সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ আলো দুই চিড় দিয়ে যাওয়ার সময় বিস্তার ঘটে এবং অনেকগুলো উজ্জল অনুজ্জ্বল রেখার সৃষ্টি করে, একে বলা হয় তরঙ্গের বিচ্ছুরন। যদি আলো কণা হতো তাহলে দুই ছিদ্র দিয়ে যাওয়ার সময় সোজাসুজি পথে দুটি দাগের সৃষ্টি করত। কিন্তু তা হয়নি, সৃষ্টি হয়েছে ব্যাতিচার প্যার্টানের।
এই পরীক্ষাটি থেকে ইয়ং প্রমাণ করেন, আলো হচ্ছে তরঙ্গ। ফলে নিউটনের আলো কণাতত্ত্ব বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু এখানেই শেষ না, বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন আলোক তড়িৎক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করার সময় দেখলেন–
ধাতব পাতে আলো পড়ার পর ধাতু থেকে একটি ইলেকট্রনের বিচ্ছুরণ ঘটে। আলো যদি কণা হয় তবেই এর পক্ষে সম্ভব হবে ইলেকট্রনের মতো কণাকে স্থানচ্যুত করা।
এর আগে ম্যাক্স প্ল্যাংক বলেছিলেন,
আলো নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে বিকিরিত হয়না। বরং এটি শক্তির প্যাকেট আকারে খুব দ্রুত বিকিরিত হয়, তাই আমাদের কাছে এটি নিরবিচ্ছিন্ন মনে হয়। কোনো শক্তির প্যাকেট একটি নির্দিষ্ট মানের শক্তির চেয়ে কমশক্তির বিকিরণ করতে পারে না।
ম্যাক্স প্ল্যাংক এর তত্ত্ব থেকে আইনস্টাইন শক্তির এই প্যাকেটের নাম দিলেন ফোটন। অর্থাৎ নির্দিষ্ট শক্তির ফোটন ধাতব পাতে আঘাত করার ফলে ইলেকট্রন ধাতব পাত ছেড়ে বেড়িয়ে যায়। পরে মার্কিন বিজ্ঞানী এ্যান্ড্রজ মিলিকন আলোর এই তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণ করে।
তবে কী আলোর তরঙ্গতত্ত্ব বাতিল হয়ে যায়? না, বরঞ্চ আলোর কণা ও তরঙ্গ উভয় তত্ত্বই প্রমাণিত হয়। প্রমাণিত হয় ফোটনের ডুয়োলিটি।
অচল নিউটন তত্ত্বঃ
আমি আগেই বলেছি কোয়ান্টামের জগতে নিউটনের তত্ত্ব অচল। নিউটনের তত্ত্বের সাথে সম্পৃক্ত বাস্তবিকতার। ধরুন, আপনি একটি নির্জন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, এমন সময় একটি দ্রুতগামী কার ও ট্রাক পরস্পর বিপরীতমুখী হয়ে এগোচ্ছে। হঠাৎই সংঘর্ষ। আপনি পুরো ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করলেন। আপনি নিউটনের গতিবিদ্যার সূত্র অর্থাৎ ট্রাক ও কারের বেগ, ভর ইত্যাদি হিসাব করেই আগে থেকে বলে দিতে পারবেন কোন সময়ে, কত দূরত্বে ট্রাক ও কারটির সংঘর্ষ ঘটবে। এটা তো পদার্থবিজ্ঞানের চিরায়ত রূপ।
কিন্তু ওইসময় কেউ যদি এসে আপনাকে বলে আপনি এসেছেন বলেই ট্রাক ও কারের সংঘর্ষ ঘটেছে। তখন হয়তো রেগেমেগে আপনি তাকে একটি কষে চড় দিলেন। প্রথমত আপনার সামনে এমন একটি ধ্বংসাত্মক দৃশ্য ঘটে গেল, যদি এখানে কোনো হেরফের হতো আপনারও ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল, সেখানে কিনা এই লোকটা এসে বলছে আপনার কারণেই সংঘর্ষ ঘটেছে। আপনার রাগের যথেষ্ট কারণ আছে। তবে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে, আপনি এসেছেন বলেই এই সংঘর্ষ ঘটেছে। যাক বাবা, ঘুরে ফিরে আপনার ঘাড়ের ওপর এসেই দোষটি পড়ল!!
এই ব্লগ পড়তে ভুলবেন না ! |
কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মতে, পরমাণুগুলো সেভাবে নিজেদের উপস্থাপন করে যেভাবে পর্যবেক্ষক তাদের দেখতে চায়। অর্থাৎ, আপনি কোনো বস্তুর দিকে না তাকানো পর্যন্ত বস্তুটির অস্তিত্ব থাকে না। বিষয়টা আমাদের কাণ্ডজ্ঞানকে প্রতিনিয়ত প্রশ্নবিদ্ধ করলেও, এটিই চিরন্তন সত্য। আপনি যেমন বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না ঠিক তেমন ভাবেই মেনে নিতে পারেননি বিজ্ঞানী আইনস্টাইন। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার গোলকধাঁধায় বিব্রত আইনস্টাইন প্রশ্ন করেছিলেন–
“আমরা যখন আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি না ,তখন আকাশে কি চাঁদটাও থাকে না??”