মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে যাকারিয়া আল রাযি, যিনি মূলত আল রাযি হিসেবেই অধিক পরিচিত। তার ল্যাটিনাইজড নাম হচ্ছে র্যাজেস (Rhazes)। তিনি তৎকালীন পারস্যের (বর্তমান ইরান) রেই বা রাই অঞ্চলে ৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মস্থান রেই বা রাই (Ray) অনুসারে তার নামে রাযি শব্দটি যুক্ত হয়। তিনি একাধারে চিকিৎসক, দার্শনিক এবং আলকেমিস্ট ছিলেন। তবে একজন চিকিৎসাবিজ্ঞানী হিসেবেই তিনি সবচাইতে বেশি পরিচিত।
প্রাথমিক জীবনঃ
জীবনের প্রাথমিক সময়ে তিনি সঙ্গীতে খুব আগ্রহী থাকলেও পরবর্তীতে রসায়ন এবং দর্শনচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। তবে তার এই রসায়নচর্চাও বেশিদিন চালাতে পারেননি। রাসায়নিক পদার্থের প্রভাবে চোখে জ্বালাপোড়া হওয়ায় তিনি রসায়নচর্চা বাদ দেন। তবে এর মধ্যেই তিনি ইথানল (C2H50H) এবং সালফিউরিক এসিড (H2SO4) আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন!
তৎকালীন সময়ে আলী ইবনে সাহল আল তাবারী নামে একজন বিখ্যাত চিকিৎসক এবং দার্শনিক ছিলেন। যদিও তাবারী শুরুতে ইহুদি ছিলেন, পরবর্তীতে আব্বাসী খিলাফাহর সময়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার একটি বিখ্যাত কাজ হচ্ছে ‘ফিরদাউস আল হিকমা’। এটি মূলত একটি মেডিকেল একসাইক্লোপিডিয়া। তো আল রাযি, তাবারীর কাছে মেডিসিন সম্পর্কিত পড়াশোনা করেন এবং ধারণা করা হয় আল রাযি তার কাছে দর্শনের পাঠও নিতেন।
এছাড়াও আল রাযির আধ্যাত্মিক দর্শনও তাবারী দ্বারা প্রভাবিত বলে ধারণা করা হয়। তবে মেধাবী রাযি খুব শীঘ্রই তার গুরু আল তাবারীকে ছাড়িয়ে যান এবং দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। এরপর তিনি তার জন্মস্থান রেই বা রাই এর হাসপাতালের পরিচালক পদে নিযুক্ত হন। তবে শীঘ্রই তার সুনাম রাজধানী পর্যন্ত পৌছে যায় এবং আব্বাসী খলিফা আল মুকতাফি তাকে বাগদাদের সবচেয়ে বড়ো হাসপাতালের পরিচালকের দায়িত্ব দেন।
খলিফা আল মুকতাফির মূখ্যমন্ত্রী আদুদ আল দাউল্লাহ তাকে একটি নতুন হাসপাতাল নির্মাণ করার জন্য অনুরোধ জানান। তখন আল রাযি অনেকগুলো তাজা মাংসের টুকরা বাগদাদের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেন। কিছুদিন পর পরীক্ষা করে যেখানে সবচেয়ে কম পঁচা মাংসের টুকরা পাওয়া গেছে, সেখানকার পরিবেশ ও বায়ু তুলনামূলক ভালো ঘোষণা দিয়ে তিনি সেখানে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ঠিক করেন।
আনুমানিক ৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা আল মুকতাফি মারা গেলে আল রাযি পুনরায় তার জন্মস্থান রেই বা রাই তে ফেরত আসেন এবং সেখানকার হাসপাতালের দায়িত্ব নেন। তবে তিনি বেশিরভাগ সময় শিক্ষাদানেই ব্যয় করতেন। এখানে একটি কথা খুব প্রচলিত আছে যে তার শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকটা গ্রুপ ছিল। কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে আসলে তিনি প্রথমে একটি গ্রুপকে দায়িত্ব দিতেন, তারা না পারলে পরের গ্রুপ এভাবে চলতে থাকতো। সবাই ব্যর্থ হলে আল রাযি নিজে সেই সমস্যার সমাধান বলে দিতেন।
যাকারিয়া আল রাযি অধিকাংশ সময়েই তার রোগীদেরকে বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতেন।
যাকারিয়া আল রাযির কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ:
- কিতাব আল হাওয়াই (Kitab Al-Hawi): ধারণা করা হয় রাযি মারা যাওয়ার পর তার শিক্ষার্থীরা এই বইটি সম্পদনা করেছিলো। এই বইটি মূলত রাযির চিকিৎসক জীবনের সময়কার ক্লিনিকাল অবজার্ভেশন, কেস স্টাডি, রোমান এবং গ্রিক মেডিসিনে তার জ্ঞান এবং তার চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে লেখা। এই বইটি ফারাজ ইবনে সালিম ১২৭৯ সালে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন এবং ১৪৮৬ সালে ইতালি থেকে এই ল্যাটিন সংস্করণটি প্রকাশিত হয়। এটি ১৫০১ খ্রিষ্টাব্দের আগে ছাপা বইগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ছিল! মধ্যযুগীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক উৎকৃষ্ট নিদর্শন এই কিতাব আল হাওয়াই বইটি।
- কিতাব আল মানসুরি ফি আল তিব (Kitab Al Mansuri Fi al-Tibb): এই বইটি খুব সংক্ষিপ্ত মেডিকেল হ্যান্ডবুক। তিনি রেই বা রাই এর শাসক আল মানসুর ইবনে ইসহাকের জন্য এই বইটি লিখেছিলেন।
- কিতাব মান লা ইয়াহদুরুহ আল তাবিব (Kitab Man la Yahduruhu Al-Tabib): এই বইটি ছোটোখাটো ঘরোয়া চিকিৎসা নিয়ে লিখেছিলেন তিনি। সাধারণ মানুষ কিংবা ভ্রমণকারীরা হাতের কাছে ডাক্তার না পেলে যেন অন্তত নূন্যতম প্রাথমিক চিকিৎসা নিজেরাই নিতে পারে, সেজন্য এই বইটি লেখা।
- কিতাব বুর আল সাহ (Kitab Būr’ al-Sā’ah): এই বইটি ছোটোখাটো ঘরোয়া চিকিৎসা নিয়ে লিখেছিলেন, যেগুলো এক ঘণ্টার মধ্যেই আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। যেমন: মাথাব্যথা, কানে ব্যথা, দাঁতে ব্যথা ইত্যাদি।
- কিতাব আল তিব আর রুহানী (Kitab al-Tibb ar-Ruhani): এই বইটি মূলত আধ্যাত্মিক চিকিৎসা নিয়ে লেখা।
- কিতাব আল যুদারি ওয়া আল হাসবা (Kitab al-Judari wa al-Hasbah): এই বইটি হাম এবং বসন্ত সম্পর্কে লেখা। তিনিই প্রথম হাম এবং বসন্তকে আলাদা রোগ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।
- কিতাব আল মুরশিদ (Kitab al-Murshid): এই বইটি মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত আলোচিত বই। যেখানে শিক্ষার্থীরা বেসিক আলোচনা থেকে উপকৃত হতে পারে।
- আল শাকুল আলা জালিনুস (Al Shakook ala Jalinoos): এই বইটি মূলত গ্রিক চিকিৎসাবিজ্ঞানী গ্যালেনের বিভিন্ন মতবাদকে খণ্ডন করে লেখা। আল রাযি তার চিকিৎসা জীবনে অনেক ঘটনাকে গ্যালেনের অনেক মতবাদের সাথে সাংঘর্ষিক হিসেবে পর্যবেক্ষণ করেন। অর্থাৎ, গ্যালেনের দেওয়া অনেক মতবাদের প্রমাণই তিনি সরাসরি পাননি, বরং এর উল্টোটা পেয়েছিলেন। তাই তিনি গ্যালেনের মতবাদের সমালোচনা করে এই বইটি লেখেন।
নিউরোলজি এবং নিউরোএনাটমিতে আল রাযি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি বলেছিলেন যে স্নায়ুর সংবেদশনীল ফাংশন রয়েছে। এছাড়াও তিনি ৭ টি ক্র্যানিয়াল এবং ৩১ টি স্পাইনাল স্নায়ুর কথাও বর্ণনা করেছিলেন। তিনি ৩১ টি স্পাইনাল স্নায়ুকে ৮টি সারভাইকাল (Cervical), ১২ টি থোরাসিক (Thoracic), ৫ টি লাম্বার (Lumber), ৩ টি করে স্যাক্রাল (Sacral) এবং কক্কিজিয়ালে (Coccygeal) ভাগ করেন।
তাকে এপ্লাইড নিউরোএনাটমির জনক মনে করা হয়।
এছাড়াও তিনি প্রথম মানসিক রোগীদেরকে চিকিৎসা দেওয়া শুরু করেন। তিনি যখন বাগদাদের মূল হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন, তখন সেখানে মানসিক রোগীদের জন্য আলাদা শাখা ছিল। সেখানে খুব যত্ন এবং ভালোবাসার সাথে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা করতেন। সুস্থ্য হওয়া রোগীদেরকে ছেড়ে দেওয়ার সময় কিছু টাকা উপহার দেওয়া হতো, যাতে করে তাদের নতুন জীবনের শুরুটা সুন্দর হয়। আল রাযির পূর্বে আর কারো মানসিক চিকিৎসা করানোর ইতিহাস পাওয়া যায় না।
একটি খুবই প্রসিদ্ধ ঘটনা (সত্যতার নিশ্চয়তা দিতে পারছি না):
জীবনের এক পর্যায়ে (সম্ভবত ৩০ বছর বয়সে) আল রাযির চোখে ছানি পড়ে এবং পরবর্তীতে তিনি গ্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হন। তবে সেই সময়ে আল রাযির তুলনায় কেউই চোখ সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখতেন না। তবে আল রাযি চোখ সম্পর্কে অগাধ পাণ্ডিত্য ধারণ করলেও চোখের চিকিৎসা সম্পর্কে অপটু ছিলেন। তার চোখের রোগের চিকিৎসা করানোর জন্য তিনি বিভিন্ন ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। এবং সবাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “রেটিনার স্তর কয়টি?” কিন্তু কেউই সঠিক উত্তর দিতে পারেননি।
উল্লেখ্য যে, আল রাযি আবিষ্কার করেছিলেন রেটিনার স্তর দশটি। আল রাযির মতে যে চিকিৎসক রেটিনার কয়টি স্তর তা জানে না, সেই ডাক্তারের কাছে তিনি চিকিৎসা নেবেন না! তার এই খামখেয়ালিপনার কারণে একসময় তিনি চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে যান!
আবার কেউ কেউ বলেন, রাসায়নিক গবেষণার সময় তিনি অন্ধ হয়ে যান। আবার কারো মতে, ইবনে ইসহাক তাকে শাস্তি সরূপ অন্ধ করে দিয়েছিলেন।
[তবে তার অন্ধ হওয়ার ঘটনাটা সত্য]
আল রাযির জীবনের শেষ অংশ সম্পর্কে খুব একটা জানা যায় না। তবে অন্ধ হওয়ার পর তার জীবন খুব কষ্টের মধ্যে কেটেছে। এই মহান বিজ্ঞানী ৯২৫ (মতান্তরে ৯৩৫) খ্রিষ্টাব্দে তার নিজ জন্মভূমি রেই বা রাই তে মৃত্যুবরণ করেন।