মানুষ বলতেই আবেগপ্রবণতা বিদ্যমান। আর আবেগের একটি বড় অংশ দুঃখ! মন খারাপ থাকলে আমরা যে কাজটি বেশি করি সেটা হচ্ছে গান শোনা। কিন্তু আশেপাশের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে একটা কমন ব্যাপার হচ্ছে, প্রায় সবাই দুঃখের গান-এর ফ্যান!
মানব ইতিহাস ও সংস্কৃতি জুড়ে শিল্প ও সঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে দুঃখের চিরচেনা গানগুলো। গানগুলো শুনলে যেন দুঃখগুলো রূপ পায়, অবলোকন করা যায় বহু ভাঙ্গা স্বপ্ন। ঠিক যেমন “অনিকেত প্রান্তর” গানের লাইনের মত অনুভূতির গুলোর ব্যবচ্ছেদ আমরা গানের তালে অনুভব করতে পারি।
কিন্তু কখনও ভেবেছেন কেন দুঃখের গান আপনাকে শীতলতা এনে দেয়? কেন মনে হয় এই গানটা আসলে আমাকেই ব্যক্ত করে?
এই ব্যাপারটাকে ব্যাখা করা যায় ট্র্যাজেডি প্যারাডক্স দিয়ে।
তো কি এই ট্র্যাজেডি প্যারাডক্স?!
কিছু সার্ভেতে অনেক মানুষ জানায় যে তারা দুঃখবিলাস করা গান উপভোগ করে, কারণ এটি তাদেরকে আনন্দ দেয়। এটি ট্র্যাজেডি প্যারাডক্সের একটি উদাহরণ। পর্যবেক্ষণ করে জানা যায় যে, যদিও আমরা দুর্দশা আর যন্ত্রনা গুলো সবসময় এড়িয়ে চলতে চাই, কিন্তু যখন আমরা এই দুঃখগুলো শিল্পীর উক্তিতে, গানের আকারে দেখি এবং দুঃখ অনুভব করতে চেষ্টা করি, এটি প্রায়শই একরকম আনন্দদায়ক হয়।
আনন্দদায়ক-ই যদি হয়, তাহলে কোন বিষয়টি আসলে এই গানগুলোকে দুঃখকর বানায় বা কেন মনে হয় আসলে গানটা দুঃখের?
দুঃখের গানের লাইনগুলো স্বাভাবিক ভাবে আমাদের ট্রিগার করলেও এই কষ্টগুলো আসলে তখনই অনুভূত হয়, যখন আমরা আমাদের প্রিয় কোন মানুষ হারিয়ে ফেলি চিরতরে, অথবা অনেকসময় পুরোনো কোনো বাজে অভিজ্ঞতা মনে পড়ে। আমরা যখন বিষন্ন কোনো গান শুনি, তখন এই আবেগের জন্য আমাদের বিভিন্ন শারীরিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায় যেমন – শক্তি হ্রাস ঘটে, অটোনমিক নার্ভাস সিস্টেমে পরিবর্তন হয়।
এছাড়া রক্তচাপ উঠানামা করা, হৃদস্পন্দনের পরিবর্তনশীলতা এবং প্রায়শই চোখের পানি বের হওয়ার মত প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যা বুঝায় এই গানগুলো আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে শারীরিক সক্রিয়তায় প্রভাব ফেলে। এফএমআরআই গবেষণায় দেখা যায় যে, বিষাদময় আবেগ মস্তিষ্কের লিম্বিক নেটওয়ার্কের কিছু অংশের, যেমন ইনসুলার কর্টেক্স, হিপ্পোক্যাম্পাস, অ্যামিগডালা সহ আরো কিছু অংশের কার্যকলাপকে বৃদ্ধি করে।
কিভাবে কাজ করে ট্র্যাজেডি প্যারাডক্স?
আধুনিক কিছু তত্ত্বমতে, সাধারণভাবে যে বিষন্নতা আমরা অনুভব করি আর গানের মধ্যে যে বিষন্নতার অনুভূতি পাই, তার মধ্যে পার্থক্য থাকার কারণেই মূলত ট্র্যাজেডি প্যারাডক্সের উদ্ভব। এই গানগুলোর জন্য আমরা আরেকজনের সাথে সংলগ্নতা অনুভব করি, পাশাপাশি প্রায়-ই এটি আমাদের মধ্যে ইতিবাচক অনুভূতির জন্ম দেয় কিছু হরমোন নিঃসরণের মাধ্যেমে।
প্রোল্যাকটিন নামক হরমোন সাধারণত যখন আমরা কাঁদি বা খুব কষ্টে থাকি তখনি নিঃসৃত হয়। তবে, এটি কি শুধু দুঃখের উদ্দীপনাতে কাজ করে?
উত্তর হলো, না!
এই হরমোন আমাদেরকে অন্যের সাথে ভাল সম্পর্ক তৈরি করতে এবং অন্যের কষ্ট অনুভব করতেও উদ্দীপনা দেয়। আমরা যখন স্যাড মিউজিক শুনি তখনও প্রোল্যাকটিন নিঃসৃত হয়, যা এই প্যারাডক্স তৈরির মূল হাতিয়ার। এই নিঃসরণের কারণে আমরা কিছুটা আরাম আর সান্ত্বনা অনুভব করি, যার কারণে মনে হতে পারে যে আমরা আসলে মানসিক যন্ত্রণা অনুভব করছি না। বিষণ্ণতা আসলে সুখকর অনুভূতির চাইতে বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়, আর তখনি এই প্রক্রিয়ায় আমরা গানের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি খুঁজে পাই।
গবেষণায় ট্র্যাজেডি প্যারাডক্সের ব্যাখা:
এফএমআরআই টুলবক্সে একটি নতুন টুল ব্যবহার করে একটি পরীক্ষা চালানো হয় বিভিন্ন ব্যক্তিবৈশিষ্ট্যের কিছু মানুষের উপর। এই নতুন টুলটি সম্পূর্ণ গানের মতো প্রাকৃতিক উদ্দীপনা তৈরি করতে পারে স্নায়ুতন্ত্রে। এই পরীক্ষায় দেখা যায় কীভাবে স্যাড মিউজিক লিম্বিক নেটওয়ার্কের মধ্যে কার্যকলাপকে প্রভাবিত করে এবং ব্যক্তি বিশেষে কিভাবে মানুষ স্যাড মিউজিক উপভোগ করে ও এর তীব্রতা কিরকম। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের এমন কিছু বিষন্নতার গান শুনতে দেয়া হয় যা তাদের আসলে ট্রিগার করতে সক্ষম। তবে সেগুলো ছিল মূলত ইন্সট্রুমেন্টাল সাউন্ড।
অংশগ্রহণকারীরা এফএমআরআই স্ক্যানিংয়ের মধ্য দিয়ে ইন্সট্রুমেন্টাল সাউন্ড গুলো শুনে। স্ক্যানগুলি সম্পন্ন হওয়ার পর, অংশগ্রহণকারীদের আবারও সেই সাউন্ড শুনতে বলা হয় (স্ক্যানারের বাইরে) এবং সে সময়ে তারা কেমন অনুভব করে সে হিসেবে আবেগের তীব্রতা এবং সঙ্গীতের উপভোগ উভয়কেই রেট দিতে বলা হয় দুই প্রক্রিয়াতেই। ফলাফলে দেখা যায়, যারা বেশী সহানুভূতিশীল তারা এই স্যাড মিউজিক কে বেশি তীব্রভাবে অনুভব করেন কম সহানুভূতিশীল মানুষের চাইতে। এমনকি এদের মস্তিষ্কের লিম্বিক নেটওয়ার্কের কার্যকলাপও স্যাড মিউজিক শোনার ক্ষেত্রে বেশী প্রতিক্রিয়াপ্রবণ।
এই গবেষণার মাধ্যেমে আসলে বুঝা যায় যে, ব্যক্তিবিশেষে যে আবেগপ্রবণতা তার সাথে এই গানের সম্পর্ক গভীরভাবে জড়িত। প্যারাডক্স আসলে কার মধ্যে কিভাবে প্রভাব ফেলবে তার মাত্রা মূলত নির্ভর করে ব্যক্তিত্বের উপর, যা গবেষণায় প্রমাণিত। স্নায়বিক শক্তিমাত্রা যার যেমন ই হোক, গান যে আমাদের সাময়িক শান্তি এনে দেয় তা কখনোই অস্বীকার করা যায়না।
আপনার কী মনে হয়, ট্র্যাজিক মুভি/সিনেমা দেখে আনন্দ বা বিনোদন পাওয়া-ও কী ট্র্যাজেডি প্যারাডক্স-এর উদাহরণ?