চা (Tea) হলো পৃথিবীর সর্বাধিক পানকৃত পানীয়গুলোর মধ্যে অন্যতম। সব দেশেই চায়ের জনপ্রিয়তা অপরিসীম। আর আমাদের দেশে দিনে অন্তত একবার চা না হলে তো দিনই পার হয় না। পান করার দিক থেকে পানির পরেই চায়ের অবস্থান। চা কয়েক ধরনের হতে পারে যেমন: ওলোং চা, কালো চা, সবুজ চা, সাদা চা, হলুদ চা, ইস্টক চা, পুয়ের চা, ভেষজ চা, মাচা চা, সেঞ্চা চা, হিবিসকাস চা ইত্যাদি।
চায়ের ইতিহাস বহু প্রাচীন (প্রায় পাঁচ হাজার বছর পূর্বের)। গ্রীক দেবী থিয়ের নাম অনুসারে এর নাম দেওয়া হয় ‘টি’, চীনারা তাকে বলত ‘চি’ আর আমরা বলি ‘চা’। তবে চায়ের ইতিহাস চীন কেন্দ্রিক। চা এর সঙ্গে যিনি ওতোপ্রতভাবে জড়িত তিনি হলেন চিনা সম্রাট ‘শেন নাং‘। চা এর আবিষ্কার ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়নি। সম্রাট ‘শেন নাং’ ছিলেন অত্যন্ত স্বাস্থ্য সচেতন। তিনি স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য একেক সময় তার রাজ্যে একেক নিয়ম জারি করেন। একবার তিনি তার রাজ্যে পানি ফুটিয়ে খাওয়ার নিয়ম জারি করলেন।
তো একদিন সম্রাট ক্যামেলিয়া গাছের নিচে ফুটানো পানি নিয়ে বসে ছিলেন। তখন ওই ক্যামেলিয়া গাছের কয়েকটি পাতা উড়ে এসে তাঁর ফুটানো পানির মধ্যে পড়ে। সম্রাট দেখতে পান পাতা পানিতে পড়তেই তার ফুটানো পানির রং পরিবর্তন হয়ে বাদামী হয়ে যাচ্ছে এবং তিনি পানি থেকে অসাধারণ সুগন্ধ অনুভব করেন। এবার কৌতুহলি শেন ওই পানির স্বাদ পরিক্ষা করেন এবং তার কাছে ওই পানির স্বাদ ভালো লেগে যায়। তাছাড়া পাতা মিশ্রিত ওই পানিয় খেয়ে তিনি কিছুটা চাঙ্গা অনুভব করেন। তখন পর্যন্ত তিনি কিন্তু ওইটা কোন গাছের পাতা সেটা জানতেন না। কিন্তু পাতা মিশ্রিত ওই পানিয় পান করে ভালো লাগায় তিনি খোঁজ করে জানতে পারেন ওইটা ‘ক্যামেলিয়া সিনেনসিস‘ নামক গাছের পাতা (ক্যামেলিয়া সিনেনসিস হলো চা গাছের বৈজ্ঞানিক নাম)। সেই থেকে শুরু হলো চা খাওয়ার প্রচলন।
তবে চা কিন্তু শখের বসে পানীয় হিসেবে খাওয়া হতো না। এটি খাওয়া হতো স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ভেষজ হিসেবে। চাতে থাকে থিওফাইলিন ও থিওব্রোমিন যা শ্বাসজনিত সমস্যায় বিশেষ সহায়ক।
১৬৫০ সালে চীনে বাণিজ্যিক ভাবে চা চাষ শুরু হয়। তবে চা ইউরোপ মহাদেশে আসে পর্তুগিজদের মাধ্যমে। ইংরেজদের মধ্যে তখন চা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইংরেজ সেনারা এক এক দেশে শাসন করতে যায় আর চা এর প্রচলন করে। এভাবে ইংরেজদের মাধ্যমেই মূলত চা আমাদের ভারতবর্ষে আসে। তবে চা ইংল্যান্ডের মতো এত সহজে আমাদের উপমহাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। ইংরেজদের ব্যাপক প্রচেষ্টার ফলেই চা আজ আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত।
সর্বপ্রথম চা এর ব্র্যান্ড হলো ‘অসম টী কোম্পানি’ যেটা ইংরেজদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। তারাই চা পানের বিজ্ঞানসম্মত কারণসহ আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞাপন শুরু করেন। চা কে জনপ্রিয় করার লক্ষ্যে প্রথম প্রথম চা অত্যন্ত সুলভ মূল্যে বিক্রি করা হয় এমনকি বিনামূল্যে পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। তবে ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক ভাবে চা চাষ শুরু হয় আমাদের সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে (১৮৫৭ সালে)।
চা প্রস্তুতিকরন সহজ করে তুলতে ১৯০৯ সালে ‘টমাস সুলিভান’ টি ব্যাগের প্রচলন করেন। সিলেটের শ্রীমঙ্গলের নীলকন্ঠ টি ক্যাবিনে অবিশ্বাস্য সাত রঙ বিশিষ্ট রংধনু চা পাওয়া যায়। যার উদ্ভাবক রমেশ রাম গৌড়। চা তৈরির এই অভিনব কৌশল প্রকাশিত না হওয়ায় এই সাত রঙা চা সব জায়গায় পাওয়া যায় না।
তবে যাই হোক আমাদের দেশে কিন্তু বাঙালীদের চা এর চুমুক ছাড়া বিকাল পার হয় না। আর অতিথি আপ্যায়নে তো চায়ের বিকল্প ভাবাই যায় না। চা যে শুধু আমাদের দেশে জনপ্রিয় তা কিন্তু নয়। আগেই বলেছি পানির পরেই চায়ের অবস্থান। আমাদের বাঙালিদের চা পান করার অভ্যাস ছিল, আছে এবং থাকবে!