বাঙলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসের নাম জানেন তো ? সঠিক উত্তর হচ্ছে—আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৭ সাল) ।এবার বলুন তো, বাঙলা সাহিত্যের দ্বিতীয় উপন্যাস কোনটা। থাক , এটাও বলে দিচ্ছি। কালী প্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাচার নকশা (১৮৬১)। তৎকালীন কোলকাতার সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে আত্মকথা স্টাইলে লেখা এই বইটায় । (প্লানচেট)
এই বইয়ের একটা চ্যাপ্টারের নাম ”ভূত নাবানো” (বর্তমান সময়ের বানান রীতি অনুযায়ী হবে– ভূত নামানো) ।
লেখকের প্রতিবেশী এক বাসায় ভূত নামানো হবে রাতে। সবাই ভূত নামানো দেখতে গেছে।
সন্ধ্যার পরে ভূত নামানোর ওঝা এবং তার ৩ জন এ্যাসিস্টান্ট এলেন। ( লেখকের ভাষায়, ভূতের রোজা আর তার চ্যালা)। ঘরের সব বাতি নিভিয়ে দিয়ে ঘর অন্ধকার করে ভূতকে আহবান করা হল। ভূতের জন্য একটা কাঠের পিড়ি ফাকা রেখে দেওয়া হল তার বসার জন্য। একসময় ভূত আসল। বিশাল শব্দ করে কাঠের পিড়ির উপরে ভূতটা বসল। নাকি সুরে কথা বলা শুরু করল। অনেক হুমকি ধামকি দিল ভূতটা। তারপরে একসময়ে ভূতকে কিছু খাবার খেতে দেওয়া হল । অনেক অদ্ভুত অদ্ভূত শব্দ করে ভূত সেগুলো খেলও । কিন্তু তারপরে একটু পরে শব্দ শুনে মনে হল, কে যেন বমি করছে।
বাতি জ্বালিয়ে দেখা গেল, মূল ওঝা এবং তার ৩ এ্যাসিস্টান্ট বমি করছে। কারন কি ? ভূতের সামনে যে খাবার দেওয়া হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে কিছু বিষাক্ত কেমিকাল মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল, যেটা কোনো মানুষ খেলেই তার বমি এবং ডায়রিয়া হবে। বাড়ির লোকেরা দেখতে চেয়েছিল, যে আসলেই ভূত এসে খাবার খেয়ে যাচ্ছে, নাকি ভূতের ওঝারা মিথ্যা মিথ্যি ভূতের অভিনয় করে নিজেরা খাবার খেয়ে যাচ্ছে এবং প্রতারনা করে টাকা পয়সা নিয়ে যাচ্ছে।
এবং তাদের এক্সপেরিমেন্ট সফল । প্রমানিত হল যে , ভূত সশরীরে হাজির হয়নি। ভূতের চ্যালারাই নিজেরা ভূত সেজে নাকি সুরে কথা বলছিল। নিজেরাই খালি কাঠের পিড়িতে হাত দিয়ে জোরে আঘাত করে শব্দ করেছে। সবাইকে বুঝাতে চেয়ে ছে, ভূত এসে গেছে।
কোলকাতায় সেই সময় একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলছিল। এই সময়টাকে অনেকে বেংগল রেনেসা বলে থাকেন। হিন্দু কলেজের অধ্যাপক লুই ভিভিয়ান ডি‘রোজিও এবং তার স্টুডেন্টদের নেতৃত্বে ”ইয়ং বেংগল” নামে একটা গ্রুপ গঠিত হয়েছিল তখন। এই ইয়ং বেংগলরা সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার কে দূর করতে চেষ্টা করছিল। কালী প্রসন্ন সিংহ এই আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । হুতোম প্যাচার নকশা বইটায় বর্ননা করা উপায়েই তারা ভূত ফকির–ওঝাদের ভূত নামানোর ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছিল।
পরবর্তী সময়ে , ভূতের কবিরাজরা তাদের স্ট্রাটেজি চেঞ্জ করে। সশরীরে ভূত না নামিয়ে তারা অন্য কোনো একটা মিডিয়ামের মাধ্যমে ভুত বা অশরীরি আত্মা নামানোর ব্যবসা শুরু করে। যে লোকটাকে মিডিয়াম হিসেবে এ্যাসাইন করা হয়, তার ভয়েস ব্যবহার করেই ভূত বা আত্মা কথা বলত—এমনটাই দাবি ভূতের কবিরাজদের।
হুতুম প্যাচার নকশার শতাধিক বছর পরে, ১৯৭০ সালে সত্যজিত রায়ের লেখা গ্যাংটকে গন্ডগোল বইতেও আমরা একই ধরনের গল্প দেখতে চাই।
(সাবধান, ওই গল্পের স্পয়লার দিতে চাচ্ছি কিন্তু
)
শিবকুমার শেলভাংকার নামের একজন ব্যবসায়ী খুন হয় সেই গল্পে । তার ব্যবসায়িক পার্টনার শশধর বোস এই খুন করে। ঘটনা ক্রমে সেখানে যুক্ত হয়ে যান গোয়েন্দা ফেলুদা। ফেলুদাকে মিসগাইড করার জন্য শশধরবাবু জনৈক ডাক্তার বৈদ্যকে দিয়ে একটি প্লানচেট আয়োজন করে।
একটি অন্ধকার ঘরে মোমবাতির মৃদু আলোয় কয়েকজন হাতে হাত রেখে গোল হয়ে বসেন। প্লানচেটের মাধ্যমে শিবকুমারের আত্মা চলে আসে। তাকে সবাই প্রশ্ন করে। প্রশ্নের মাধ্যমে জানতে পারে খুনী হচ্ছে শিবকুমারের ছেলে বীরেন্দ্র।
কিন্তু ফেলুদা তার তদন্তের মাধ্যমে দেখতে পারে, শশধরবাবুই আসল খুনী। সেই শিবকুমারকে ব্যবসায়িক লাভের জন্য খুন করেছে। নিজের উপর থেকে দায় চাপাতে এখন প্লানচেটের নাটক করেছে। প্লানচেটে কোনো আত্মাই হাজির হয়নি। সব কথা গুলাই ডক্টর বৈদ্যকে শশধর বাবু শিখিয়ে দিয়েছিল। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর জন্য এই প্লানচেটের আয়োজন।
ভারতের পুলিশ প্লানচেটের কোনো গল্প বিশ্বাস করেনা। অপরাধের প্রমাণ পাওয়ার পরে শশধরবাবুকে এ্যারেস্ট করে নিয়ে গেল পুলিশ।
ফেলুদা দেখিয়ে দিলেন, প্লানচেট এর মাধ্যমে আত্মা আসেনা ,কিন্তু আত্মার নাম করে অনেক ক্রিমিনাল প্লানচেট কে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন।
ইয়ং বেংগলরা যে আলোর পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন, ২০০ বছরেও বাংগালি ততটা শিক্ষিত হতে পারেনি। ২০১৮ সালে এবিসি রেডিও ৮৯.২ এফ এম এ আরজে কিবরিয়া এবং রাদবি রেজা ‘ডর‘ নামক অনুষ্ঠানে লাইভ প্লানচেট করা শুরু করলেন। সেখানে ‘কথিত‘ আত্মাদের হাজির করে তাদের দিয়ে অনেক আজব আজব কাজ করানো হত । ছোট খাট কিছু হাতসাফাই দেখিয়ে তারা দাবি করতেন, আত্মা এসে এইসব কাজ করে দিয়েছে ( যেমন নেভানো মোমবাতিতে আগুন জ্বলে ওঠা, নষ্ট ইলেক্ট্রিক বাল্বে আলো জ্বলা, হাতের একটি আঙ্গুলে লাইট জ্বলা , স্বল্প পরিচিত লোকদের নাম ঠিকানা বলে দেওয়া ইত্যাদি) । বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ তাদেরকে বিশ্বাস করেছিল। তাদের মাধ্যমে তাবিজ, সুরমা, আংটি ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবসা শুরু হয়েছিল।
বাংলাদেশের পুলিশ এইসব প্লানচেট বিশ্বাস করেনি। তারা একসময় কিবরিয়া–রেজার ধান্দাবাজি ধরতে পারে। এ্যারেস্ট করে জেলে পাঠানো হয় এদেরকে। রাদবি রেজা স্বীকার করে , যে প্লানচেটে কোনো আত্মা আসত না। তারা কিছু এক্টিভিটিজ সাজিয়ে সাজিয়ে মানুষকে মিথ্যা কথা বলত। সবাইকে বুঝাত যে প্লানচেটের মাধ্যমে আত্মা এনে হাজির করেছি।
সব কিছু প্রকাশ হওয়ার পরে ডর প্রগ্রামটা বন্ধ হয়ে যায়। এবিসি রেডিও থেকে এই দুই প্রতারকের চাকরি চলে যায় । এদের নিয়ে তালাশের এই এপিসোড দেখতে পারেন ।
২.রিসেন্টলি, বাংগালি আবার আবার মেতেছে সুশান্ত সিং রাজপুতের প্লানচেট নিয়ে। গত ১৪ই জুন বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের ডেডবডি পাওয়া যায় তার ফ্লাটে , সিলিং এ গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় । এ্যাপারেন্টলি , এটা সুইসাইড। তবে অনেক ইমোশনাল ফ্যান মনে করেন, সুশান্তকে খুন করে এইভাবে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
রিসেন্টলি , আমেরিকার এক প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর স্টিভ হাফ দাবি করছেন, তিনি সুশান্তের আত্মার সাথে কথা বলেছেন।
গত ১ সপ্তাহে তিনি তার ইউটিউব চ্যানেল থেকে ৩ টা ভিডিও আপলোড করেছেন। প্রতিটায় একটু একটু করে সুশান্তের আত্মার সাথে কথোপকথন দেখিয়েছেন। তার কাছে আজব দর্শন একটি মেশিন আছে।কিছু সুইচ বোর্ড,লাইট, তার এবং একটি স্পিকার নিয়ে তার মেশিন। সেই মেশিন থেকে মাঝে মাঝে অদ্ভূত কিছু দুর্বোধ্য আওয়াজ বের হয়। শুনে মনে হয় বয়স্ক একটি পুরুষ কন্ঠ কিছু এলোমেলো ইংরেজি শব্দ বলছে। শব্দগুলো এতই অস্পষ্ট যে সেগুলা যেকোনো শব্দই হতে পারে। Hen, then, men, Drain,Brain,Chain, Pain ইত্যাদি সব শব্দই একইরকম।
এ কারনে স্টিভ হাফ মেশিন থেকে যে শব্দ বের হচ্ছে, সম্ভাব্য সেই শব্দ বা বাক্যগুলোকে সেগুলাকে ভিডিওতে লিখেও দেন। মেশিনের শব্দ নিজেই করছেন, নাকি তার কোনো এযাসিস্টান্ট করছে, নাকি কোনো কম্পিউটার প্রগ্রামের মাধ্যমে র্যনাডম কিছু ইংরেজি শব্দ বাজানো হচ্ছে—সেটা পরিশকার বোঝা গেল না। তার কোন ভিডিওই লাইভ নয়। সবই রেকর্ড করে, ভালভাবে এডিট করে, তারপরে টেলিকাস্ট করা হয়।
যাই হোক, স্টিভ হাফ দাবি করেন, তিনি মেডিটেশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তির আত্মাকে তিনি হাজির করতে পারেন তার স্পিরিট বক্সের মধ্যে।
আলোচ্য ভিডিওতে তিনি সুশান্ত সিং এর আত্মাকে হাজির করেছেন। তাকে স্টিভ হাফ জিজ্ঞেস করেন , তোমার মৃত্যুর রাতে কি হয়েছিল বলো তো ? মেশিন থেকে উত্তর আসে, অনেক মানুষ এসেছিল। তাদের সাথে পেরেক ছিল। তাদের সাথে আমার তর্কাতর্কি হয়েছিল।
এই উত্তরের পর সুশান্তের ভক্তরা আবার হত্যারহস্য নিয়ে মেতেছে।
স্টিভ হাফের ইউটিউব চ্যানেলে অন্যান্য ভিডিওগুলো দেখলাম। গত ১০ বছরে কয়েক হাজার ভিডিও বানিয়েছেন তিনি। মাইকেল জ্যাকসন, কোবি ব্রায়ান্ট সহ অনেক সেলিব্রেটির আত্মাকেই এনেছেন , মানে ভিডিও বানিয়েছেন তাদের কথাবার্তা নিয়ে ।
গড়ে তার একেকটা ভিডিও ২ লাখ ভিউ হয়। কিন্তু সুশান্তকে নিয়ে বানানো ভিডিওগুলো ভিউ প্রায় কোটিতে চলে গেছে । (৮০ লাখ এবং ৬০ লাখ ভিউ) বোঝা যাচ্ছে, খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছেন সুশান্ত সিংকে নিয়ে ভিডিও বানানোর পরে।
প্রশ্ন হচ্ছে, স্টিভ হাফ এসব করছেন কেন ? এক লাইনে উত্তর হচ্ছে, টাকার জন্য করছেন এসব। তিনি ভিডিওতে দাওয়াত দিয়েছেন, তার সংগঠনে ডোনেট করার জন্য এবং সদস্য হওয়ার জন্য। সবচেয়ে কমদামী সদস্য হওয়ার ফি ৫ ডলার। বেশি দামী মেম্বরশিপ ফি ও আছে।
তার ওয়েবসাইটে স্পিরিট বক্স এবং আরো অনেক জিনিসপত্র বিক্রিও করা হচ্ছে ।
স্টিভ হাফ যদি স্পিরিট দের সাথে কথাই বলতে পারেন, তাহলে তো সকল আত্মার ব্যক্তিগত তথ্যাবলী , ব্যাংক একাউন্টের পাস ওয়ার্ড, সুইস ব্যংকের লুকানো সম্পদ—সবই জেনে যাবেন। সেখান থেকেই অনেক টাকা পয়সা নিতে পারতেন। এইভাবে ভূত দেখিয়ে ব্যবসা করতে হত না।
স্টিভ হাফের ২০১৬ সালের পুরনো একটি ভিডিও পেলাম, যেখানে দেখা যাচ্ছে, আত্মা এসে তাকে বলে যাচ্ছে, নিউ হ্যাম্পশায়ারের প্রাইমারি ইলেকশনে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর বার্নি স্যান্ডার্স জিতবেন ।
এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের আরেকটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একটা স্পিরিট এসে তাকে বলে যাচ্ছে, করোনাভাইরাস খুব বড় বিপদ ঘটাবে ।
অর্থাৎ, তার স্পিরিটরা স্টিভ হাফ কে ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারে। এই ক্ষমতা সে তো মানব কল্যাণের কাজে লাগাতে পারত। করোনা প্যান্ডেমিক কবে শেষ হবে, সেই তথ্য জানতে পারত। কিংবা করোনার ভ্যাক্সিনের ফর্মূলা জানতে চাইতে পারত। (যেমনটা মুফতি ইব্রাহিম করেছিলেনে। 1.q7+6=13 সূত্র দিয়েছিলেন) । তেমন কিছু করেনি সে। তার আত্মাগুলো নতুন কিছুই জানাতে পারছে না। অলরেডি আমরা যা জানি, সেটাই জানাচ্ছে । সুশান্ত সিং সম্পর্কেও সে নতুন কিছুই জানাচ্ছে না।
সুশান্তের আত্মা যে আসলেই এসেছে ,তার কিন্তু কোনো প্রমান নেই। তার একান্ত ব্যক্তিগত তথ্য কিন্তু পাওয়া যায়নি।
যেমন ধরুন– ফেসবুকের পাসওয়ার্ড । এটা আমাদের খুব ব্যক্তিগত জিনিস। বউ/গার্লফ্রেন্ড/বয়ফ্রেন্ডের সাথেও এই পাসওয়ার্ড আমরা শেয়ার করিনা সচরাচর । সুশান্তের আত্মা যদি হাজির হত,তাহলে সেই আত্মার মাধ্যমে তার ইমেইল, ফেসবুক,হোয়াটস এ্যাপ বা অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টের পাসওয়ার্ড পাওয়া যেত। স্টিভ হাফ সেই পাসওয়ার্ড নিয়ে ফেসবুকে লগ ইন করে তো স্ট্যাটাস দিতে পারত ! কিন্তু তেমন কিছু করতে পারছে না। আত্মাটা সেই সকল কথাই বলতেছে ( স্বর্গ, নরক, ফ্যামিলি মেম্বর, দেবদূত) যেগুলা অন্য সব মানুষ জানে । [পুরা ইন্টারভিউ এর অনুবাদ পাবেন এখানে ।
কে খুন করেছে, এই কথা যদি আত্মা বলতেই পারত, তাহলে সি আই এ, এফ বি আই সহ সকল গোয়েন্দা সংস্থা স্টিভ হাফ কে নিয়ে গিয়ে তাদের অমীমাংসিত কেস সলভ করত। তাকে নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। সেইরকম কাড়াকাড়ি তো দূরের কথা, এখন পর্যন্ত একটা খুনের ক্লূ ও পুলিশ কে দিয়ে সে সাহায্য করতে পারেনি।
তাহলে Steve Huff কি শুধুমাত্র ব্যবসার জন্য, তার প্যারানর্মাল গ্রুপে কিছু মেম্বর বাড়ানোর জন্য এই সব নাটক সাজাচ্ছে ?
৩.প্লানচেট করে আত্মা নামানোর সবচেয়ে পপুলার পদ্ধতি হল ওইজা (Ouija Board) বোর্ড। লুডু বা মনোপলি খেলার মত একটা বোর্ড, আরেকটু বেশি শক্ত । বোর্ডে এ থেকে জেড অক্ষরগুলা লেখা থাকে। কিছু নাম্বার এবং সাইন থাকে। আর থাকে একটা কার্সর।
যারা প্লানচেট করতে চান, তারা একসাথে বসে হাতে হাত ধরে কার্সরের উপর হাত রাখে। তারপরে কার্সরকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে। কার্সর তখন লোকদের হাতের তলা থেকে সরে সরে যায় । N O বা Y E S বা অন্যান্য অক্ষরের উপর কার্সরগুলা চলে যায় । যে যে অক্ষরের উপরে কার্সরগুল গেল, সেই অক্ষরগুলো সাজিয়ে সাজিয়ে লিখে পূর্নাংগ এন্সার পাওয়া যায়।
ব্যাপারটা অনেকটা বাংলাদেশের বাটি চালানের মত। চোর ধরার জন্য বাটি চালান আয়োজন করা হয়। বাটির উপর হাত দিয়ে ফকির/কবিরাজ/ওঝা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ায় এবং অবশেষে সম্ভাব্য চোরের বাড়িতে গিয়ে থামে। নিজে হাত দিয়ে বাটি ঠেলে ঠেলে নিয়ে যায়, কিন্তু সবাইকে বুঝায় যে ,আমি ঠেলিনি, বাটিই অলৌকিক শক্তি দিয়ে নিজে নিজে হেটে গেছে। আমাকেও সাথে করে টেনে নিয়ে গেছে। বাটি থেকে হাত সরানোর কোনো ক্ষমতা আমার ছিলনা।
প্লানচেটেও সেই একই ঘটনা ঘটে। দাবি করা হয় যে, আত্মা এসে ওইজা বোর্ডের কার্সর ঠেলে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্লানচেটের দলের মধ্যেই ওঝা/কবিরাজ থাকে। ফেলুদার গল্পের শশধর বাবুর মত। সে ই জোর প্রয়োগ করে ওইজা বোর্ডের কার্সরকে নিজের ইচ্ছামত জায়গায় সরিয়ে দেয় ।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলের ব্রেইন গেমস এর একটি এপিসোড আছে এই ওইজা বোর্ড নিয়ে । খুব সহজ দুইটা এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছিল। প্রথমে নরমাল অবস্থায় ওইজা বোর্ডে আত্মাকে ডাকা হল। আত্মা এল। ইংরেজিতে কিছু কোশ্চেন করা হল, আত্মা সঠিকভাবে এন্সার দিল। কার্সর টা সঠিকভাবে নির্দিষ্ট অক্ষরের উপরে গিয়ে বসল।
দ্বিতীয় ধাপে, প্লানচেট কারী সবার চোখ বেধে দেওয়া হল। আবারো আত্মাকে ডাকা হল। আত্মা এলো। তাকে একই প্রশ্ন করা হল। দেখা গেল, এবার কার্সরটা বোর্ডের সঠিক জায়গায় গিয়ে ইংরেজি অক্ষরের উপর বসছে না। এলোমেলোভাবে একেক জায়গায় গিয়ে থেমে যাচ্ছে, যেগুলোর কোনো অর্থ হয়না।
সুতরাং প্রমানিত হল , ওইজা বোর্ডে কোনো আত্মা এসে কার্সর সরায় না। বোর্ডের মানুষ গুলাই নিজের হাতের শক্তিতে এই কাজ করে। চোখ খোলা থাকলে তারা দেখে দেখে ঠিক জায়গায় সরাতে পারে, চোখ বন্ধ থাকলে আর পারেনা।
(ওইজা বোর্ডে এবং এই ধরনের প্যারানর্মাল ঘটনার বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যার জন্য পড়ুন এই আর্টিকেল )
এছাড়া প্লানচেট কারীদের আরেকটা ফেভারিট পদ্ধতি ছিল– ভেন্ট্রিলোকুইজম । এই পদ্ধতিতে জাদুকর তার সাথে একটা পুতুল রাখত। পুতুলের মধ্যে আত্মা এসে বসত (দাবি করা হত) । এরপর আত্মাকে প্রশ্ন করা হলে পুতুলটা উত্তর দিত।
প্রকৃতপক্ষে ,পুতুলটা কোনো উত্তর দিত না। জাদুকর নিজেই সব প্রশ্নের উত্তর দিত। বিশেষ কৌশলে উত্তর দিত, এজন্য জাদুকরের ঠোট নড়ত না। দর্শক ভাবত, পুতুলটা বোধ হয় উত্তর দিচ্ছে।
The Big Bang Theory নামক আমেরিকান টিভি সিরিয়ালের সিজন ১০ এর এপিসোড ২২ এ ভেন্ট্রিলকুইজমের একটা সিকয়েন্স আছে। গল্পের নায়ক হাওয়ার্ড এবং নায়িকা বার্নাডেট দুইজনই ভেন্ট্রিলোকুইজম পারে। হাওয়ার্ড কম পারে, আর বার্নাডেট বেশি পারে। দেখা গেল, পুতুল দিয়ে কথা বলানোর সময় পুতুলটা যান্ত্রিক উপায়ে ঠোট,হাত পা নাড়াচ্ছে। আর বার্নাডেট এর ঠোট প্রায় নড়ছেই না। দর্শক বিভ্রান্তিতে পড়েন যে কে কথা বলছে। কিন্তু হাওয়ার্ড ভেন্ট্রিলোকুইজম করার সময়ে পুতুলের ঠোটের সাথে সাথে তার নিজের ঠোট ও অনেক বেশি নড়ে যাচ্ছে। দর্শক সহজেই বুঝে যায় যে এতা আসল পুতুল না ।
[ ২ মিনিটের ইন্টারেস্টিং ভিডিওটা পাবেন এই লিংকে ]
পেশাদার যাদুকর ভ্যাল ভ্যালেন্টিনো বিভিন্ন ধরনের জাদু , এবং সেই জাদুগুলোর গোপন রহস্য রিভিল করে দেখিয়েছেন
Breaking the Magician’s Code: Magic’s Biggest Secrets Finally Revealed
নামের টিভি সিরিয়ালে। ৩ টা সিজনে সমাপ্ত এই সিরিয়ালে তিনি প্রায় ২০০ জাদুর গোপন রহস্য রিভিল করেছে। ভেন্ট্রিলোকুইজম , প্লানচেট, আত্মাকে দিয়ে আগুন জ্বালানো সহ অনেক অনেক জাদুর রহস্য জানতে পারবেন এই সিরিয়াল থেকে। ইউটিউবেই জাদুর ভিডিওগুলো এ্যাভেইলেবল ।
৪.
বিশ্বে অনেকগুলা সংগঠন আছে, যারা বিভিন্ন প্যারানর্মাল ঘটনার অনুসন্ধান করে। খুজতে গিয়ে দেখেছে, এই ঘটনাগুলা কোনোটাই প্যারানর্মাল ঘটনা নয়। অধিকাংশই গুজব। এবং অল্প কিছু ঘটনা রয়েছে, যেগুলা নর্মাল প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটে, প্যারানর্মাল কিছু নেই । ( যেমন– গনেশের মূর্তির দুধ খাওয়া, কবরের লাশ না পচা ইত্যাদি)
এই সংগঠনগুলো কথিত প্যারানর্মাল ঘটনায় বিশ্বাসীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে , যে কেউ যদি কোনো অলৌকিক ঘটনা দেখাতে পারে, তাহলে লাখ লাখ টাকা পুরষ্কার দেওয়া হবে। বলা বাহুল্য তেমন কোনো দাবিদার পাওয়া যায়নি।
নেটফ্লিক্সের The Messiah টিভি সিরিয়ালটা কি দেখেছেন ? কথিত মেসিয়া পায়াম গোলশিরি নিউইয়র্কের লিংকন মেমোরিয়ালের লেকের পানির ওপর দিয়ে হেটে গেলেন। শত শত দর্শক এই ঘটনাকে মেসিয়ার অলৌকিক ক্ষমতা বলে মনে করল। কিন্তু ডিবাংকার জেমস রান্ডি টিভিতে এসে বললেন, এখানে খুব সিম্পল কিছু ট্রিক্স করা আছে। লেকের পানিতে প্লেক্সিগ্লাস বা এই জাতীয় উপাদানের টেবিল সাজানো থাকতে পারে। তার উপর দিয়েই সম্ভবত মেসিয়া হেটে গেছে। অতীতে অনেক জাদুকর এইভাবে পানির উপর দিয়ে হেটেছে। পানিতে হাটার আরো অনেক টেকনিক আছে। পায়াম গোলশিরি যদি দাবি করে, সে কোনো ট্রিক্স ইউজ করেনি, অলৌকিক ক্ষমতাবলেই পানির উপর দিয়ে হেটেছে, তাহলে সে আসুক আমার সামনে। আমি তাকে চ্যালেঞ্জ করছি, কন্ট্রোলড এনভায়রনমেন্টে, একাধিক ক্যামেরার সামনে এসে পানিতে হেটে দেখাক।
বলা বাহুল্য, পায়াম গোলশিরি সেই চ্যালেঞ্জ নেয়নি।
এই জেমস রান্ডি কিন্তু জাস্ট সিরিয়ালের কোনো ক্যারেক্টার নন। বাস্তব জীবনেই ইনি আছেন। তার কোম্পানির নাম জেমস রান্ডি ফাউন্ডেশন। এর প্যারানর্মাল চ্যালেঞ্জের ঘোষিত মূল্য ১ মিলিয়ন ডলার । বলাবাহুল্য , কেউই প্যারানর্মাল কোনো ঘটনা দেখিয়ে সেই প্রাইজ হিততে পারেনি ।
উইকিপিডিয়ার লিস্ট অনুযায়ী, সারা বিশ্বে এইরকম ২৯ টা চ্যালেঞ্জ বর্তমানে এ্যাক্টিভ আছে। এই গ্রুপগুলাতে ডাক্তার , পদার্থবিজ্ঞনী, রসায়নবিজ্ঞানী সহ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পন্ডিত ব্যক্তিবর্গ আছেন। এদের কাছে এসে কেউ কোনো প্যারা নর্মাল এ্যাক্টিভিটিজ এর প্রমান দেখাতে পারলেই মিলিয়ন মিলিয়ন টাকা পেয়ে যাবে।
সো, স্টিভ হাফ , আপনার আত্মাদের সাথে কথাবার্তা বলার প্রমাণ নিয়ে আপনার কাছাকাছি কোনো স্কেপটিক সোসাইটিতে কে কি প্রাইজ ক্লেইম করবেন ? প্যারানর্মাল ঘটনার প্রমাণ দেখিয়ে মিলিয়ন ডলার পুরষ্কার নিবেন ? নাকি সাধারন আমজনতাকে ভুল বুঝিয়ে আত্মার গল্প বলে ব্যবসা করাই আপনার উদ্দেশ্য ?