আজকে মা দিবস। আমাদের জীবনে মায়েদের অবদান আমরা বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু আপনাদের মনে প্রশ্ন কি এসেছে, যে, আমাদের জীবনে মা এর অনেক ভূমিকা, কিন্তু বিজ্ঞান এর জগতে মায়েদের কোন ভূমিকা নেই? মানে তারা কি কোন শাখার জন্ম দেননি?
অবশ্যই হ্যা, মেয়েদের হাত ধরে বিজ্ঞান এবং টেকনোলজির বিভিন্ন শাখার জন্ম হয়েছে। যেহেতু বিজ্ঞান এবং টেকনোলজির মত পুরুষ শাসিত বিষয়ে মেয়ে বিজ্ঞানীদের সেভাবে আমরা দেখি না, তাই এই মায়েদের সংখ্যাও হাতেগোণা। কিন্তু তারা যে সুযোগ সৃষ্টি করেছেন, যে বিষয়ে তাদের পুরুষ সহকর্মীদের সাথে পাল্লা দিয়ে গবেষণা করেছেন, অবশ্যই তারা সম্মানের যোগ্য। তারা তাদের ফিল্ডে ছিলেন অগ্রপথিক, পরিবার এবং নিজেদের বাচ্চা-কাচ্চা সামলে তারা বিজ্ঞানের এই শাখাগুলিতেও কাজ করে গেছেন।
চলুন তবে আজ পরিচিত হয়ে নেই সেই সব মা-দের সাথে!
যারা হোম ইকোনোমিক্স এর ক্লাস করেন, তাদের ইনাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। যদি আপনার ঘরকে ঠিকমত স্যানিটাইজ করতে পারেন, তাও সে ধন্যবাদ ইনি পাবেন। আবার রেস্টুরেন্টে বসে মনের সুখে পরিষ্কার ভাবে, কোন প্রকার স্বাস্থ্যঝুঁকি ছাড়া খাবার খাচ্ছেন, সেটার ধন্যবাদও ইনিই পাবেন। কিন্তু কেন?
ইনি হলেন Family and consumer science এর জননী। অনেক মেয়েলি বলে বিজ্ঞানের এই শাখাকে সাধারণত খুব একটা পাত্তা দেওয়া হয় না। কিন্তু ঘুরে ফিরে এই ফিল্ডের কাছেই সবাইকে ফিরে আসতে হয়, কারণ এই ফিল্ডে আলোচনা হয় গৃহস্থালি পরিবেশ এবং গার্হস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার বিজ্ঞানভিত্তিক সমাধান নিয়ে। এছাড়া এই শাখায়, মানুষের মন এবং স্বাস্থ্যের উপর তার চারপাশের পরিবেশের প্রভাব নিয়েও আলোচনা করে।
কর্মজীবনে তিনি ছিলেন industrial and safety engineer, একই সাথে একজন environmental chemist। স্যানিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং এ তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে, যা পথ দেখিয়েছে অন্যান্য গবেষণার। ১৮৯০ সালে তার করা বিশাল একটা সার্ভের ফলাফল, আমেরিকাতে পানের যোগ্য পানির মাপকাঠি হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া মহিলাদের গার্হস্থ্য জীবনের সমস্যা সমাধানে প্রথম বিজ্ঞানের ব্যবহারকারীও তিনি। তিনি MIT এর প্রথম নারী শিক্ষার্থী এবং একই সাথে একই প্রতিষ্ঠানের প্রথম মহিলা প্রফেসরও ছিলেন।
নিউইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রীজের নাম শুনেছেন? অনেক বিখ্যাত এই ব্রীজ, যা ব্রুকলিন কে ম্যানহাটন এর সাথে যুক্ত করে। এই ব্রীজ, ১৯০৩ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা ব্রীজ ছিল, যার ডিজাইন করা হয়েছিল ২০০ বছর টেকার জন্য, কিন্তু এখনো সদর্পে টিকে আছে East River এর বুকে।
এই ব্রীজ তৈরির পেছনে হাত ছিল এক নারীর। Emily Roebling এর স্বামী Washington Roebling ছিলেন এই ব্রীজের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি এতই অসুস্থ হয়ে যান যে, বিছানাবন্দি হয়ে পড়েন চিরতরে। কিন্তু এত বড় ইঞ্জিনিয়ারিং সাইটকে ফেলে রাখা যায় না, আবার এর সাথে স্বামীর সুনামও জড়িত! এগিয়ে আসেন এমিলি নিজে।
দ্রুততম সময়ের ভেতর তিনি মালামালের শক্তিমত্তা যাচাই, ক্যাবল কন্সট্রাকশন এবং স্ট্রেস এ্যানালাইসিস ইত্যাদি কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি নিজের স্বামীর হয়ে এই ব্রীজের কাজে নিজেকে উতসর্গ করেছিলেন, এই মেগা প্রজেক্ট সফল করেছিলেন।
এই ব্লগগুলি পড়তে ভুলবেন না! |
কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করছে অথচ এ্যাডা লাভলেস এর নাম শোনেনি, এটা হতেই পারে না! এই ভদ্রমহিলা নিজেকে দাবি করতেন “poetical scientist,” কারণ তিনি যে সময়ের মানুষ, তখন মেয়েদের বিজ্ঞানে তেমন কোন অবদান রাখার সুযোগ ছিল না। ১৭ বছর বয়সে তার পরিচয় হয় চার্লস ব্যাবেজের সাথে, দুজনেই ছিলেন গণিতের প্রতি সমান অনুরক্ত।
এ্যাডা, ব্যাবেজের সব লেকচার মন দিয়ে শুনতেন, নোট রাখতেন। শুধু তাই নয়, তিনিই প্রথম ব্যাবেজের এ্যানালিটিকাল ইঞ্জিনের জন্য সাজেশন এবং ইমপ্রুভমেন্ট আবিষ্কার করেন, এই ইঞ্জিনের কমান্ড এর পদ্ধতি তিনি খাতায় লিখে রাখেন। ফলে সেগুলো পরিণত হয়, বিশ্বের প্রথম হাতে লেখা কম্পিউটার প্রোগ্রাম এ।
এ্যাডা লাভলেস কে আধুনিক কম্পিউটার প্রোগ্রাম এবং কম্পিউটার এ্যালগোরিদম এর জননী এর সম্মান দেওয়া হয়। তার সম্পর্কে জানতে পড়ে ফেলুন, এই ব্লগটিঃ অ্যাডা লাভলেসঃ বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার !
ইনি হলেন আধুনিক নার্সিং এর জননী। নার্সিং পেশাটি যতদিন পৃথিবীতে থাকবে, ততদিন উচ্চারিত হবে তার নাম। ১৮৫০ সালের দিকে তিনি ক্রিমিয়ান যুদ্ধে একজন নার্সের ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু সেখানে নার্সদের বেহাল দশা এবং ফিল্ড হাসপাতালগুলির অবস্থা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, কিছু একটা করার।
ইংল্যান্ডে ফিরে তিনি ৮৩০ পেজের বিশাল একটি ডকুমেন্ট তৈরি করে জমা দেন Royal Commission on Health এ। সেখানে তিনি নার্সদের ভাল থাকার ব্যবস্থা এবং ভাল সম্মানীর দাবী করেন। একই সাথে যুদ্ধের ফ্রন্ট লাইনে থাকা সৈনিকদের সেবা করার জন্য ভাল পরিবেশ এবং সুবিধার দাবি ছিল এই ডকুমেন্টে। তিনি Royal Statistical Society এর প্রথম মহিলা সদস্য ছিলেন।
নার্সিং এবং ধাত্রীবিদ্যার জন্য তার প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল ছিল, তিনি এর মাধ্যমে হাসপাতালগুলিতে স্যানিটাইজেশন এরও অসামান্য নজির স্থাপন করেন।
ডেনিস যখন ১৯২০ সালে Cornell University থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিগ্রি নিয়ে বের হোন, তখন আর কেউ খুব একটা উপকৃত না হলেও, রেল যোগাযোগ এবং রেলপথে ভ্রমণ সংক্রান্ত বিষয় খুব উপকৃত হয়েছিল। সত্য বলতে কি, তিনিই প্রথম আরামদায়ক রেলভ্রমণ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এজন্য তাকে বলা হয় the mother of two things: railway travel and traveling in comfort.
তার সময়ের আগে, রেলে যাতায়াত করাটা খুব একটা আরামদায়ক ছিল না। তার পাশ করার সাথে সাথে B&O Railroad কোম্পানি তাকে একজন ড্রাফসম্যান হিসেবে চাকরি দেয়। কারণ তারা দেখেছিল, রেলের যাত্রীদের অর্ধেকের বেশিই মহিলা, এবং তারা কোচ সার্ভিস নিয়ে খুব একটা খুশি না।
ডেনিস নিয়োগ পেয়েই প্রথমে যে কাজ করেন, পার্শিয়াল (পার্শিয়াল কারণ রেলের সিট খুলে পরিষ্কার করাটা একটা বিশাল সময়ের ব্যাপার) পরিষ্কার করা যায় এমন সিট তৈরি করা, কোন রকম দাগ লাগবে না এমন সিটের হাতল তৈরি করাও তার অবদান। এছাড়া বড় ড্রেসিং রুম এবং সেখানে ফ্রি পেপার টাওয়েল ও পরিষ্কার সামগ্রী নিয়ে আসার বুদ্ধিও কিন্তু তারই!
তিনি রেলকোচের জন্য এমন একধরণের সিলিং লাইট আবিষ্কার করেন, যেটার তীব্রতা কমানো বাড়ানো যেতো। এর সাহায্যে যাত্রীরা চাইলে তাদের অংশের আলোর তীব্রতা কমিয়ে বিশ্রাম নিতে পারতেন। এছাড়া রেলকোচের জন্য individual vents তৈরি করেন, যাতে সব কোচে যাত্রীরা সমান ধুলাবালু মুক্ত বাতাস পেতে পারেন।
তার তৈরি করা এই জিনিসগুলিই এখন ট্রেন এবং প্লেনে ব্যবহৃত হচ্ছে, আরো উন্নত ভাবে।
তিনি বলতেন,
কোন ব্যবসা কতটা সফল, এটা দেখার বিষয় না। বরং সেই ব্যবসাই বেশি সাফল্য পাবে, যদি তা মহিলাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেয়।
Marie Curie
কোনমতেই, কোন কারণেই নিউক্লিয়ার সায়েন্স এর জননীকে এই লিস্ট থেকে বাদ রাখার কোন উপায় ছিল না! আর উপায় না থাকার যথেষ্ট কারণও রয়েছে বৈকি!
বিজ্ঞানের ওয়ান্ডার ওম্যান বলা হয়ে থাকে মেরি কুরি কে। কি নেই তার ঝুলিতে? রেডিওএ্যাকটিভিটির উপর তার কাজ তাকে এনে দিয়েছে সম্মানজনক নোবেল পুরষ্কার। তাও একবার নয়, দুই দুইবার! স্বামীর সাথে পাল্লা দিয়ে কাজ করে গেছেন তিনি , চার বছরে তার পেপার সংখ্যা ছিল ৩২টি! একই সাথে তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক এবং কনসার্ট পিয়ানিস্ট।
তার আবিষ্কারের ঝুলিতে আছে, দুইটি তেজস্ক্রিয় মৌল। সেগুলি হল রেডিয়াম এবং পোলোনিয়াম, একই সাথে তিনি কাজ করেছেন কি করে এই তেজস্ক্রিয় রশ্মি ব্যবহার করে ক্যান্সারের চিকিৎসা করা যায়। তার দুই মেয়ে, আইরিন এবং ইভকেও পথ দেখিয়েছেন গবেষণায় আর তার দেখানো পথে এগিয়েও তারাও অর্জন করেন নোবেল প্রাইজ।
এ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট Joan Feynman কে অরোরা এবং মেগনেটোস্ফিয়ারিক ফিজিক্স (auroras and magnetospheric physics.) এর জননী বলা হয়। এছাড়া তিনি একটি পরিসংখ্যানভিত্তিক একটি মডেল তৈরি করেন, যেটা ব্যাখা করে যে, কণ নভোযান কি পরিমাণ উচ্চক্ষমতা বিশিষ্ট পার্টিকেল সহ্য করতে পারবে।
নাসাতে তার ক্যারিয়ার শুরু আগে, তিনি একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন, যার সাহায্যে সৌরকলঙ্কের উপস্থিতি অনুমান করা যেতো। এছাড়া তার পাচ দশক মেয়াদি জিওফিজিক্যাল গবেষণাগুলো নাসা এখনো ব্যবহার করে তাদের কাজে।
ইনি হলেন সেমিকন্ডাক্টর এবং কনডাকটিভিটি এর জননী। আধুনিক কম্পিউটিং এর দুনিয়ার বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে তার করা সুপারকনডাকটিভির উপর গবেষণাগুলি। একই সাথে এই গবেষণাগুলো বর্তমান সময়ের উন্নত সুপারকনডাক্টর তৈরিতে ভূমিকা রাখছে।
তার ঝুলিতে আছে চারটি পেটেন্ট, ২৭০ টি গবেষণা পত্র। একই সাথে এই ফিল্ডে জনপ্রিয় কিছু পাঠ্যবই এর রচয়িতাও তিনি। তিনি সেই স্বল্প সংখ্যক ব্যক্তিদের ভেতর অন্যতম, যাদের National Academy of Engineering, National Academy of Sciences, American Academy of Arts and Sciences এই তিনটা প্রতিষ্ঠানেরই মেম্বারশিপ আছে!
এই আমেরিকান নারী বৈজ্ঞানিক পেশায় একজন ফিজিক্যাল কেমিস্ট, এছাড়া যদি বিশেষভাবে বলতে হয়, তাহলে তিনি বায়োইনফরমেটিক্স শাখায় একজন অগ্রপথিক, বায়োইনফরমেটিক্স এর জননী এই বিজ্ঞানী। ১৯৬৫ সালে তার লেখা বই, Atlas of Protein Sequence and Structure ধরা হয় বায়োইনফরমেটিক্স এর founding text for bioinformatics. তিনি প্রথম ৬৫টি জানা প্রোটিন সিকুয়েন্স রিপোর্ট করেন, যা ১৯৭১ সালে Protein Information Resource database তৈরিতে ভূমিকা রাখে।
তিনিই সর্ব প্রথম বায়োক্যামিস্ট্রিতে গণিত এবং computational method এর সমন্বয় করেন। এছাড়া এ্যামিনো এসিডের জন্য তিনি সর্বপ্রথম one-letter code ব্যবহার করেন, যাতে ডাটাবেজ ফাইলের সাইজ কমানো যায়। এই পদ্ধতি, প্রোটিনে এ্যামিনো এসিডের সিকুয়েন্স ব্যাখ্যা করার পথ আরো সুগম করে।
এছাড়াও বিভিন্ন নারী বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন শাখায় রেখে চলেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান, উদাহরণস্বরূপঃ Hilde Mangold অবদান রেখেছিলেন ভ্রূণতত্ত্ববিদ্যায়, Jeanne Villepreux-Power অবদান রেখেছিলেন মেরিন বায়োলজিতে (তিনি বিখ্যাত, কারণ প্রথম এ্যাকুরিয়াম আবিষ্কারের ক্রেডিট তারই)প্রমুখ। তাদের গল্প হবে আরেকদিন, শুধুমাত্র তাদের খবর পৌছানোর জন্য কান পেতে বসে থাকা আর অপেক্ষা!