মোটেই না। মহাজাগতিক বস্তু গুলোর দূরত্ব নির্ণয় করা জ্যোতির্বিদ্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিভিন্ন দূরত্ব নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন ধরণের প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়।
প্যারালক্স:
কোনো বস্তুকে ভিন্ন কোণ থেকে দেখলে বস্তুটির অবস্থান ভিন্ন মনে হয়। সহজভাবে এটা বোঝার জন্য একটি কলম বা পেন্সিল হাতে নিয়ে সামনে ধরুন। তারপর একবার বাম ও একবার ডান চোখ বন্ধ করে সেটির দিকে তাকান। মনে হবে পেন্সিলটি দুটি ভিন্ন অবস্থানে আছে। আমাদের মস্তিষ্ক এই দুই অবস্থানকে বিশ্লেষণ করে এবং এর প্রকৃত অবস্থান ও দূরত্ব আমরা বুঝতে পারি। এই পর্যবেক্ষণ করা দুটি ভিন্ন জায়গার মধ্যবর্তী ব্যবধান যতো বেশি হবে, বস্তুর অবস্থান ততো নিখুঁতভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
পৃথিবীর যেকোনো দুটি জায়গা থেকে কোনো নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করা হলে, নক্ষত্রের দূরত্বের তুলনায় এই ব্যবধান খুবই ক্ষুদ্র হবে। তাই এই ব্যবধান বাড়ানোর জন্য বিজ্ঞানীরা অভিনব পদ্ধতি ব্যবহার করেন।
পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণায়মান এবং ৬ মাসে একটি বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে। তাহলে কোনো নক্ষত্রকে যদি ৬ মাস পর পর পর্যবেক্ষণ করা হয় তাহলে দুটি পর্যবেক্ষণের মধ্যবর্তী দূরত্ব অনেক বেশি হবে এবং নক্ষত্রের অবস্থান নিখুঁতভাবে নির্ণয় সম্ভব হবে।
এভাবে পর্যবেক্ষণ হয়ে গেলে তারপর খুবই সহজ গাণিতিক হিসাব। সূর্য, পৃথিবী ও নক্ষত্রটির মধ্যে ত্রিভুজ সৃষ্টি হয়। পৃথিবীর কক্ষপথের দূরত্ব আমাদের জানা এবং নক্ষত্রের পরিবর্তনের জন্য উৎপন্ন কোণের মানও পেলাম। এখন, tanθ=লম্ব/ভূমি সূত্রটি ব্যবহার করলে সরাসরি সূর্য এবং পর্যবেক্ষণকৃত নক্ষত্রটির দূরত্ব পেয়ে যাই।
তবে দূরত্ব যতো বেশি হবে, কোণের পরিমাণ ততো কমতে থাকবে। তাই দূরের নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যায়না। এখন পর্যন্ত এর সর্বোচ্চ সীমা ১০,০০০ আলোকবর্ষ।
স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল:
দুটি একই উজ্জ্বলতার বস্তু একটিকে কাছে এবং অন্যটিকে দূরে রাখলে, দূরের বস্তুটির উজ্জ্বলতা কম মনে হবে। কাছের বস্তুটির উজ্জ্বলতা জানা থাকলে দূরের বস্তুটির হ্রাস পাওয়া উজ্জ্বলতার সাথে তুলনা করে দূরত্ব নির্ণয় করা যায়। জ্যোতির্বিদ্যায় এই পদ্ধতিটি ব্যবহৃত হয়। কিছু বস্তু আছে যেগুলো স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
সেফিড ভ্যারিয়েবল:
এই নক্ষত্রগুলো নিয়মিত সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। সংকুচিত অবস্থায় উজ্জ্বলতা সবচেয়ে কমে যায় এবং প্রসারিত অবস্থায় উজ্জ্বলতা সবচেয়ে বেড়ে যায়। বেশি উজ্জ্বল সেফিড ভেরিয়েবল এর ক্ষেত্রে এই চক্র দীর্ঘ হয় এবং কম উজ্জ্বলগুলোর চক্র ছোট হয়। এই বৈশিষ্ট্য থেকে এর প্রকৃত উজ্জ্বলতা ও দূরত্ব নির্ণয় করা যায়। যেহেতু উজ্জ্বলতা উঠানামা করে তাই সহজেই এগুলো অন্য নক্ষত্র থেকে আলাদা করা যায়। এর সীমা ১০০ মিলিয়ন আলোকবর্ষ।
টাইপ ১-এ সুপারনোভা:
কোনো বাইনারি নক্ষত্র সিস্টেমের একটি নক্ষত্র যদি শ্বেত বামনে পরিণত হয়, এর উচ্চ মহাকর্ষীয় টানে অপর নক্ষত্রটির উপাদান এর সাথে যুক্ত হতে থাকে এবং শ্বেত বামনটির ভর বাড়তে থাকে। কিন্তু চন্দ্রশেখর সীমা অনুযায়ী কোনো বামনের ভর ১.৪ সৌরভরের বেশি হতে পারেনা। তাই যখন ১.৪ সৌরভরের চেয়ে ভর বেশি হয়ে যায় তখন এটি বিস্ফোরিত হয়। এটিকে ‘টাইপ ১-এ সুপারনোভা’ বলে। সুপারনোভা অনেক বেশি উজ্জ্বল হয়, এমনকি এরা গ্যালাক্সির সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তুতে পরিণত হতে পারে। তাই অনেক দূর থেকে (প্রায় ১০বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর থেকেও) এটি চিহ্নিত করা যায়।
সব ধরণের টাইপ ১-এ সুপারনোভা প্রায় একই উজ্জ্বলতার হয়ে থাকে। তাই এক্ষেত্রেও উজ্জ্বলতার তুলনা করে এই মহাজাগতিক বস্তু গুলোর দূরত্ব নির্ণয় করা যায়। তবে এরকম সুপারনোভা খুবই বিরল ঘটনা।
রেড শিফট:
মহাজাগতিক বস্তু গুলোর দূরত্ব নির্ণয়ের সর্বোচ্চ স্তর এটি। আলোকে বিশ্লেষণ করলে বিভিন্ন বর্ণের তরঙ্গদৈর্ঘ্য পাওয়া যায়। বেগুনি বর্ণের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম এবং লাল বর্ণের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি।
কোনো বস্তু যতো দূরে চলে যেতে থাকে, সেই বস্তু থেকে আসা আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ততো প্রসারিত হতে থাকে। তাই দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে কোনো বস্তুর আলো লাল রঙের দিকে ধাবিত হয়। এই ঘটনাটিকে বলা হয় ‘রেড শিফট’। কি পরিমাণ রেড শিফট হচ্ছে এর উপর ভিত্তি করে দূরবর্তী গ্যালাক্সির দূরত্ব নির্ণয় করা হয়।
কোনো নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির দূরত্ব নির্ণয় হয়ে গেলে সেটির সাহায্য নিয়ে তার আশেপাশে থাকা বস্তুর দূরত্ব নির্ণয় করা যায়। নতুন বস্তুটির সাহায্য নিয়ে আবার তার পরের বস্তুর দূরত্ব নির্ণয়। অনেকটা মইয়ের সাথে তুলনা করা যায় এটিকে। এক ধাপের সাহায্য নিয়ে অন্য ধাপে, নতুন ধাপের সাহায্য নিয়ে আবার আরেকটি ধাপে এভাবে চলতে থাকে।
সম্প্রতি জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে দূরবর্তী গ্যালাক্সি CEERS 93316 এর ছবি প্রকাশিত হয়েছে। বিগ ব্যাং সংঘটিত হয় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে এবং যে ছবিটি প্রকাশিত হয়েছে এটি বিগ ব্যাং এর মাত্র ২৩৫ মিলিয়ন বছর পরের ছবি।
তাহলে গ্যালাক্সিটির দূরত্ব এখন পৃথিবী থেকে ১৩.৫৬৫ আলোকবর্ষ হওয়া উচিত তাই না?
কিন্তু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে এটি সঠিক না।
মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত বড় হচ্ছে। একই গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলোতে বা কাছাকাছি গ্যালাক্সির ক্ষেত্রে এই প্রসারণটা বোঝা যায়না। কারণ, এই প্রসারণ নিকটবর্তী বস্তুগুলোকে আলাদা করতে পারেনা। কিন্তু অনেক দূরে থাকা বস্তগুলো ক্রমেই একে অন্যের থেকে দূরে সরে যায়। একটি গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সি দূরত্ব যতো বেশি হবে, এদের দূরে সরে যাওয়ার বেগ ততোই বাড়তে থাকবে।
v=Hd
এখানে, v হলো গ্যালাক্সির বেগ, d দূরত্ব এবং H হাবল ধ্রুবক।
অর্থাৎ, গ্যালাক্সিগুলোর বেগ দূরত্বের সমানুপাতিক।
CEERS 93316 এর ক্ষেত্রে বিগ ব্যাং এর ২৩৫ মিলিয়ন বছর পর গ্যালাক্সিটি থেকে আলো যাত্রা শুরু করেছিল এবং সেই আলো এখন আমাদের কাছে পৌঁছেছে। এতো বছর পর গ্যালাক্সিটি এখন আর পূর্বের অবস্থানে নেই। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের কারণে এটি দূরে যেতে যেতে বর্তমানে পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে।
একইভাবে, এর আগে পাওয়া GLASS-z13 গ্যালাক্সিটির ছবির বয়স ১৩.৪ বিলিয়ন বছর কিন্তু বর্তমানে গ্যালাক্সিটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৩.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, এস্ট্রোনমি ডট কম, বিবিসি