মানুষ বাদে শান্তি-প্রিয় প্রাণীর উদাহরণ দিলে শুরুতেই আসবে মৌমাছি। এরা খুবই পরিশ্রমী, দলবদ্ধ এবং নিয়মতান্ত্রিক প্রাণী। এদের সমাজে সবার কাজ নির্দিষ্ট, চেইন অফ কমান্ড এর বিন্দুমাত্র নড়চড় হয় না কখনও; হয় না কোন বিদ্রোহ। এখানে দূর্বলের কোন স্থান নেই, অত্যাচারীও নেই এখানে। নিজ দায়িত্ব পালনে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও এরা পিছপা হয় না কখনই।
কঠোর পরিশ্রমী, আত্ম-ত্যাগ ও নিষ্ঠাই এদের ৩০ মিলিয়ন বছর ধরে টিকিয়ে রেখেছে। তাই মৌমাছি সামাজিক জীব হিসেবে স্বীকৃত।তাদের নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। বিজ্ঞানীরা বার বার চেষ্টা করেছে, মৌমাছিদের মধ্যে যে রহস্যের বেড়াজাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তা সকলের কাছে তুলে ধরতে। তেমনই রহস্য ঘেরা মৌমাছির নৃত্য।
মৌমাছি, মৌমাছি, কোথা যাও নাচি নাচি দাঁড়াও না একবার ভাই।
ওই ফুল ফোটে বনে, যাই মধু আহরণে, দাঁড়াবার সময় তো নাই…
মৌমাছির এই অসম্ভব ব্যস্ততার কারণ নিয়ে আজকে আমি কথা বলবো। মৌমাছির নৃত্য মোটেও শুধু নাচ নয়, এ নাচের মাধ্যমেই মৌমাছিরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ, তত্ত্ব আদান প্রদান করে থাকে। মৌমাছির এই অদ্ভুত যোগাযোগের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী কার্ল ফন ফ্রিস্ক।
তিনিই প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন যে, মৌমাছি নাচ এর মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে। কোন মৌমাছি যখন খাবারের অথবা মধুর নির্যাসের কোন উৎস (ফুল) খুঁজে পায় তখন সে মৌচাকে এসে নাচ এর মাধ্যমে সকলকে খবর দেয়। সে দেহ দোলাতে থাকে এবং নাচতে থাকে এমন এক পথ ধরে, যার মাধ্যমে সে উৎসের দিক বোঝাতে পারে।
মৌমাছিই একমাত্র পোকা যা মানুষের খাদ্য তৈরি করে। এক একটা মৌচাকে প্রায় ২০০০০-৮০০০০ মৌমাছি থাকে। অঙ্গসাংস্থানিক ও কাজের ভিত্তিতে মৌচাকে প্রধানত ৩ ধরনের মৌমাছি থাকে – কর্মী মৌমাছি, পুরুষ মৌমাছি এবং রাণী মৌমাছি। মৌচাকের প্রায় ৯৯ ভাগ মৌমাছিই কর্মী মৌমাছি। আর এই সব কর্মী মৌমাছির লক্ষ্য সর্বাধিক মধু সংগ্রহ করা। মৌমাছির নাচের সময়ব্যাপ্তি এবং কম্পনের (দোলন) সংখ্যা দিয়ে সে বোঝায় ঠিক কত দূরে আছে ফুল এবং ফুলে কি পরিমাণ মধুর নির্যাস রয়েছে, যেমন ১ সেকেন্ডের দোলন বোঝায় উৎস রয়েছে ১ কি.মি দূরে।
সকালে বেরিয়ে পড়ে অনুসন্ধানী কর্মী মৌমাছি, উড়ে বেড়ায় এক ফুল থেকে আরেক ফুলে, যতক্ষণ না পর্যন্ত চমৎকার মানসম্পন্ন মধুর খোঁজ পায়। কাঙ্ক্ষিত ফুলের সন্ধান পাওয়ার পর আনন্দে আত্মহারা হয়ে সে ফিরে আসে মৌচাকে, অন্যদেরকে জানায় তার আবিষ্কারের কথা।
প্রথমে সে বয়ে আনা মকরন্দটি (nectar) তাকে গোল হয়ে ঘিরে ধরা কর্মী মৌমাছিদের মুখের কাছে নিয়ে নিয়ে স্বাদ দেয়, এতে তারা বুঝতে পারে মধুর গুণাগুণ। মধুর গুণের ব্যাপারে অন্যদের আস্থা জন্মানোর পর, মধুর উৎসের সন্ধান দেয় সে, অদ্ভুত এক উপায়ে, যা দেখে অন্যরা (Recruit) উৎসের দিকে তাদের অভিযান শুরু করে।
কোন পথে উৎসটি বিদ্যমান এটি জানানোর জন্য স্পন্দন নৃত্য (Waggle Dance) নামে এক ধরণের নাচ শুরু করে স্কাউট মৌমাছিটি। এতে মৌচাকের একটি স্থান থেকে শুরু করে, প্রথমে শরীর কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে নির্দিষ্ট দিকে সোজা একটু দূরত্ব অতিক্রম করে সে, তারপর অর্ধবৃত্তাকার পথে সূচনা বিন্দুতে ফিরে আসে, আবার সোজা পথে শরীর কাঁপিয়ে কাঁপিয়ে পূর্বের দূরত্ব অতিক্রম করে, এবং অবশেষে বিপরীত দিক থেকে অর্ধবৃত্তাকার পথে ফিরে আসে— এভাবে বাংলা ৪-এর মত দেখতে বর্তনীপথ তৈরি করে। সঙ্গীদেরকে কয়েকবার সে এভাবে বর্তনী তৈরি করে দেখায়।
Waggle:
মধুর উৎসের দিক বর্তনীর সোজা পথটুকুর দিক থেকে মধুর উৎসের দিকের সন্ধান পাওয়া যায়।
FlowerField:
ধরি, প্রথম মৌমাছিটির খাবারের উৎস সূর্যের দিকে, তাই সে মৌচাকে আসার পর তার নাচের সোজা পথটি হবে মৌচাকের নীচ থেকে খাড়া উপরের দিকে। খাড়া উপরের দিক মানে সূর্যের দিক। দ্বিতীয় মৌমাছিটির খাবারের উৎস হলো মৌচাক থেকে যেদিকে সূর্য, তার সাথে ৯০ ডিগ্রি কোণে ডান দিকে।
তাই মৌচাকে আসার পর এর নাচের সোজা পথটিও খাড়া উপরের দিকের সাথে ৯০ ডিগ্রি কোণে ডান দিকে হবে। অন্যদিকে তৃতীয় মৌমাছিটির খাবারের উৎস হলো, যেদিকে সূর্য, তার সাথে ১৩৫ ডিগ্রি কোণে বাম দিকে। তাই এর নাচের সোজা পথটি হবে খাড়া উপরের দিকের সাথে ১৩৫ ডিগ্রি কোণে বাম দিকে।
Direction:
“তার মানে সংবাদবাহক মৌমাছি প্রথমে সূর্যের দিকটি দেখে, তারপর তার সাথে খাবারের উৎস কত ডিগ্রি কোণে, কোন দিকে আনত তা হিসেব করে এবং মৌচাকে আসার পর, খাড়া উপরের দিকটিকে সূর্যের দিক ধরে নিয়ে, কোণটিকে সেভাবে ডানে বা বামে সমন্বয় করে অন্যদের দেখায়। অন্যরা তখন প্রথমে সূর্যকে দেখে
সেভাবে খাবারের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে।”
এগুলো পড়তে ভুলবেন না! পৃথিবীর পরমাণু সংখ্যা থেকে তাসের শাফল সংখ্যা বেশি। কিন্তু কীভাবে? “সূর্য লকডাউনে” শুনে সূর্য নিজেই হতাশ,ভয়ের কিচ্ছু নেই-জানিয়েছেন তিনি |
মধুর উৎসের দূরত্ব অর্থাৎ ফুলটি কোন দিকে আছে তা হয়তো বুঝতে পেরেছ, কিন্তু কত দূরত্বে আছে ? তা কি করে বুঝবে ,এটা বুঝার জন্য তারা যা করে তা নিচে দেওয়া হলোঃ
যদি ফুলটি দূরে হয়, তাহলে সোজা পথটি অতিক্রম করার সময় মৌমাছিটি বেশি সময় নিবে, কাছে হলে কম সময়। সোজা পথের সময় দেখে অন্যরা হিসেব করে নেয় কত দূরে খাবারের উৎস।
একটি বিশেষ প্রজাতির মৌমাছির উপর গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০০ মিটার দূরত্বের জন্য স্পন্দন নৃত্যের সময় ৭৫ মিলিসেকেণ্ড করে বেড়ে যায়। অন্য প্রজাতির ক্ষেত্রে ফলাফলটি ভিন্ন হতে পারে। তবে যেকোনো প্রজাতির ক্ষেত্রে দূরত্বের সাথে সময়ের সর্বদাই একটি সুনির্দিষ্ট সরলরৈখিক সম্পর্ক (linear relationship) বিদ্যমান। নিচে তোমাদেরকে এশীয় এবং ইউরোপীয় দুটি মৌমাছি প্রজাতির ক্ষেত্রে দূরত্ব বনাম স্পন্দন নৃত্যের স্থায়িত্বকাল-এর সম্পর্ক দেখাচ্ছি ”
Apis
১. এশীয় মৌমাছি Apis cerana-এর দূরত্ব (x)বনাম সময় (y) রেখাঃ y=154+3.40x
২. ইউরোপীয় মৌমাছি Apis mellifera ligustica-এর দূরত্ব (x)বনাম সময় (y)রেখাঃ y=165+1.92x
এখন তোমাদের প্রশ্ন হতেই পারে, সূর্য তো সব সময় এক জায়গায় থাকে না। যদি মৌমাছিটির আসতে দেরী হয়, তখন তার নাচ দেখে অন্যরা বের হয়ে গেলে তারা দিক ভুল করবে না?
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ। প্রতি ৪ মিনিটে সূর্য ১ ডিগ্রি করে পশ্চিম দিকে সরতে থাকে। যদি অনুসন্ধানী (scout) মৌমাছিটির মৌচাকে আসতে বেশ সময় লাগে কিংবা মৌচাকে আসার অনেক পরে নাচ দেখায়, সূর্যের দিক পরিবর্তনের সাথে তার নৃত্য কোণটিও সেভাবে সমন্বয় করে নেয় সে, ফলে কোনো সমস্যা হয় না। এ এক অদ্ভুত ক্ষমতা।
এটি না ঘটলে পরবর্তী মৌমাছিদের (recruit) অনেকেই মারা যেত, কারণ ভুল পথে চলে যাবার কারণে বাসা থেকে যে খাবার নিয়ে তারা বের হতো, তা শেষ হয়ে যেত, এবং খাবারের কোনো উৎস খুঁজে না পাওয়ায় ক্লান্তিতে আর ফিরে আসতে পারত না। কিন্তু এরকম কখনো হয় না। কিন্তু যদি আসার পথে মেঘে সূর্য ঢেকে যায়,তাহলে অতিবেগুনি রশ্মি (ultraviolet rays) কাজে লাগিয়ে, অন্ধকারেও মৌমাছিগুলো সূর্যের অবস্থান বুঝতে পারে।