প্রথম পর্বের পর থেকে…
যতো সহজে আমি আপনি মুখে বলতে পারছি ‘পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং’ ব্যাপারটি কিন্তু ততোটা সহজ নয়। এর পেছনে আছে সেই মেধাবী বিজ্ঞানী ও তাঁর সহযোগীদের সম্মিলিত কঠোর পরিশ্রম।
মূল ঘটনায় যাওয়ার আগে যারা জিনোম সিকোয়েন্স ব্যাপারটা যারা জানেন না তাদের খুব সংক্ষেপে বলি-
Genome Sequencing কী?
সকল জীবের DNA অণুতে বিদ্যমান নাইট্রোজেন বেস (A, T, G, C) এর পেয়ার এর সংখ্যা এবং সেগুলো কোন অনুক্রমে সজ্জিত সেটাই হলো জিনোম সিকোয়েন্সিং। কোনো জীবের DNA তে অবস্থিত ‘জিন’ তার বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে। তবে কোন জিন কোন বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে এটা জানাতে জিনোম সিকোয়েন্সিংই একমাত্র সহায়ক।
এবার আসি ড. মাকসুদুল আলমের সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর ঘটনায়,
পাটের সাথে যেহেতু বাংলাদেশের অনেকটা ইতিহাস অতপ্রোতভাবে জড়ানো তাই বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম ভেবেছিলেন, এটার জিনোম সিকোয়েন্সও যদি আমাদের হাতেই হতো তাহলে বিশ্ববাসী ‘পাট’ বললে বাংলাদেশ ব্যাতীত অন্য কিছু উচ্চারণ করতেই পারতো না। সেই আবেগের জায়গা ও তাঁর জীবনরহস্যের প্রতি প্রবল নেশা থেকেই শুরু করলেন কাজ। এজন্য তিনি অনেক বার বাংলাদেশেও এসেছেন।
২০০৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আহমেদ শামসুল ইসলাম, প্রাণরসায়ন ও অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক হাসিনা খান ও বেসরকারি তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সংস্থা ডেটাসফটের মাহবুব জামানের সঙ্গে এই ব্যাপারে কথা বলেন এবং তাঁরা সকলেই যথেষ্ট আগ্রহ দেখান। কিন্তু এসব জৈব প্রযুক্তি বিষয়ক কোনো কাজে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়। প্রথমে অনেক প্রতিষ্ঠানের কাছে আবেদন করলেও কোনো লাভ হচ্ছিলো না। ২০০৮ সালের জুনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক ও ডেটাসফটের সেই কর্মীদের নিয়ে “স্বপ্নযাত্রা” নামক একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
সেখানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়েছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদ ও ডেটাসফট কোম্পানি। অনেক ঘোরাঘুরি করার পরও যখন তহবিল সংগ্রহ করা যাচ্ছিলো না, কেউ এগিয়ে আসছিলো না তখন তাঁরা নিজেদের অর্থায়নেই কাজ শুরু করেছিলো।যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ হাওয়াই এর জিনোম রিসার্চ সেন্টার এবং মালয়েশিয়ার ইউএসএম এর প্রাথমিক কারিগরি সহায়তায় শুরু হয়েছিল কাজ।
কিন্তু যখন পাট বিষয়ক অনেক তথ্য হাতে এসে গেলো তখন এসব সুবিন্যস্তকরণ ও ব্যাখ্যার জন্য প্রয়োজন ছিলো সুপার কম্পিউটার। যেটা ছিলো অনেক ব্যয়বহুল। এছাড়াও আরো বিভিন্ন পর্যায়ে অর্থের প্রয়োজন হচ্ছিলো। এক সময় তাদের পক্ষে আর এসব বহন করা সম্ভব হচ্ছিলো না তখন বন্ধ হয়েছিল গবেষণা। কিন্তু, এই বিষয়ে প্রথম আলো পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় এবং তৎকালীন কৃষিমন্ত্রীর নজরে আসে ব্যাপারটি। এরপর থেকে সরকারের অর্থায়নে আবার শুরু হয় গবেষণা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ডেটাসফটের সাথে এবার যুক্ত হয় বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। অবশেষে ২০১০ সালের ১৬ ই জুন ‘তোষা পাটের’ জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচিত হয়।
বিশেষজ্ঞ ও কৃষিবিজ্ঞানীরা মতামত দিয়েছেন, এই জিনোম সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে এখন পাটের আঁশের দৈর্ঘ্য ও গুনগত মান উন্নত করা সম্ভবপর হবে এবং উচ্চ ফলনশীল জাতের পাট, লবণাক্ত মাটি ও বিভিন্ন পোকামাকড় সহনশীল জাত উদ্ভাবন করা যাবে।
তোষা পাটের পর বাংলাদেশেই ড. মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে হয়েছে ছত্রাকের জিনোম সিকোয়েন্সিং। বাংলাদেশের কৃষকরা তখন সাদা পাটের চাষ প্রায় অনেকটা কমিয়ে দিয়েছিলো। এর পেছনের প্রধান কারণ ছিলো ছত্রাকের সংক্রমণ। Macrophomina phaseolina এই ছত্রাকটি পাটসহ আরো ৫০০ উদ্ভিদের ক্ষতিসাধন করে। এই ছত্রাকের পর বাংলাদেশের জনপ্রিয় সাদা পাটের জিনোম সিকোয়েন্সও করা হয়েছে এই বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে।
বিজ্ঞানীর পাট ও পাটের ক্ষয়সাধনকারী ছত্রাকের জীবন রহস্যের ফলে উদঘাটিত হয়েছে যেসব তথ্য:
পাটের ডিএনএ বেস পেয়ার প্রায় ১২০ কোটি। পাটের আঁশে প্রায় ১৫ শতাংশ লিগনিন বিদ্যমান, যা সূক্ষ্ম আঁশ তৈরিতে বাধা প্রদান করে। Macrophomina phaseolina ছত্রাক থেকে ৩৬ টি উৎসেচক পাওয়া গেছে, যেগুলো ব্যবহার করার মাধ্যমে এ ধরনের লিগনিন সরিয়ে ফেলা সম্ভব যা পরবর্তীতে বস্ত্রশিল্প, জৈব জ্বালানি উৎপাদনে ব্যবহার করা যাবে।
এই গবেষণালব্ধ ফলাফল কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে উন্নত প্রজাতির পাটের জাত উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে।
ড. মাকসুদুল আলমের আবিষ্কারের ঝুলিতে আরো যা যা রয়েছে:
★২০০৭ সালে মাকসুদুল আলম Hawaii Papaya Genome Project এ কাজ করেছিলেন যার লক্ষ্য ছিল ট্রান্সজেনিক ‘সানআপ’ পেঁপের সম্পূর্ণ জিনোমকে সিক্যুয়েন্স করা। আলম এবং তাঁর দল কৃষকদের সহায়তা করার লক্ষ্যে ট্রান্সজেনিক পেঁপে সিকোয়েন্স করেছিলেন। পেঁপের রিংস্পট ভাইরাস প্রতিরোধ করে সানআপ পেঁপের জিনগতভাবে পরিবর্তন সম্ভব হয়েছিল।
★ হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এবং তার দল একটি প্রাচীন ব্যাকটেরিয়া Idiomarina loihiensis এর জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন করেন ২০০৩ সালে ।
★ এছাড়াও তিনি রাবার এবং আরো কিছু ফাংগাসের জীবন রহস্য উন্মোচন করেছেন।
ড. মাকসুদুল আলমের অর্জন ও সম্মাননা:
১৯৮৭ সালে জার্মান সাইন্স ফাউন্ডেশন থেকে Humboldt Research Fellow লাভ করেন।
১৯৯৭ সালে ইউনিভার্সিটি অফ হাওয়াই থেকে NIH Shannon Award পান গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য। এরপর ২০০১ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক্সিলেন্স অব রিসার্চ অ্যাওয়ার্ড পান তিনি।
বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এই গুণী বিজ্ঞানীকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়।
ড. মাকসুদুল আলম এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ইউনিভার্সিটি অফ হাওয়াই গঠিত করেছে ‘Maqsudul Alam Graduate Research Award Fund’ , যার মাধ্যমে মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তা করা হয়।
ড. মাকসুদুল আলমের প্রকাশনা:
Synteny and Collinearity in Plant Genomes (2008).
Protoglobin and globin-coupled sensors (2008).
২০১৪ সালের ২০ ডিসেম্বর লিভার সিরোসিস এ আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই বিজ্ঞানী। তবে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে একজন সোনালী মহানায়ক হিসেবে।