সম্প্রতি তুরস্ক সিরিয়া সীমান্তে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের পর ফের এই বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে চলছে সমালোচনার ঝড়। সমালোচনায় সবাই আঙ্গুল তুলছে আমেরিকার হার্প প্রযুক্তি-র দিকে। বলা হচ্ছে বৈশ্বিক রাজনীতির বিরোধিতার অংশ হিসেবে তুরস্ককে উচিত শিক্ষা দিতেই হার্প প্রযুক্তির অপব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। এই হার্প নিয়ে মানুষের যখন এত কৌতূহল, তাহলে চলুন হার্প প্রযুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।
হার্প প্রযুক্তি কি?
![হাই ফ্রিকুয়েন্সি একটিভ অরোরাল রিসার্চ প্রোগ্রাম (High Frequency Active Auroral Research Program) হার্প প্রযুক্তি](https://blog.sciencebee.com.bd/ufuchecm/2023/03/maxresdefault_11zon-300x169.jpg)
![হাই ফ্রিকুয়েন্সি একটিভ অরোরাল রিসার্চ প্রোগ্রাম (High Frequency Active Auroral Research Program) হার্প প্রযুক্তি](https://blog.sciencebee.com.bd/ufuchecm/2023/03/maxresdefault_11zon-300x169.jpg)
হার্প সম্পর্কিত আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে হার্প প্রযুক্তি হলো একটি বৈজ্ঞানিক প্রকল্প যার লক্ষ্য আয়নোস্ফিয়ার বা ওজন স্তরের বৈশিষ্ট্য এবং আচরণ অধ্যয়ন করা। আয়নোস্ফিয়ার পৃথিবী পৃষ্ঠের উপরে প্রায় ৫০ থেকে ৪০০ মাইল প্রসারিত একটি নিরপেক্ষ পর্দা। যা পৃথিবীর উপরের বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে যেখানে আমরা বাস করি ও শ্বাস নেই সেই নিম্নের বায়ুমণ্ডলের সীমানা হিসেবে কাজ করে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে হার্প প্রকল্পের যাত্রা শুরু ১৯৯০ সালে। যার অনুমোদন নিতে সাহায্য করেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন রিপাবলিকান সিনেটর টেড স্টিভেন। ১৯৯৩ সালে প্রকল্পটির নির্মাণ শুরু হয় এবং এটি ২০১৫ সালের ১১ আগস্ট আলাস্কা বিশ্ববিদ্যালয়কে হস্তান্তর করা হয় এবং তখন থেকেই এটি পরিচালিত হচ্ছে।
হার্প কে আবিষ্কার করেন?
‘একে অনেকটা লেজার গানের সঙ্গে তুলনা করা যায়। লেজার গানের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন, যে নির্দিষ্ট একটি স্থানে কেন্দ্রীভূত করে রশ্মিটি ফেলা হয়। এ ক্ষেত্রেও তেমনি ঘটবে। শুধু রশ্মিটি আসবে প্রাকৃতিক মাধ্যম থেকে।’
হার্প কি ভাবে কাজ করে?
হার্প কিভাবে কাজ করে তা নিয়ে ব্যাপক মতভেদ আছে। এর পাশাপাশি এর রয়েছে ব্যাপক অস্পষ্টতা। পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের একাংশ মনে করেন, হার্প একটি অস্ত্র। যা দিয়ে ভূমিকম্প, সুনামি, বন্যা, ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটানো সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের হার্প প্রকল্প থেকে জানা যায়, প্রকল্পে স্থাপিত অ্যালুমিনিয়াম অ্যান্টেনাগুলো দিয়ে আয়নমলে তরঙ্গ প্রেরণ করা হয়।
এই তরঙ্গ প্রেরণ করা হয় ভূমি থেকে প্রায় ৫০ মাইল দূরবর্তী অবস্থান থেকে। এর ফলে সূর্যরশ্মির গমন পথে আহিত কণা সৃষ্টি হয়। এটি নিম্ন আয়নমলে কম্পন সৃষ্টি করে। এই কাঁপুনির ফলে এক ধরণের সাময়িক অ্যান্টেনার উৎপত্তি ঘটে। এই অ্যান্টেনাগুলো পৃথিবীতে অনেক ক্ষুদ্র ও নিচু মাত্রার তরঙ্গ পাঠাতে থাকে। এই তরঙ্গগুলো সাগরের গভীরে প্রবেশ করতে পারে। সমুদ্রের লবণাক্ত পানি উচ্চ মাত্রার তরঙ্গ গ্রহণ করতে সক্ষম। ফিরে আসা এ তরঙ্গকে হার্প আবার পাঠাতে পারে নির্দিষ্ট কোনো স্থানে।
![হাই ফ্রিকুয়েন্সি একটিভ অরোরাল রিসার্চ প্রোগ্রাম (High Frequency Active Auroral Research Program) হার্প প্রযুক্তি](https://blog.sciencebee.com.bd/ufuchecm/2023/03/3000_11zon-300x200.jpeg)
![হাই ফ্রিকুয়েন্সি একটিভ অরোরাল রিসার্চ প্রোগ্রাম (High Frequency Active Auroral Research Program) হার্প প্রযুক্তি](https://blog.sciencebee.com.bd/ufuchecm/2023/03/3000_11zon-300x200.jpeg)
‘এটিই হচ্ছে সত্যিকারের তরঙ্গ। এগুলো উপর থেকে আসে এবং অনেক গভীরে যেতে পারে। এটা কোনো ধরনের তার দিয়ে সৃষ্টি করা সম্ভব না।’
আমরা জানি, সূর্যের অভ্যন্তরে অগ্নিঝড়ের দমকা চলতে থাকে সারাক্ষণ। পর্যায়ক্রমে এর হার বাড়তে ও কমতে থাকে। একেকটি দমকার সঙ্গে প্রচন্ড তাপবাহী সৌরশিখা সৌরজগতে ছড়িয়ে পড়ে। এই শিখার সঙ্গে বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তেজস্ক্রিয়তার (ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন) আণবিক বিস্ফোরণ ঘটে। তেজস্ক্রিয় শিখা যখন পৃথিবীর দিকে আসতে থাকে, তখন বায়ুমন্ডলের বাইরের পরিমন্ডল কর্তৃক তা বাধাগ্রস্ত হয়। এতে ভূ-পৃষ্ঠে থাকা মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু হার্পের মাধ্যমে বায়ুমন্ডলের ওজোনস্তরে ফাটল ধরিয়ে সরাসরি তেজস্ক্রিয় শিখাকে প্রবেশের রাস্তা করে দেয়া হয়। এবং এভাবে সৃষ্টি করা যায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
আবার হার্প দ্বারা সরাসরি ভূমির অভ্যন্তরে টেকটোনিক প্লেটে বিদ্যুৎচৌম্বকীয় তরঙ্গ প্রেরণ করে তাতে ফাটল ধরানোর মাধ্যমে সৃষ্টি করা যায় ভূমিকম্প ও সুনামি। পৃথিবীর উপরিতল একাধিক শক্ত স্তরে বিভক্ত। এগুলোকে টেকটনিক প্লেট বলা হয়। কোটি কোটি বছর ধরে এগুলো পৃথিবীর উপরিতলে এসে জমা হয়েছে। টেকটনিক প্লেট মূলত পাথরের তৈরি, এর উপরিভাগ মাটি, বালি ও জীবাশ্ম দিয়ে তৈরি। টেকটনিক প্লেট ১৫ কিলোমিটার থেকে ২০০ কিলোমিটার পুরু হতে পারে। পৃথিবীর অভ্যন্তরে থাকা গলিত ম্যাগমা বা লাভার ওপর এগুলোর অবস্থান।
হার্প পরিচালনাকারীদের মতে, এই প্রকল্পের লক্ষ্য হলো আয়নমণ্ডলের বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও ঘটনা সনাক্তকরণ এবং অনুসন্ধান করা। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট কাজ করা যাবে বলে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। যেমনঃ
আয়নমণ্ডলের বৈশিষ্ট্য, চরিত্র ও তা সনাক্ত করতে ভূবিদ্যা সম্পর্কিত কিছু পরীক্ষা চালানো, যাতে করে ওজনস্তরের নিয়ন্ত্রণ লাভ করা যায়;
আয়নমণ্ডলে লেন্সের মাধ্যমে অতি উচ্চকম্পাঙ্কের শক্তিকে ফোকাস করা এবং আয়নমন্ডলের প্রক্রিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ নেয়া;
আয়নমণ্ডলের ৯০ কি.মি. নিচে রেডিও ওয়েভের প্রতিফলক স্তর তৈরী করা, যা দিয়ে অনেক দূর দুরান্ত পর্যন্ত নজরদারি করা যাবে;
ভূচৌম্বকীয় গঠনের পরিবর্তনের মাধ্যমে রেডিও তরঙ্গের প্রতিফলন নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে;
প্রেরিত ইনফ্রারেড তরঙ্গ আয়নমন্ডলের ইলেকট্রন গুলোকে আরো গতিশীল করবে এবং অন্যান্য আলোক তরঙ্গ নির্গমনের মাধ্যমে রেডিও ওয়েভের চলাচলের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে। পরোক্ষভাবে তাপ দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত রেডিও ওয়েভ এর চলাচলের ওপর প্রভাব ফেলা যা আয়নমন্ডলের নিয়ন্ত্রণের সামরিক উদ্দেশ্যকে সম্প্রসারিত করে।
হার্প সম্পর্কিত কিছু ঘটনাবলী:
যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া পরস্পর পরস্পরকে এ নিয়ে অভিযোগ করেছে। ১৯৯৭ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী উইলিয়াম কোহেন রাশিয়াকে ইঙ্গিত করে একবার বিশ্ব ইকো টেরোরিজমের বিপদ সম্পর্কে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন,
‘এ ধরনের ইকো সন্ত্রাসীরা উচ্চপ্রযুক্তির যন্ত্রের মাধ্যমে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ পাঠিয়ে আবহাওয়া পরিবর্তন, ভূমিকম্প সৃষ্টি বা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটাতে পারে।’
তবে হার্পের ভয়াবহতার দিকে লক্ষ্য রেখে আমেরিকা এবং রাশিয়া উভয় পরাশক্তিই এই বিষয়টাকে কখনো লাইম লাইটে আসতে দেয়নি। তবে মাঝে মধ্যেই স্লিপ অফ টাং হিসাবে ঐ দু’দেশের অথরিটির মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছে এর কথা।
২০০২ সালে জর্জিয়ার গ্রিন পার্টির নেতা দেশটিতে কৃত্রিম ভূমিকম্প সৃষ্টির জন্য রাশিয়াকে অভিযুক্ত করেন। তেমনি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ঘটে যাওয়া প্রলয়ংকরী সুনামির জন্য রাশিয়াও একই অভিযোগ এনেছিল আমেরিকার উপর। হাইতিতে ভূমিকম্পের পর পরই ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ অভিযোগ করেন, আমেরিকা হাইতিতে টেকটোনিক ওয়েপন বা ভূকম্পন অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে। ওই পরীক্ষার ফলে হাইতির পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের কবলে পড়ে সৃষ্টি হয় রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প।
তিনি আরো বলেন, এই অস্ত্র দূরবর্তী কোনো স্থানের পরিবেশের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। পরিবেশকে ধ্বংস করে দিতে পারে। শক্তিশালী বিদ্যুৎ চৌম্বকীয় তরঙ্গ সৃষ্টির মাধ্যমে ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে বা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটাতে পারে। শ্যাভেজ আমেরিকাকে এই ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প অস্ত্র প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। হাইতির ঘটনায় প্রায় এক লাখ ১০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে ৩০ লাখেরও বেশি লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
কয়েকটি সূত্রে দাবি করা হয়, এ ধরনের অপর এক অস্ত্র পরীক্ষায় চীনের সিচুয়ান প্রদেশে ২০০৮ সালের ১২ মে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয়। এছাড়া রাশিয়া ২০০২ সালের মার্চে আফগানিস্তানে অনুরূপ এক পরীক্ষা চালিয়ে ৭ দশমিক ২ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করে।
তুরস্ক সিরিয়ার ভুমিকম্পের সাথে হার্প প্রকল্পের কোন সম্পর্ক আছে কি?
অনুসন্ধানী বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ওয়েবসাইটে ২০২৩ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি ‘Fact Check Earthquake in Turley was not a HAARP Operation’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা, ফেয়ার ব্যাংকসের ওয়েবসাইট সূত্রে জানায় হার্প প্রকল্পের মাধ্যমে আবহাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। পাশাপাশি প্রতিবেদনটিতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড হাইসেলকে উদ্ধৃত করে বলা হয, হার্প হল একটি রেডিও ট্রান্সমিটার যা অন্যান্য রেডিও ট্রান্সমিটারের চেয়ে বড় এবং তাত্ত্বিকভাবে হার্পের পক্ষে ভূমিকম্প তৈরি করা সম্ভব নয়।
কলোরাডো বোল্ডার বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি ফর অ্যাটমসফেয়ারিক এন্ড স্পেস ফিজিক্স (এলএএসপি) এর বিজ্ঞানী ডেভিড মালাস্পিনাকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানায়, হার্প যে ধরনের রেডিও তরঙ্গ তৈরি করে তা ভূমিতে এক সেন্টিমিটার এরও কম প্রবেশ করে। অপরদিকে ভূমিকম্পের গভীরতা অনেক বেশি হয় যেমন তুরস্কের ২০২৩ সালের ভূমিকম্পের উৎপত্তি হয়েছে ভূমি থেকে ১৭ কিলোমিটার নিচে। পাশাপাশি অনুসন্ধানে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে ভূমিকম্প সৃষ্টির পক্ষে কোন তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এবারই প্রথম নয়, ইতোপূর্বেও তুরস্কের ভূমিকম্পের সঙ্গে হার্পের সম্পর্ক আছে দাবিতে বিভিন্ন সময় ষড়যন্ত্র মূলক তথ্য ছড়ানো হয়েছে। যেমন ১৯৯৯ সালে দেশটির গোলক (Goluk) অঞ্চলে সংঘটিত ভূমিকম্পের জন্যও হার্পকে দায়ী করা হয়।
– হাজ্জাজ মিন সাগর
তথ্যসূত্র: হার্প.আলাস্কা, হার্প টেকনোলজি