“আমি যতই পড়ি ততই তৃপ্তি পাই“-কথাটি বলেছিলেন অ্যাডা লাভলেস!
যিনি ছিলেন বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রামার। তিনি ১৮১৫ সালের ১o ডিসেম্বর লন্ডনে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। বিখ্যাত কবি লর্ড বায়রন ছিলেন তার বাবা। কিন্তু অ্যাডার বয়স যখন মাত্র ৪ মাস, তখন তার বাবা তাকে এবং তার মা লেডি বায়রনকে ছেড়ে গ্রিসে চলে যান। এরপর আর কখনো তার বাবার সাথে দেখা হয় নি। ১৮২৩ সালে লর্ড বায়রন গ্রিসেই মারা যান। অ্যাডার মা লেডি বায়রন একাই তাকে বড় করে তোলেন।
ছোট থেকেই অ্যাডা অসুস্থতায় ভুগতেন। তার প্রচন্ড মাথাব্যথা এবং দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা ছিল। ১৮২৯ সাল থেকেই তিনি হাম এবং পক্ষাঘাতগ্রস্থতায় ভুগছিলেন। কিন্তু ক্রাচে ভর দিয়েই শিক্ষা চালিয়ে গেছিলেন তিনি। তার মা বাসায় গৃহশিক্ষক রেখেছিলেন যারা অ্যাডাকে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ও যুক্তিবিদ ডি মরগান, স্যার চার্লস ডিকেন্স, স্যার চার্লস হুইস্টোন এবং মাইকেল ফ্যারাডেও তার শিক্ষক ছিলেন।
তার মার একদম ইচ্ছে ছিল না, তার মেয়ে বাবার স্বভাব গ্রহণ করুক। তাই ছোট থেকেই মেয়েকে সঙ্গীত এবং গণিতে ব্যস্ত রাখেন। তার মায়ের প্রচেষ্টা বৃথা যায় নি। তার গণিত প্রতিভা বিচ্ছুরিত হয়েছিল উজ্জ্বল আলোক রশ্মির মতো। নিজেকে দার্শনিক হিসেবে পরিচয় দিতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।মানুষ তার গণিত প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ‘পয়েটিক্যাল সায়েন্স’ বলে ডাকতো।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি ‘ফ্লাইয়িং মেশিনের’ নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। ১৮৩৩ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের লুকেসিয়ান অধ্যাপক চার্লস ব্যাবজ তাকে গবেষণার কাজে সহযোগী হিসেবে পাওয়ার জন্য তাকে এবং তার মা’কে নিমন্ত্রণ জানান তার আবিষ্কৃত ‘ডিফারেন্স ইঞ্জিন’ দেখার জন্য, মূলত এটিই ছিল অ্যাডার সাফল্য এর হাতেখড়ি।
আধুনিক কম্পিউটার আবিষ্কারের প্রায় ১oo বছর পূর্বেই অ্যাডা এমন একটি মডেল নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন যেটি বলে দিবে মানুষের মাথায় কিভাবে যুক্তির উৎপত্তি হয় এবং চিন্তা ভাবনার জন্ম হয়। ব্যাবেজ তার গণিত প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে ‘নাম্বার সেট জাদুকর’ বলে ডাকতেন। বিভিন্ন যন্ত্রের কলাকৌশল বোঝার জন্য অ্যাডা কারখানায় ঘুরতেন। একদিন হঠাৎ ‘জাকার্ড লুম’ নামক বস্ত্র বুনন যন্ত্র দেখে তিনি ভাবলেন ‘মেশিন কোড’ তৈরি করাও সম্ভব!
চিত্রঃ জাকার্ড লুম
১৮৩৫ সালে উইলিয়াম কিং কে বিয়ে করেন অ্যাডা বায়রন। বিয়ের পরে তার নামের বায়রন প্রতিস্থাপিত হয় লাভলেস দ্বারা। ১৮৩৬ –১৮৩৯ সালের মধ্যে তার গর্ভে আসে ৩ টি সন্তান। সেই সময় সন্তানদের দেখা শোনার জন্য তিনি কিছু সময় গাণিতিক জগতের বাহিরে ছিলেন। কিন্তু ডিফারেন্স ইঞ্জিনের প্রতি আগ্রহ তখনও প্রবল। এই ইঞ্জিনের মূল উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন সংখ্যার ঘাত গণনা করা অর্থাৎ কোনো সংখ্যাকে সেই সংখ্যা দ্বারা গুণ করলে যে ফল হয় তা বের করা।
চিত্রঃ ডিফারেন্স ইঞ্জিন
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, ব্যাবেজ এই যন্ত্র তৈরি করার সময় আরেকটি নতুন যন্ত্র তৈরির স্বপ্ন দেখেছিলেন। তিনি ১৮৪১ সালে ডিফারেন্স ইঞ্জিনের চেয়ে অধিকতর উন্নত আধুনিক এবং জটিল কম্পিউটার অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের ধারণা উপস্থাপন করেন। কিন্তু পরিকল্পনা করতে গিয়ে তিনি কিছু সমস্যার সম্মুখীন হন।তিনি বুঝতে পারছিলেন না কিভাবে কোন পদ্ধতিতে অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের গাণিতিক হিসাব করবেন। তখন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন অ্যাডা লাভলেস। অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন সেই সময়ে মানুষের কাছে বোধগম্য ছিল না।
তাই ব্যাবেজ তাকে ফরাসি ভাষায় লেখা ইতালিয় গণিতবিদ লুইজি মেনাব্রেয়ারের ‘অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন’ বইটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করতে বলেন। অ্যাডা মাত্র ৯ মাসে বইটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। তার অনুবাদ এতই বেশি প্রাণোজ্জ্বল হয় যে ব্যাবেজ তাকে তার নিজস্ব একটি বই লেখার জন্য অনুপ্রেরণা দেন। ব্যাবেজের অনুপ্রেরণা বৃথা যায় নি, মাত্র ২ বছরের মধ্যে বইটির ২য় সংস্করণ বের করেন অ্যাডা। যেখানে তিনি মূল বইয়ের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি গাণিতিক নোট যুক্ত করেন।
চিত্রঃ অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন
‘দ্য স্কেচ অব চার্লস ব্যাবেজ‘স অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন‘ বইটি অ্যাডা লাভলেস রচনা করেন। তিনি ১৮৪o –১৮৫o সাল পর্যন্ত দীর্ঘ এক দশক বিভিন্ন বিজ্ঞানী এবং প্রকৌশলীর সাথে কাজ করেন।
অন্যদিকে, একদিন হঠাৎ ব্যাবেজ বাইনারি সংখ্যার জটিল গাণিতিক সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হন। অ্যাডা এই সমস্যার সমাধান করেন। বাইনারি সংখ্যার সমাধান করার মাধ্যমে অ্যাডা পৃথিবীর প্রথম কম্পিউটার প্রোগ্রাম অ্যালগরিদম রচনা করেন। তাই তাকে বিশ্বের প্রথম ‘কম্পিউটার প্রোগ্রামার’ বলা হয়।
আধুনিক কম্পিউটার আবিষ্কারে ব্যাবেজের পাশাপাশি অ্যাডার ভূমিকা ও অপরিসীম। অ্যালগরিদম রচনা করে অ্যাডা লাভলেস অনুধাবন করেন যে, অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিন কেবল যন্ত্র হিসেবে নয়, ব্যবহৃত হবে আরও অনেক কাজে। তিনি তার নোটে লিখেছিলেন “যেকোনো বিষয় যেমন –গান,ছবি প্রভৃতিকে যদি সংখ্যায় পরিণত করার উপায় বের করা যায়, তাহলে কম্পিউটারের মাধ্যমে তার পরিবর্তন করা সম্ভব“!
এগুলো পড়তে ভুলবেন না ! ব্যাকটেরিয়াতত্ত্বের স্বর্ণযুগ : রবার্ট কচ এর গল্প (১ম পর্ব) |
অ্যালগদিরম রচনার পরে অ্যাডা লাভলেস ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেশ কয়েক বছর জরায়ুর ক্যান্সারে ভোগেন। যেহেতু তখন চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুন্নত ছিল তাই সঠিকভাবে তার রোগ নির্ণয় সম্ভব হয় নি। তার অবস্থা প্রতিনিয়ত অবনতির দিকে যাচ্ছিল, তাই চিকিৎসকরা অবশেষে তার উপর গ্যালেনের ‘রক্তক্ষরণ‘ পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। এতে করে তার মৃত্যু আরও ঘনিয়ে এসেছিল!১৮৫২ সালের ২৭ নভেম্বর মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পরে তার ইচ্ছে অনুযায়ী নডিংহামের সেন্ট ম্যারি মাগদালিন চার্চে তার বাবার পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।
অ্যাডা লাভলেসকে মর্যাদা দিয়ে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বিভাগের একটি প্রোগ্রামিং ভাষার নাম রাখা হয় ‘Ada‘!
তাকে নিয়ে ‘Conceiving Ada‘ নামে একটি চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। Microsoft এর প্রোডাক্ট ‘Authenticity’ হলোগ্রামে তার ছবি দেওয়া আছে। কম্পিউটিং এবং প্রোগ্রামিং এ বিশেষ অবদানের জন্য ২৪ মার্চকে ‘Ada Lovelace’ দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়।