আচ্ছা! আমি যদি শিক্ষিত শ্রেণির কয়েকজনকে হুট জিজ্ঞেস করি The Ultimate Fate of The Universe বইটির লেখক কে? বেশিরভাগই বলতে পারবেন না। এবার বইয়ের নামটা বদল করে ফেলি।
A Brief History of Time বইটির লেখক কে? তখন সেটি পানির মতো সহজ হয়ে যাবে। আরে! এ তো সহজ প্রশ্ন। স্টিফেন হকিং এর লেখা বই। মহাবিশ্বের উপর তথ্যবহুল বিখ্যাত একটি বই।
প্রথমোক্ত বইটির লেখক আমাদের এই বাংলাদেশেরই কৃতি বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম। জি হ্যাঁ। আমাদের গর্ব J.N. Islam. মহাবিশ্বকে নিয়ে স্টিফেন হকিংয়ের চাইতেও অনেক বেশি গবেষণাধর্মী তাঁর এই বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে।
স্টিফেন হকিং এর প্রথম বই প্রকাশেরও পাঁচ বছর আগে তিনি বইটা লেখেন। এই বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মনেপ্রাণে দেশকে ভালোবাসতেন, চাইতেন দেশের অগ্রগতি। আর তাইতো বিদেশের মাটিতে অনেক লোভনীয় প্রস্তাব আর সুযোগসুবিধা থাকা সত্ত্বেও ফিরে এসেছিলেন নিজ জন্মভূমিতে।
১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহে জন্ম জামাল নজরুল ইসলামের। বাবা মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম, মাতা রাহাত আরা বেগম। জন্ম ঝিনাইদহে হলেও পৈত্রিক ঠিকানা চট্টগ্রামে। চাকরিসূত্রে বাবা ঝিনাইদহ অবস্থান করছিলেন বলে জন্মস্থান হয়েছে সেখানে। একজন অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম।
কিন্তু সেই আভিজাত্যের বড়াই স্পর্শ করতে পারেনি মহৎ এই মানুষটিকে। ঢাকার নবাব বাড়ির পাশাপাশি তাঁর পরিবারের যোগাযোগ ছিল জর্ডানের বাদশার পরিবারের সাথে। জামাল নজরুল ইসলামরা ছিলেন চার ভাই চার বোন। মাত্র দশ বছর বয়সে মা হারা হন অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম।
শৈশবে কলকাতার একটি স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন জামাল নজরুল ইসলাম। সেখান থেকে পরে আসেন চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তির সময় তার মেধা দেখে অভিভূত হন প্রধান শিক্ষক। মেধায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ডাবল প্রমোশন দিয়ে তুলে দেন ষষ্ঠ শ্রেণীতে। এখানে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ে চলে যান পাকিস্তানের লরেন্স কলেজে।
লরেন্স কলেজ থেকে এ লেভেল এবং ও লেভেল সম্পন্ন করে ভর্তি হন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বি.এসসি অনার্স সম্পন্ন করেন। তারপর চলে যান লন্ডনের বিশ্ববিখ্যাত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে কৃতিত্বের সাক্ষর রেখে ১৯৬৪ সালে ‘এপ্লায়েড ম্যাথম্যাটিকস এন্ড থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স’-এর উপর পিএইচ.ডি সম্পন্ন করেন তিনি।
১৯৫৭ সালে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি (অনার্স) সম্পন্ন করেন। অনার্স শেষ করার পর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ট্রিনিটি কলেজে গণিতশাস্ত্রে ট্রাইপস করতে যান। সাধারণত এটা তিন বছরের কোর্স। কিন্তু তিনি মাত্র দুই বছরে এটি শেষ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। ১৯৬০ সালে সম্পন্ন করেন মাস্টার্স। সেখানে উনার সহপাঠী ছিলেন পরবর্তীকালে ভারতের বিখ্যাত গণিতবিদ জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকার।
আরেক সহপাঠী ছিলেন ব্রায়ান জোসেফসন। যিনি উনার পিএইচডি থিসিসের জন্য মাত্র ৩৩ বছর বয়সে নোবেল পুরস্কার পান। ১৯৯৮ সালে রসায়নে নোবেল পান জন পোপল। তিনি ছিলেন কেমব্রিজে জামাল নজরুল ইসলামের শিক্ষক। এমনি এক পরিমণ্ডল থেকে উঠে এসেছিলেন জামাল নজরুল ইসলাম।
বিজ্ঞানে খুব উঁচু মানের পারদর্শিতা দেখালে কিংবা খুব বড় ধরনের প্রভাব ও অবদান রাখলে ডক্টর অব সায়েন্স (ডি.এসসি) প্রদান করা হয়। এ ধরনের ব্যক্তিরা হলেন শিক্ষকদের শিক্ষক, সেরাদের সেরা। আমাদের জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৮২ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডি.এসসি ডিগ্রিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
জামাল নজরুল ইসলামের পিএইচডি গবেষণার বিষয়বস্তু ছিলো পার্টিকেল ফিজিক্স। এরপর তিনি আইনস্টাইনের জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। পরবর্তীকালে এর সঙ্গে যুক্ত হয় কসমলোজি। এক সাক্ষাৎকারে এই বিজ্ঞানী বলেন, এই তিনটিই ছিলো উনার আগ্রহ ও কাজের মূল ক্ষেত্র। পরে অবশ্য তিনি ফ্লুইড ডায়নামিক্স বা তরল গতিবিদ্যা নিয়েও কাজ করেছেন।
‘দ্য স্কাই এন্ড টেলিস্কোপ’ ম্যাগাজিনে জামাল নজরুল ইসলাম একবার একটি প্রবন্ধ লিখেন। প্রবন্ধটির বিষয়বস্তু ছিলো মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি। মূলত এই প্রবন্ধ ছিলো The Ultimate Fate of The Universe বইয়ের একপ্রকার সারমর্ম। বইটি ১৯৮৩ সালে ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। এটিই ছিলো তাঁর প্রকাশিত প্রথম বই। অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস তাদের মানসম্মত প্রকাশনার জন্য বিখ্যাত। এজন্য প্রথম বই প্রকাশের পরপরই সাড়া ফেলে দেন অধ্যাপক ইসলাম। এই বইটি তাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি ও গ্রহণযোগ্যতা এনে দেয়। পরবর্তীতে এটি বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়।
এই বইয়ের Preface এ তিনি লিখেন, “In 1977 I wrote a short technical paper entitled ‘Possible ultimate fate of the universe’ which was published in the Quarterly Journal of the Royal Astronomical Society. A number of colleagues found this paper amusing. Just then, Weinberg’s excellent book The first three minutes appeared and it occurred to me that it would be interesting to have a book about the end of the universe. Soon I was requested by the astronomical magazine Sky and Telescope to write a popular version of my paper for them….”
(১৯৭৭ সালে আমি “Possible ultimate fate of the universe” শিরোনামে একটি সংক্ষিপ্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র লিখেছিলাম। যেটি Quarterly Journal of the Royal Astronomical Society তে প্রকাশিত হয়েছিল। আমার কিছু সহকর্মীর নিকট গবেষণাপত্রটি বেশ চমৎকার বলে মনে হয়েছে। এর পরপরই প্রকাশিত হয় ওয়াইনবার্গের সাড়া জাগানো বই The first three minutes. এটি থেকে আমার মধ্যে ধারণা এলো যে, মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি নিয়ে একটি বই লিখলে এটা বেশ আগ্রহের বিষয় হবে।
খুব শীঘ্রই জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক ম্যাগাজিন স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ থেকে আমাকে একটি অনুরোধ করা হয়, যেনো মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে আমার গবেষণাপত্রটি সকলের উপযোগী করে আমি লিখে দেই তাদের জন্য।…)
এগুলা পড়তে ভুলবেন না !! |
১৯৭৯ সালে প্রকাশিত এই প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিলো The Ultimate Fate of The Universe. যেটি সর্বমহলে সমাদৃত হয়। আর এরই ফলস্বরূপ ১৯৮৩ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ বই হিসেবে প্রকাশিত হয় অধ্যাপক জে এন ইসলামের বিখ্যাত লেখনি। (চলবে…)
সোর্স:
1) https://roar.media/bangla/main/science/jamal-nazrul-islam-a-great-scientist-of-bangladesh/amp 2) https://www.prothomalo.com/amp/story/opinion/column/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%9E%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%80-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%A8%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%87%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE3) https://arts.bdnews24.com/?p=346&fbclid=IwAR2VTE8sWPHLhjqRJvoULbfQvvuNykKW9FL_sTmaEArZtUfGneC4EU-gyz8