জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা এবং পুষ্টির চাহিদা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বিবেচনা করে এটা অন্তত আন্দাজ করা যায় যে ভবিষ্যতে আমাদের আরো অধিক খাদ্যের প্রয়োজন হবে। প্রচলিত প্রজনন পদ্ধতি ও জেনেটিক পরিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভিদকে কীটপতঙ্গ এবং খরার মতো পরিবেশগত বিপর্যয় হতে প্রতিরোধ করার জন্য বিজ্ঞানীরা দীর্ঘকাল ধরেই গবেষণা করে আসছেন।
তবে উদ্ভিদ কীভাবে উক্ত বিপর্যয়সমূহ অতিক্রম করে পরিবেশের সাথে সহজেই নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারবে তা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনো ধোঁয়াশাই রয়ে গিয়েছে।
জার্মানির ইনস্টিটিউট অব নেটওয়ার্ক বায়োলজি (আইএনবি)-এর গবেষকরা এ ব্যাপারে সম্ভাব্য একটা ধারণা প্রকাশ করেছেন। জুলাইয়ের প্রথমদিকেই তারা এনভায়রনমেন্টাল একটি থিসিস প্রকাশ করেন যেখানে ধারণা করা হয় যে, উদ্ভিদরা সাধারণত আরো জটিল কিছু উপায়ে পরিবেশের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নেয়, যার মধ্যে অন্যতম হলো উদ্ভিদের হরমোনাল ব্যাবস্থা।
অনুসন্ধানটিতে জানা গিয়েছে, এক প্রজাতির উদ্ভিদ হরমোনের সাহচর্যে প্রায় দু’হাজারেরও বেশি প্রোটিন কর্তৃক তাদের দেহের ইনফরমেশন প্রসেসিং নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রন করে, যার মধ্যে প্রায় শতাধিক প্রোটিনই আমাদের কাছে অপরিচিত। এ ব্যাপারে টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানী শেলি লুম্বা জানান,”আমাদের নতুন করে উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণার ব্যাপারে ভাবতে হবে।” যদিও তিনি আইএনবির উক্ত গবেষণায় যুক্ত ছিলেন না; তবুও তিনি উল্লেখ করেন,”ভিন্ন মাত্রায় গবেষণা করলে নতুন কিছু সম্ভাবনার দ্বার অবশ্যই উন্মোচিত হবে।”
সাধারণত উদ্ভিদদেহের সেন্সরি প্রোটিনগুলো জলবায়ুর বিভিন্ন পরিবর্তন সনাক্ত করে এবং পরবর্তীতে তারা পরিবেশের সাথে নিজেদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা হরমোনের মাধ্যমেই সম্পাদন করে। উদাহরণস্বরূপ, এবিএ(অ্যাবসিসিক এসিড-C15H20O4) হরমোন উদ্ভিদগাত্রের বিভিন্ন পোর বা ছিদ্রপথ বন্ধ করতে নির্দেশ প্রদান করে যাতে খরার সময় তাদের দেহে জলের অভাব না হয়।
উদ্ভিদের এই হরমোন সিস্টেম আমাদের নিকট কিছুটা জটিল ঠেকলেও উদ্ভিদরা ঠিকই এই পদ্ধতিতে খুব সহজেই পরিবেশের সাথে বিভিন্ন বৈশ্বিক বিপর্যয়ের মধ্যেও নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। এছাড়াও, বর্তমানে বিভিন্ন জেনেটিক্যালি মোডিফাইড ফসল যেমন: বিভিন্ন জাতের গম, ভুট্টা, চাল ইত্যাদি ব্যাকটেরিয়া থেকে উদ্ভাবিত জিন ঐসকল উদ্ভিদের জিনোম সিকোয়েন্সে যুক্ত করেই উৎপাদন করা হয়।
ফলে জিনোমে নতুন বৈশিষ্ট্যমন্ডিত জিন যুক্ত করার মাধ্যমে উদ্ভিদ হরমোনাল সিস্টেমের মতোই পরিবেশের সাথে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে আরো এক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে।
পরিবেশে সৃষ্ট বিভিন্ন বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই বিজ্ঞানীরা মাঠপর্যায়ের ফসলের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবেই জিনগত বৈচিত্রের দরুন প্রজনন ব্যাবস্থা আনয়নে তৎপর হয়ে উঠেছেন। উদাহরণস্বরূপ, বিজ্ঞানীরা গমের এমন কিছু জাত উদ্ভাবন করেছেন যা প্রাকৃতিকভাবেই এবিএ হরমোন তৈরি করবে।
যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই ধরণের প্রজনন ব্যবস্থা সৃষ্টি ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ক্রিসপার ক্যাস-9(The Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Repeats-associated Protein 9) সহ নতুন কিছু জিনোম প্রযুক্তি জেনেটিক মোডিফিকেশনকে তুলনামূলক সহজ করে দিয়েছে। পৃথক পৃথক জিন নিয়ে গবেষণা করার চাইতে উদ্ভিদের পুরো জিনোম সিকোয়েন্স নিয়ে গবেষণা করলে তাদের অনেক রহস্যই উন্মোচিত হবে।
এ ব্যাপারে ক্যানাডিয়ান জিনোম সায়েন্টিস্ট থমাস হাডসন বলেন,”উদ্ভিদ শারীরবিদ্যার ব্যাপারে অনেক কিছুই আমাদের কাছে এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে।” যদিও আমরা এখনো ভাবি উদ্ভিদের অনেক রহস্যই বুঝি আমাদের নিকট আর অজানা নেই, সব রহস্যের সমাধান হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে উদ্ভিদের শারীরবৃত্তীয় অনেক কিছুই আমাদের চিন্তাভাবনারও বাইরে; এই যেমন হরমোনাল ব্যবস্থার কথাই বিবেচনায় আনা যাক। পূর্বে বিজ্ঞানীরা ভাবতেন হরমোনাল ব্যবস্থা শুধু প্রাণীদেহেই বিদ্যমান, কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলেও সত্যি যে উদ্ভিদের দেহেও পরিবেশের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখতে হরমোনাল ব্যাবস্থা রয়েছে।
হাডসন আরো বলেন, “জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশের সাথে উদ্ভিদের সামঞ্জস্যতা এবং এদের পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া হরমোনের সাহচর্যে কিভাবে ঘটে থাকে তা নিয়ে গবেষণা করলে হয়তো বা আমরা উদ্ভিদ শারীরবিদ্যার ব্যাপারে আরো কিছু রহস্যের দ্বার উন্মোচন করতে পারবো।” এব্যপারে বিজ্ঞানী লুম্বা আরো ব্যাক্ত করেন,”আমার মতে হরমোন ব্যাবস্থা মূলত উদ্ভিদকে পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতেই উত্তরোত্তর সাহায্য করে।”
যেসকল বন্য অঞ্চলের গাছপালা আগুনে পুড়ে যায়, বিজ্ঞানী লুম্বা সাধারণত সেই অঞ্চলে জন্মানো নব্য উদ্ভিদের বিকাশ ও শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া নিয়েই গবেষণা করে থাকেন। বন্য অঞ্চলের ঐ সকল উদ্ভিদ মূলত অক্সিন নামক হরমোন ক্ষরণ করে যা বন্য অঞ্চলটি পুড়ে যাবার পর একই জাতের উদ্ভিদের নতুন করে অঙ্কুরোদগমে সাহায্য করে। যেহেতু প্রায় সমস্ত উদ্ভিদেই অক্সিন হরমোন রয়েছে, পাশাপাশি বিভিন্ন স্মোক বা ধোঁয়া সংবেদনশীল প্রোটিনও রয়েছে, তবুও ঐসকল উদ্ভিদের মধ্যে কেন বেশিরভাগই উপযুক্ত সময়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না তা আজও অজানা।
মাঠপর্যায়ের ফসলসমূহ যেন খুব দ্রুতই যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে তার প্রচেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে বিজ্ঞানীরা সিগন্যালিং মেকানিজমের মাধ্যমে বাঁধাকপি এবং সরিষার ফুলের জিনোম(Arabidopsis) নিয়ে গবেষণা করছেন। অ্যারাবিডোপসিস অনেক ভালো বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জিন। তবে ভুট্টা বা চালের বিভিন্ন উন্নত জাত উদ্ভাবনে এবং এধরনের ফসলে প্রোটিনের মিথস্ক্রিয়া নিয়ে আরো গবেষণা করতে বহু বছর লেগে যেতে পারে।
হাডসন বলেন,”আমরা বিভিন্ন ট্রান্সজেনিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন জিন নিয়ে গবেষণা করেছি যা দ্বারা আমরা ফসলের বহু উন্নত জাত উদ্ভাবন করতে পারব, কিন্তু আমরা প্রকৃতপক্ষে ফসলের জাতটিকে পরিবেশের সাথে সহজে খাপ খাইয়ে নেবার ব্যাপারে তেমন কোনো গবেষণাই করছি না।”
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!! মনের অজানা রহস্যঃ হ্যালুসিনেশন! (পর্ব-১) |
অবশ্য পরবর্তীতে বিজ্ঞানী হাডসন এবং ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সহকর্মীরা কম্পিউটার অ্যালগরিদম ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে উদ্ভিদের নিজস্ব জিনগুলো কিভাবে দৈহিক বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন। হয়ত এ পদ্ধতিটি ফলপ্রসূ হলে আখরোট গাছের মত বেশ কিছু প্রজাতি বিভিন্ন বিপর্যয়ের মধ্যেও তাদের দৈহিক বৃদ্ধি বজায় রাখতে পারবে এবং বিভিন্ন পরজীবী ছত্রাকের আক্রমণ সত্ত্বেও বেঁচে থাকবে।
রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানী বিংরু হুয়াং গল্ফ খেলার জন্য উপযুক্ত ঘাসের জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে হরমোন সিগন্যালিং নিয়ে গবেষণা করেন। উক্ত গবেষণায় তিনি নমুনা ঘাসে সাইটোকাইনিন নামক হরমোনের পরিমাণ বাড়িয়ে গাছগুলিকে পরিবেশের প্রতি আরও সংবেদনশীল করে তোলেন, ফলশ্রুতিতে ঘাসগুলো আরো তাপ এবং নোনতা মাটি সহনীয় হয়ে উঠেছে। হুয়াং ব্যাক্ত করেন,”উদ্ভিদের হরমোনাল সিস্টেম বোঝা আসলেই কঠিন একটা বিষয়। তবে উল্লেখ্য যে, আপনি জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে একটি হরমোনের অবস্থা পরিবর্তন করলে অন্যরাও প্রভাবিত হবে।”
তথ্যসুত্রঃ সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান, উইকিপিডিয়া, প্ল্যান্ট বায়োলজি।