ডার্ক ম্যাটার পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে এখনো সবচেয়ে বড় রহস্য। সেই রহস্যের আবরণ কিছুটা হলেও কি খুলছে? সাম্প্রতিক এক গবেষণা সে কথাই বলছে। গত বছর এনজিসি ১০৫২-ডিএফ৪নামের এই গ্যালাক্সির সন্ধান পান বিজ্ঞানীরা, যেখানে ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ ছিল বিস্ময়করভাবে খুব কম! এটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ এত কম হলে গোটা মহাবিশ্বের হিসাবেই গর্বর হয়ে যায়।
- গ্যালাক্সিটিতে ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে কম কেন? আর এর জন্য পার্শ্ববর্তী অন্য একটি গ্যালাক্সিকে দায়ী মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। সেই গ্যালাক্সিই ১০৫২-ডিএফ৪ গ্যালাক্সি থেকে ডার্ক ম্যাটার টেনে নিচ্ছে নিজের থেকে।
আর এ গবেষণা করেছেন মিরিয়া মন্টিসের নেতৃত্বাধীন অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্পেস টেলিস্কোপ সায়েন্স ইন্সটিটিউটের একদল জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী। সেটা ১০৫২-ডিএফ৪ হলো,এ ধরনের দ্বিতীয় গ্যালাক্সি। অন্যটির নাম ১০৫২-ডিএফ২। - ম্যাটারের উপস্থিতি খুবই জরুরি। ডার্ক ম্যাটার আসলে কি দিয়ে তৈরী তা এখনো জানা যায়নি এবং সরাসরি শনাক্তও করা যায়নি। তবে ছায়াপথগুলোয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি মহাকর্ষ বলের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এই মহাকর্ষ বলের উৎস কী? এ ব্যাপারটাই আসলে ডার্ক ম্যাটার বা গুপ্তবস্তুর আভাস দেয়।সরাসরি শনাক্ত করা না গেলেও বর্তমানে মহাবিশ্বের যে মডেল, ছায়াপথের যে জন্মপ্রক্রিয়া, তাতে ডার্ক ম্যাটার ছাড়া হিসাব মেলানো কঠিন।গবেষক দলটি প্রথম আবিষ্কারের পর ডিএফ২ এর অবস্থান যত দূরে মনে করেছিলেন, পরে দেখা যায় এর দূরত্ব তার চেয়ে অনেক কম। দূরত্বের হিসাবটা বিজ্ঞানীরা কষেছিলেন এর মহাকর্ষ বলের প্রভাব থেকে। মহাকর্ষ বল কম বলে তারা মনে করেছিলেন এর দূরত্ব অনেক বেশি।তারপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন এর দূরত্ব অত বেশি নয়। তাহলে মহাকর্ষ বল এত দূর্বল কেন? কারণ, এর ভর। আসলে ভর কম বলেই মহাকর্ষ বল কম,দূরত্বের কারণে নয়।কিন্তু ভর এত কম হওয়ার কারণ একটাই হতে পারে, যদি এতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ডার্ক ম্যাটার না থাকে।
এরপর এ ধরনের দ্বিতীয় গ্যালাক্সিটার হদিস মেলে। সেটা হলো ডিএফ৪। এরও একই অবস্থা। তখন বিজ্ঞানীরা আরও গভীর অনুসন্ধানে নামলেন। পাওয়া গেল কারণ কাছাকাছি থাকা আরেকটা গ্যালাক্সি এই গ্যালাক্সি থেকে ডার্ক ম্যাটার টেনে নিচ্ছে নিজের দিকে। ফলে ডিএফ৪ থেকে কমে যাচ্ছে ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ। তাই কমছে মহাকর্ষ বল। - কম মহাকর্ষ বলের এ ধরনের গ্যালাক্সি নিয়ে গবেষণা করা খুব কঠিন। মন্টেস এবং তার সহকর্মীরা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন। IAC80 টেলিস্কোপ,গ্রান টেলিস্কোপিও ক্যানারিয়াস এবং হাবল স্পেস টেলিস্কোপ ব্যবহার করে তারা শনাক্ত করেন, বৃহত্তর সর্পিল আকৃতির গ্যালাক্সি এনজিসি-১০৩৫ ডার্ক ম্যাটার চুরি করছে -ডিএফ৪ ছায়াপথ থেকে। এ ধরনের ঘটনায় বড় আকারের গ্যালাক্সিতে মহাকর্ষীয় বাধা সৃষ্টি হয়,যা জোয়ার বাধা (Tidal Disruption) নামে পরিচিত।
- মন্টেস বলেন, প্রাথমিক গবেষণায় দেখা যায়,গ্যালাক্সিটি খুব স্বাভাবিক আছে।এর মানে,বাইরের কোনো শক্তি এটাকে বিচলিত করছে না। কিন্তু আরও বিস্তৃত গবেষণায় দেখা যায়,এই গ্যালাক্সি আসলে তার প্রতিবেশী ছায়াপথ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে।
- যেহেতু ডার্ক ম্যাটার একটি বিশাল এলাকাজুড়ে গ্যালাক্সিকে ঘিরে থাকে,তাই এই জোড়বাঁধা নক্ষত্রগুলোকে প্রভাবিত করার আগে ছোট ছায়াপথের বেশিরভাগ ডার্ক ম্যাটার সরিয়ে ফেলবেন বলে উল্লেখ করেন মন্টেস। যখন ডার্ক ম্যাটারের পরিমাণ কোনো ছায়াপথের মোট ভরের ১০-১৫ শতাংশের নিচে নেমে যায়,তখনই নক্ষত্রগুলো অপসারিত হতে শুরু করে।
- ইন্সটিটিউটো ডি অ্যাস্ট্রোফিজিকা ডি কানারিয়াসের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী ইগনাসিও ট্রুজিলো বলেন, সময়ের সঙ্গে এনজিসি১০৫২-ডিএফ৪ গ্যালাক্সিটি এনজিসি-১০৩৫ এবং এর আশেপাশের বৃহৎ গ্যালাক্সিগুলোর মহাকর্ষ বলের প্রভাবে বিলীন হয়ে যাবে এবং কিছু নক্ষত্র মহাশূন্যে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকবে।
- ডার্ক ম্যাটার রহস্যের পুরোপুরি সমাধান হয়তো এখনই হচ্ছে না। কিন্তু মহাবিশ্বের গঠন সম্পর্কে আমাদের পরিচিত মডেল নিয়ে ভাবনার রসদ জুগিয়েছে গবেষণাটি। অদূর ভবিষ্যতে অন্য সব বৈজ্ঞানিক রহস্যের মতো ডার্ক ম্যাটারও আমাদের পুরোপুরি বোধগম্য হবে,এমন আশার আলোই দেখা যাচ্ছে এই গবেষণা থেকে। আর এ বিষয়ে গবেষণাপত্রটি “দি অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল” জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।