ওজোন স্তর হলো পৃথিবীর স্ট্রাটোস্ফিয়ার এর একটি লেয়ার যা আমাদের থেকে অন্তত প্রায় ৬.২ মাইল (১০ কিলোমিটার) উপরে অবস্থিত, এবং যা সূর্যের ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মি থেকে আমাদের ত্বককে রক্ষা করে ।
আমরা যখনই অস্বাভাবিক কড়া রোদে বাইরে বের হই, তখনই আসলে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির বিকিরণের মৃদু প্রভাবগুলি অনুভূত হয়। রোদ থেকে বাঁচার জন্য আমরা সাধারণত সানস্ক্রিন ব্যবহার করি। কিন্তু ভাগ্যক্রমে , পৃথিবী তার নিজস্ব সানস্ক্রিন (ওজনলেয়ার) এর মাধ্যমে আমাদেরকে এ অতিবেগুনী রশ্মি থেকে রক্ষা করে। ওজোন স্তরটি না থাকলে আমরা কেবল মাত্রাতিরিক্ত রোদে পোড়াই অনুভব করতাম না, এমনকি মানব অস্তিত্ব ও হুমকির সম্মুখীন হয়ে যেতো ।
শুধু মানুষই নয়, অতিবেগুনি সূর্যের আলোর প্রখরতা পৃথিবীপৃষ্ঠে বাসকারী বেশিরভাগ প্রজাতির ক্ষেত্রেই হুমকিস্বরূপ।
ওজোন গ্যাস তৈরির জন্য একটি অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে অক্সিজেন গ্যাস যা আল্ট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনী আলো শোষণ করে এবং সেই আলোকে পৃথিবীর পৃষ্ঠে পৌঁছাতে বাধা দেয়। অক্সিজেন গ্যাস এবং অক্সিজেনের আরেকটি এলোট্রোপ (অক্সিজেনের আরেকটি রূপ) ওজোন স্তরে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান।
বেশিরভাগ বাস্তুসংস্থান গুলো ক্ষতিকর অতিবেগুনি (UV) আলো থেকে তাদের সুরক্ষার জন্য ওজোন স্তরের উপর নির্ভর করে । আল্ট্রাভায়োলেট বা অতিবেগুনী রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর থেকে কম, তাই মানুষ এর কাছে এ রশ্মি দৃশ্যমান নয়। তবে মৌমাছি সহ আরো কিছু কীটপতঙ্গ এ রশ্মি দেখতে পায়।
সূর্যের রশ্মির UV আলো আমাদের ত্বককে পোড়ানোর ক্ষমতা রাখে এবং রোদের মধ্যে বাইরে থাকাকালীন আমাদের নাকের কালো রং স্পট ফেলতে পারে যা freckles নামে পরিচিত। তবে এ ধরনের স্পট ত্বকে খুবই কম পরিলক্ষিত হয়।
এছাড়াও UV আলো ত্বকের ক্যান্সার এবং চোখের ছানির জন্য দ্বায়ী এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও নষ্ট করতে সক্ষম।
সাধারণত ১০% ওজোন গ্যাস আমাদের বায়ুমণ্ডল এই পাওয়া যায়। বাকি নব্বই শতাংশ ওজোন থাকে ওজোন স্তর গঠনের জন্য স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরটি একটি প্রাকৃতিক স্থাপনা সরবরাহ করে, সেখানে গ্যাসসমূহ একটি প্রতিরক্ষা মূলক স্তর গঠন করে যা পৃথিবীকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়। স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরের শুরু হয় ৬ থেকে ১১ মাইল (৯.৬ থেকে ১৭.৭ কিলোমিটার) থেকে এবং প্রায় ৩০ মাইল (৪৮.৩ কিলোমিটার) পর্যন্ত বিস্তৃত ।
ওজোন গ্যাস যখন স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে তৈরি হয় তখন সূর্যের আলো UV রশ্মি অক্সিজেন গ্যাসকে ওজোন-অক্সিজেন সাইকেল হিসেবে হিট করে ।
এই চক্রের প্রথম পর্যায়ে সূর্য থেকে স্বল্প-তরঙ্গদৈর্ঘ্য UV আলো অক্সিজেন গ্যাসের একটি অণুতে আঘাত করে , এই আলো এতটাই শক্তি সম্পন্ন থাকে যে এটি অক্সিজেন এর মধ্যে থাকা অনুগুলোর বন্ধনকে ভেঙে দেয়, ফলে দুটি অক্সিজেন পরমাণু তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে অক্সিজেন মূলত সংক্ষিপ্ত-তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের UV আলো শোষণ করে ।
দ্বিতীয় পর্যায়ে , বাকি দুটি অক্সিজেন পরমাণুর প্রত্যেকে দুটি অক্সিজেন গ্যাসের অণুতে ল্যাচ করে এবং দুটি পৃথক ওজোন অণু তৈরি করে।
স্বল্প-তরঙ্গদৈর্ঘ্য UV আলোতে ওজোন অণু গুলো বিচ্ছিন্ন করার জন্য যথেষ্ট শক্তি রয়েছে (যা অক্সিজেনের অণুর তুলনায় আরও উদ্বায়ী এবং সহজতর)। সুতরাং, চক্রের তৃতীয় পর্যায়ে ওজোন গ্যাস একটি অক্সিজেন গ্যাসের অণু এবং একটি অক্সিজেন পরমাণুতে বিভক্ত হয়, ফলে অবশিষ্ট UV আলোকের বেশিরভাগ অংশ শোষিত হয়।
আপনি যদি ভাবেন যে কেন এই প্রক্রিয়াগুলি UV আলোক শোষণ করে, তবে এর কারণ হিসেবে বলা যায়, এটি একটি বহিরাগত প্রতিক্রিয়া তৈরি করে , যা তাপ উৎপন্ন করে থাকে।মূলত, অক্সিজেন এবং ওজোন UV আলোকে উত্তাপে রূপান্তরিত করে । একসাথে ওজোন এবং অক্সিজেন গ্যাস ক্ষতিকর UV আলোর প্রায় ৯৮ শতাংশ শোষণে কার্যকর!
এখন, আমরা ওজোন স্তরের ওজোন গ্যাসের পরিমাণ পরিমাপ এবং তার বিভিন্ন উপকরণ গুলো নিয়ে আলোচনা করব ।
বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার করে বায়ুমন্ডলের উলম্ব কলামের ওজন পরিমাণ বের করতে সক্ষম হন । এর মধ্যে একটি উপকরণ হলো ওজসোনড (“সোনড” পুরানো ইংরেজি থেকে এসেছে , যার অর্থ মেসেঞ্জার), যার মধ্যে একটি বেলুন রয়েছে যা যন্ত্রটিকে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের থেকে ২১ মাইল (৩৩.৮ কিলোমিটার) উঁচুতে বহন করে।
স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের একটি ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল কনসেন্ট্রেশন সেল (ইসিসি ) ব্যবহার করে ওজোন গ্যাসের পরিমাণ পরীক্ষা করা হয়। ইসিসিতে পটাসিয়াম আয়োডাইড ব্যবহার করা হয় , যা ওজোন স্তর থেকে বৈদ্যুতিক কারেন্ট তৈরি করে যা ওজোন উপস্থিতির পরিমাণ পরিমাপ করতে সাহায্য করে।
যেহেতু, বেশি উচ্চতায় পৌঁছালে তা ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, এ কারণে, ডিভাইসে ল্যান্ডিংয়ের সময় ক্ষতি হ্রাস করার জন্য একটি প্যারাসুট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ।
বিজ্ঞানীরা যে অন্যান্য যন্ত্রাদি ব্যবহার করেন সেগুলোর মধ্যে টোমস (টোটাল ওজোন ম্যাপিং স্পেকট্রোমিটার) উপগ্রহের উপকরণ গুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । যদিও সর্বশেষ টোমস ইন্সট্রুমেন্ট তথ্য প্রেরণে ব্যর্থ হওয়ার পর ২০০৭ সালে এ প্রোগ্রামটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তবে এ প্রোগ্রামটি বিগত ৩০ বছর ধরে ওজোন স্তরের অবস্থা প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে । পাশাপাশি ওজন পরিমাপের জন্য বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি চালিত করা হয়েছে , যেমন: উপগ্রহে ওজোন মনিটরিং ইন্সট্রুমেন্ট (ওএমআই), যা ব্যাকস্ক্যাটারযুক্ত UV আলোককে ও পরিমাপ করে ।
বিজ্ঞানীরা যখন মোট ওজোনগুলোর পরিমাণ নির্ধারণ করেন, তখন তারা বায়ুর একটি কলামে ওজোন গ্যাসের পরিমাণ পরিমাপ করেন। ওজোন পরিমাপ করার জন্য, তারা ওজোন গবেষণার অগ্রণী G.M.B. এর নাম অনুসারে ডবসন ইউনিট (DU) ব্যবহার করে । একটি ডবসন ইউনিট একটি কলামে ওজোন গ্যাসের ০.০১ মিলিমিটার বেধ নির্দেশ করে ।
এ কৌশল গুলো ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ওজোন গ্যাসের পরিমাণ কত তা নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
ওজোন স্তরে ক্ষয়ের সাম্প্রতিক কয়েক বছরের তথ্য সবাইকে নতুন করে ভাবিয়ে তুলছে। ভয়াবহ এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে জনসচেনতার কোনো বিকল্প নেই। ব্যক্তিগত সচেতনতার পাশাপাশি এগিয়ে আসতে হবে প্রতিটি দেশের সরকারকে। আমাদের উচিত এক হয়ে ওজোন স্তর রক্ষায় এগিয়ে আসা। প্রাণিকুলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ওজোন স্তর রক্ষা করা জরুরি।