গোল্ডেন রেসিও বা সোনালী অনুপাত গণিতের একটি অপার বিস্ময়। সারা বিশ্বেই বহুল চর্চিত গাণিতিক রাশির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গোল্ডেন রেসিও। এটি φ(ফাই) দ্বারা প্রকাশিত হয়, যার মান 1.6180339887……..। এটি একটি অমূলদ সংখ্যা।
গোল্ডেন রেসিওর গাণিতিক বিবরণঃ
গোল্ডেন রেসিও পরিমাপের জন্য প্রথমে একটি সরলরেখা বিবেচনা করি। সরলরেখাটিকে দুটি অংশে বিভাজিত করি। ধরি অংশদ্বয়ের দৈর্ঘ্য যথাক্রমে a ও b। এখন, রেখাটির মোট দৈর্ঘ্য (a+b) এবং বৃহত্তর খন্ডাংশ (a) এর অনুপাত, এর বৃহত্তর খন্ডাংশ এবং ক্ষুদ্রতর খন্ডাংশ(b) এর অনুপাত সমান হয়, যাকে আমরা গোল্ডেন রেসিও নামে চিনি।
মনীষীদের রচনায় গোল্ডেন রেসিওঃ
প্রায় ৩০০ খ্রীস্টপূর্বে রচিত গ্রীক গণিতবিদ ইউক্লিড এর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘এলিমেন্টস’ (elements) এ গোল্ডেন রেসিওর বিবরণ পাওয়া যায়। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সমসাময়িক গণিতবিদ লুকা পাচিওলির রচিত ‘De Divina Proportione‘ এও আছে সোনালি অনুপাতের বর্ণনা। বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার সেই ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে বলেছিলেন,
“জ্যামিতির দুটি শ্রেষ্ঠ সম্পদ রয়েছে। একটি পীথাগোরাসের উপপাদ্য, এবং অপরটি হচ্ছে কোনো সরলরেখার একটি গড় ও পরম অনুপাতে বিভাজন। প্রথমটিকে আমরা স্বর্ণের সাথে তুলনা করতে পারি, আর দ্বিতীয়টিকে তুলনা করা যায় মুক্তোর সাথে।”
আধুনিক যুগে ড্যান ব্রাউনের কালজয়ী উপন্যাস ‘দা দ্য ভিঞ্চি কোড’ এর মাধ্যমে গোল্ডেন রেসিও নতুন করে মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে আসে। ‘দা দ্য ভিঞ্চি কোড’ এ লেখক প্রকৃতিতে গোল্ডেন রেশিওর বিস্ময়কর উপস্থিতি বাস্তবতা এবং পৌরাণিক উপাখ্যানের সংমিশ্রণে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করেন, যা পাঠকদের এই আশ্চর্যজনক গাণিতিক রাশির প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে।
স্থাপনায় গোল্ডেন রেসিওঃ
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত জগদ্বিখ্যাত অনেক স্থাপত্যশিল্পেও গোল্ডেন রেসিও এর উপস্থিতি দৃশ্যমান। অনেকেই ধারণা করেন যে মিশরের গিজায় অবস্থিত বিখ্যাত পিরামিডের গঠনেও পাওয়া যায় φ। তবে এর সপক্ষে পর্যাপ্ত যুক্তিপ্রমাণ পাওয়া যায় নি।
প্রাচীন গ্রীসের অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন ‘পার্থেনন‘ এর পিলারের গঠনে অনেকেই খুঁজে পান সোনালি অনুপাত। আধুনিক স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে প্যারিসের নটরডেম ক্যাথেড্রালে এবং নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরেও উৎসুক জনগণ গোল্ডেন রেসিওর সন্ধান পান।
মানবদেহে গোল্ডেন রেসিওঃ
মানবদেহেও বেশ কয়েকটি অঙ্গেই φ বা সোনালি অনুপাতের সন্ধান আমরা পাই। চলুন একটি একটি করে দেখা যাক সেসব অঙ্গ।
হাতঃ
স্ক্রল করা একটু বন্ধ রেখে নিজের অনামিকার (Index finger) দিকে একটু লক্ষ্য করুন। দেখবেন যে আঙ্গু্লটির নখের গোড়া থেকে কবজি পর্যন্ত যে হাড়গুলো রয়েছে, তার প্রতিটি পূর্ববর্তী হাড় থেকে প্রায় 1.618 গুণ বড় !
আবার নিজের কনুই থেকে আঙ্গুলের গোড়া পর্যন্ত মেপে দেখুন।এর মোট দৈর্ঘ্যকে কনুই থেকে কবজি পর্যন্ত দৈর্ঘ্য দিয়ে ভাগ করলে আবার পেয়ে যাবেন সেই গোল্ডেন রেসিও !!
এগুলো পড়তে ভুলবেন না ! ডিস্লেক্সিয়া : শিখতে না পারা যখন লার্নিং ডিজঅর্ডার! |
পাঃ
আমাদের পায়েও আমরা বেশ কয়েকটি সোনালি অনুপাতের দেখা পাই। পুরো পা এবং পায়ের তালুর মধ্যরেখার অনুপাতও একটি গোল্ডেন রেসিও।
মুখমণ্ডলঃ
মানুষের চেহারায় গোল্ডেন রেসিও এর উপস্থিতি সম্পর্কে কমবেশি আমরা সবাই জানি। সৌন্দর্যের আদর্শ হিসেবে অনেকেই গোল্ডেন রেসিও বিবেচনা করেন। আদর্শ চেহারায় বেশ কয়েকটি জায়গায় φ এর উপস্থিতি দৃশ্যমান। যেমনঃ
- মুখমণ্ডলের দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থের অনুপাত।
- ভ্রূ-জোড়ার মিলনস্থল থেকে ঠোঁটের উপর পর্যন্ত দৈর্ঘ্য এবং নাকের দৈর্ঘ্যের অনুপাত।
- মুখমণ্ডলের দৈর্ঘ্য এবং চোয়ালের গোড়া থেকে ভ্রু-জোড়ার মিলনস্থল পর্যন্ত দৈর্ঘ্যের অনুপাত।
- মুখগহ্বরের দৈর্ঘ্য এবং চোয়ালের গোড়া থেকে ভ্রু-জোড়ার মিলনস্থলের দূরত্বের অনুপাত।
- নাকের প্রস্থ এবং নাসাছিদ্রদ্বয়ের মধ্যবর্তী দূরত্বের অনুপাত।
- চোখের পিউপিল দুটির মধ্যে দূরত্ব এবং ভ্রু-জোড়ার মধ্যবর্তী দূরত্বের অনুপাত।
ডিএনএ এর গঠনে গোল্ডেন রেসিওঃ
জ্বী হ্যাঁ! জীবের বংশগতির বাহক ক্রোমোজমে অবস্থিত ডিএনএ এর মধ্যেও বিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করেছেন সোনালি অনুপাতের অস্তিত্ব! আমরা জানি, ডিএনএ এর ডাবল হেলিক্স গঠন হচ্ছে স্পাইরাল বা প্যাচানো (ডুপ্লেক্স বিল্ডিং এর উপরে যাওয়ার প্যাচানো সিড়ি কল্পনা করতে পারেন)।
এখন, ডাবল হেলিক্সে একটি ঘূর্ণনের দৈর্ঘ্য 34 Angstrom (১ মিটারের ১০০০০০০০০০০ ভাগের এক ভাগ) এবং ব্যাস 21 Angstrom, যাদের অনুপাত করলে মান আসে 1.6190476…., যা φ এর মানের খুব কাছাকাছি! এছাড়া ডিএনএ রেপ্লিকেশনেও গোল্ডেন রেসিওর উপস্থিতি থাকার ব্যাপারে অনেকেই ধারণা করছেন।