১৯৬০ এর দশক। সবার আগে চাঁদে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মত দেশগুলি। ঠিক একই সময় আফ্রিকা মহাদেশে স্বাধীনতা লাভের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল একটি দেশ। সাথে জন্ম নিচ্ছিল এক ক্ষুদ্র জাম্বিয়ান বিজ্ঞান শিক্ষক-এর স্বপ্ন। সবার আগে চাঁদ এবং মঙ্গলের বুকে পা রাখার স্বপ্ন।
১৯৬৪ সালের ৩০ অক্টোবর। টাইম ম্যাগাজিন জাম্বিয়ার নতুন রাষ্ট্রপতি কেনেথ ডেভিড কুযান্দার সাথে স্বাধীনতার উদযাপন অনুষ্ঠানের রিপোর্ট তৈরি করছিল। ঠিক একই সময় জাম্বিয়ার এক বিজ্ঞান শিক্ষক অভিযোগ করেন যে এই উদযাপন অনুষ্ঠান তাদের ‘স্পেস প্রোগ্রাম‘ কে বাধাগ্রস্ত করছে। এডওয়ার্ড মুকুকা এঙ্কোলোসো টাইম ম্যাগাজিনকে জানান, তাদের এস্ট্রোনটেরা চাঁদ এবং মঙ্গলে সবার আগে পা রেখে আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের এস্ট্রোনটদেরকে মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দিবে।
এঙ্কোলোসোর কথা শুনে তাকে হয় একজন পাগল হিসেবে আখ্যা দিবেন অথবা একজন বিরাট মাপের স্বপ্নদ্রষ্টা বলেই মনে হবে। ১৯৬০ এর দশকে যখন বিশ্বের বাঘা বাঘা দেশগুলোই মহাকাশে যেতে হিমশিম খাচ্ছিল সেখানে সদ্য স্বাধীন একটি দেশের চাঁদ কিংবা মঙ্গলে পা রাখা দূরের কথা মহাকাশে যাওয়াই ছিল অমবস্যার চাঁদ হাতে পাওয়ার মত বড় ব্যাপার।
আরেকটি পরিসংখ্যান দিলে ব্যাপারটি আরো পরিষ্কার হবে। যেই সময় জাম্বিয়া স্বাধীনতা লাভ করে সেই সময় সেখানকার জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৩৬ লক্ষ। তার থেকেও বড় বিষয় এই জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র ১৫০০ জন ছিলেন আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া মাধ্যমিক পাশ করা শিক্ষার্থী। আর বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল হাতে গোণা ১০০ জন। এঙ্কোলোসো নিজে ছিলেন একজন বিজ্ঞান শিক্ষক। পাশাপাশি তিনি নিজেকে ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স, স্পেস রিসার্চ এন্ড ফিলোসোফি‘এর (আনঅফিশিয়াল) প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেন।
তবে এই ছোট্ট দেশের একজন ছোট বিজ্ঞান শিক্ষক হওয়া সত্তেও তিনি বড় স্বপ্ন দেখতেন। তার স্বপ্ন ছিল ‘ফায়ারিং সিস্টেম‘এর মাধ্যমে ১০x৬ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের একটি অ্যালুমিনিয়াম নির্মিত মহাকাশযানকে চাঁদ এবং মঙ্গলে পাঠাবেন। তার এই মিশনের জন্য তিনি ১০ জন জাম্বিয়ান নাগরিক এবং একজন ১৬ বছর বয়সী আফ্রিকান মেয়ে মাথা মোয়াম্বা এবং দুইটি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বিড়ালকে নির্বাচিত করেন।
তিনি কেন বিড়াল দুইটিকে নির্বাচিত করেছেন জানতে চাইলে তিনি জানান- ‘মূলত বিড়াল দুইটি মাথাকে মহাকাশযানের মধ্যে সঙ্গ দিবে। এরপর চাঁদে পৌছানোর পর সবার আগে দরজা খুলে বিড়াল দুটিকে নিচে ফেলে দেওয়া হবে। যদি তারা বেঁচে যায় তাহলে বোঝা যাবে চাঁদ মানুষের জন্যও নিরাপদ।’ পাশাপাশি তিনি নিজের কুকুর সাইক্লোপসকেও তাদের সাথে পাঠাতে চেয়েছিলেন। মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের কুকুর লাইকার মহাকাশযাত্রার জবাব হিসেবে তিনি এই কাজটি করতে চেয়েছিলেন।
এমনকি নিজেদের মহাকাশযানের নামও তারা রাখেন সাইক্লোপস-১। তিনি হিসাব করে বের করেন যে ১৯৬৫ সালের মধ্যে তাদেরকে মহাকাশে পাঠাতে সক্ষম হবেন। এর জন্য তার দরকার ৭০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ইউনেস্কোর অর্থসাহায্য।
অর্থের জন্য এঙ্কোলোসো ইসরায়েল, আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ইউনেস্কো সহ আরো বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থার কাছে চিঠি লেখেন। জানা যায় তিনি এদের কাছ থেকে ২০ মিলিয়ন থেকে শুরু করে ২ বিলিয়ন পর্যন্ত অর্থসাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো দেশ বা সংস্থা তাকে অর্থসাহায্য করতে আগ্রহ প্রকাশ করে না। তার ভাগ্যে জুটেছিল কেবল দেশগুলোর শুভেচ্ছাবার্তা।
এছাড়াও তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে জাম্বিয়ার স্বাধীনতার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি মহাকাশে যেতে সক্ষম হতেন। কিন্তু ইউনেস্কো তাকে অর্থসাহায্য না দেওয়ায় সেটি সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি আমেরিকা এবং রাশিয়ার স্পাইরা তার ‘স্পেস সিক্রেটস‘ এবং বিড়ালটিকে চুরির চেষ্টা করেছে।
এঙ্কোলোসো সম্পর্কে আপনি যতই পড়বেন ততই তাকে আপনি আরো ভালোবাসতে শুরু করবেন। জাম্বিয়ান একটি গরিব এবং ছোট দেশের বিজ্ঞান শিক্ষক যেভাবে নিজের চেষ্টায় একটি স্পেস অ্যাকাডেমি খুলে বসেছিলেন তা সত্যিই প্রশংসারযোগ্য। শুধু স্পেস অ্যাকাডেমি খুলেই তিনি ক্ষান্ত হননি৷
তার নভোচারীদের তিনি ‘আফ্রোনাটস’ নামকরণ করেন। পাশাপাশি প্রশিক্ষণের জন্য আধুনিক কোনো সরঞ্জাম না থাকলেও আশাপাশে যা পেতেন তাই দিয়েই নভোচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ৪৪ গ্যালনের ড্রামের মধ্যে নভোচারীদের ভরে পাহাড়ের ঢাল থেকে নিচে ফেলে দিতেন। তার মতে এর মাধ্যমে নভোচারীরা স্পেসের মাধ্যে যাতায়াত করার অনুভূতি লাভ করবেন।
এর পাশাপাশি তিনি জিরো গ্রাভিটির অনুভতি সৃষ্টির জন্য একটি দড়ির এক প্রান্তের সাথে তাদেরকে বেধে এবং অন্য প্রান্ত গাছের সাথে বেধে ঘোড়াতেন। যখন তারা সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌছাতেন তখন তিনি গাছের সাথে থাকা দড়ির প্রান্তটি কেটে দিতেন। এর ফলে জিরো গ্রাভিটির স্বাদ লাভ করতো নভোচারীরা।
তবে সবচেয়ে মজার ছিল হাতের ওপর ভর দিতে হাটার প্রশিক্ষণ। তিনি তার সকল নভোচারীকে হাতের ওপর ভর দিয়ে হাটা শিখেয়েছিলেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র এই উপায়েই মহাকাশে হাটা সম্ভব হবে৷ তার চাঁদে যাওয়ার এই প্রস্তুতি আসলেই সত্য কি না, এপির এরকম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,
“অনেকে ভাবছে আমি পাগল, কিন্তু যেদিন আমি চাঁদের মাটিতে জাম্বিয়ার পতাকা গেঁথে দিব, সেদিন আমিই শেষ হাসি হাসব।”
কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তার নির্বাচিত কোনো নভোচারীই মহাকাশ ভ্রমণকে গুরুত্বের সাথে নেয়নি৷ প্রশিক্ষণের সময় তাদের কারোই মনোযোগ ছিল না। প্রশিক্ষণের থেকেএ নিজেদের মধ্যে প্রেম-ভালোবাসায় বেশি সময় ব্যয় করেছেন তারা। ফলস্বরূপ তাদের প্রধান নভোচারী ১৬ বছর বয়সী মাথা মোয়াম্বা গর্ভবতী হয়ে পরে এবং তারা বাবা-মা তাকে নিজেদের গ্রামে ফেরত নিয়ে যায়।
বলা বাহুল্য, এঙ্কোলোসো নভোচারীরা কোনোদিন চাঁদ তো নয়ই বরং পৃথিবীর সীমানাই পেড়তে পারেনি। তার এই অভিযানের সাথে সরকারের কোনো সম্পৃকত্ততা ছিল না সেটা তো আগেই পরিষ্কার হয়েছে৷ তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে এঙ্কোলোসো যেই আমেরিকাকে মহাকাশ যুদ্ধে পরাজিত করতে চেয়েছিল তারাই এখন বিশ্বের মহাকাশ গবেষণার মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
এমনকি চীন বাদে একমাত্র আমেরিকাই সফল ভাবে মঙ্গলে নিজেদের মহাকাশযান ও রোবট পাঠাতে সক্ষম হয়েছে৷ হয়তো ভবিষ্যতে আমেরিকার হাত ধরেই মঙ্গলে মানুষ পা রাখবে। এঙ্কোলোসো হয়তো পাগল ছিলেন, কিন্তু একজন বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা আমাদের অনেকের কাছেই কল্পনারও বাইরে। হয়তো তিনি সফল হননি, কিন্তু নিজের দেশকে মহাকাশ ভ্রমণে সক্ষম দেশের তালিকায় দেখার যে বীজ তিনি বুনে গিয়েছিলেন তা আমাদেরকে অনুপ্রেরণার গল্প শোনায়।
তার এই বোনা বীজ থেকেই হয়তো জাম্বিয়া, উগান্ডা কিংবা আমাদের দেশ একদিন পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশের বুকে নিজেদের পতাকাবাহী মহাকাশযান ওড়াবে। স্বপ্নগুলো এভাবেই তৈরি হোক, এভাবেই বেঁচে থাকুক আমাদের সবার মাঝে।