অনেক দ্রুতগতিতে মেহেদী রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ মেহেদীর মনে হলো কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। তার মনে হলো আওয়াজটা সম্ভবত রাস্তার পাশের চায়ের দোকান থেকে ভেসে আসছে। সে ঘুরে তাকাতেই দেখলো। হ্যাঁ ঠিকই, চায়ের দোকান থেকে মবিন ভাইয়া তাকে ডাকছেন।
মেহেদী দ্রুত পায়ে চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া। ভালো আছেন?”
মবিন ভাইয়া: ওয়ালাইকুম আসসালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, তুমি কেমন আছো? আর এত দ্রুত হেঁটে কোথায় যাচ্ছিলে?
মেহেদী: আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আসলে ভাইয়া, আমি আপনার বাসায় যাচ্ছিলাম। ভালোই হলো এখানেই পেয়ে গেলাম।
মবিন ভাইয়া: হ্যাঁ, এইতো চা খেতে আসলাম। জান-ই তো রফিক ভাইয়ের চা কত বিখ্যাত! আচ্ছা আমার বাসায় কেন যাচ্ছিলে? কোনো সমস্যা হয়েছে?
আসলে মেহেদীর কোনো বড় ভাইয়া না থাকাতে, কখনো কোনো পরামর্শের দরকার হলেই মবিন ভাইয়ের কাছে যায়।
মেহেদী: না ভাইয়া, আসলে…
মবিন ভাইয়া: আরে কী হলো? বলো না। এত ইতস্ততবোধ করছো কেন? আচ্ছা চা খাবে? রফিক ভাই, মেহেদীকে এক কাপ চা দেন তো!
মেহেদী: না ভাইয়া, আমি আসলে চা খাই না।
মবিন ভাইয়া: আচ্ছা তাহলে কফি খাও। কফিতে অনেক উপকার জানো তো। গবেষণায় দেখা গেছে মানসিক চাপের সময়, ২০০ মি.গ্রাম ক্যাফেইন শরীরে গেলে মনযোগ বৃদ্ধি পায়। আর তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার এখন মনোযোগ বৃদ্ধির দরকার।
মেহেদী: আচ্ছা ভাইয়া আপনি যখন বলছেন, তাহলে কফি খেতে পারি। আসলে আপনি ঠিকই ধরেছেন এখন আমার মনোযোগ বৃদ্ধির দরকার।
মবিন ভাইয়া: রফিক ভাই, মেহেদীকে এক কাপ কফি দেন তো!
রফিক ভাই: ঠিক আছে, দিতাছি। কী কফি খাবা, এমনে কফি নাকি দুধ দিয়া কফি?
মেহেদী: না, আমার এখন খালি পেট। আর খালি পেটে ব্ল্যাক কফি খেলে শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। আপনি দুধ দিয়েই কফি দেন।
রফিক ভাই: আচ্ছা দিতাছি।
মবিন ভাইয়া: মেহেদী, এবার বলো তো, কী সমস্যা?
মেহেদী: না ভাইয়া, আমি আসলে ফেসবুকে “সায়েন্স বী ফ্যামিলি” নামের একটা গ্রুপে আছি। এই গ্রুপের মেম্বারসংখ্যা ১ লাখেরও অধিক।
মবিন ভাইয়া: হ্যাঁ, সেটা তো ভালো কথা। তো সমস্যা কী?
মেহেদী: নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে গ্রুপটা বিজ্ঞানভিত্তিক। গ্রুপের মেম্বাররা প্রতিদিনই বিজ্ঞানভিত্তিক অগণিত প্রশ্ন করেন। গ্রুপের এডমিন/মডারেটর/যে-ই প্রশ্নটির উত্তর পারে দেওয়ার চেষ্টা করে। মাঝেমধ্যে আমিও দেওয়ার চেষ্টা করি।
মবিন ভাইয়া: এটাও তো ভালো কথা। সবার অজানা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। অনেকের উপকারও হয়। এতেও তো কোনো সমস্যা দেখছি না।
মেহেদী: আসলে ইদানীং একটি জিনিস লক্ষ্য করলাম, গ্রুপটির বেশ কয়েকজন বলছে, “আরে, এখানে তো সব প্রশ্নের উত্তর গুগল থেকে কপি করে দেওয়া হয়। গুগলেই তো সব আছে।”
তো এখন গ্রুপের পক্ষ থেকে একটি কন্টেস্টের আয়োজন করা হয়েছে। “গুগল কীভাবে কাজ করে?”- এই বিষয়টির ওপর লিখতে হবে। আমার মনে হচ্ছে, মূলত গ্রুপের সেই সমালোচকদের বিষয়টি বোঝাতেই কন্টেস্টটির আয়োজন করা হয়েছে। এখন সমস্যা হলো আমি “গুগল কীভাবে কাজ করে” এই সম্পর্কে কিছুই জানি না। এই জন্য আপনার বাসায় যাচ্ছিলাম, আপনার কাছ থেকে জানার জন্য।
মবিন ভাইয়া: ও আচ্ছা, এই ব্যাপার। এর জন্য এত ইতস্ততবোধ করা লাগে? ঠিক আছে আমি তোমাকে এই সম্পর্কে বলার চেষ্টা করছি।
মেহেদী: (আনন্দের সাথে) ধন্যবাদ ভাইয়া!
এমন সময় রফিক ভাই এসে বলল, “এই লও, তোমার কফি”
মেহেদী: ধন্যবাদ, রফিক ভাই।
মবিন ভাইয়া: তাহলে আর কী, চলো শুরু করি! আগে বলি গুগল কী? গুগল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইন্টারনেট এবং সফটওয়্যার কোম্পানী। অনলাইন বিজ্ঞাপন, সার্চ ইঞ্জিন এবং ক্লাউড কম্পিউটিং এর জন্য এটি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। গুগলের মূলমন্ত্র হল বিশ্বের সকল তথ্য সন্নিবেশিত করে তাকে সবার জন্য সহজলভ্য করে দেওয়া। প্রতি সেকেন্ডে গুগলে গড়ে প্রায় ৪০,০০০ সার্চ করা হয়। গুগলের ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনেক এবং দিন দিন তা বেড়েই চলছে।
আরও পড়ুন… ১। ভাবতে পারো কেমন হতে পারে ২০৫০ সালের আমাদের এ পৃথিবী ? ২। ইন্টারনেট কি? জানেন তো ইন্টারনেট কিভাবে কাজ করে? — বিস্তারিত! ৩। নতুনদের জন্য প্রোগ্রামিং গাইডলাইন |
মেহেদী: কারণ মানুষের জানার আগ্রহও বেড়ে চলেছে। তাই না ভাইয়া?
মবিন ভাইয়া: হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ। কিন্তু গুগল প্রতিনিয়ত কীভাবে এত প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে, জানো?
মেহেদী: না ভাইয়া, কীভাবে ?
মবিন ভাইয়া: গুগল বিভিন্ন অ্যালগরিদমের মাধ্যমে কাজ করে থাকে।
মেহেদী: অ্যালগরিদম? এটা আবার কী, ভাইয়া?
মবিন ভাইয়া: অ্যালগরিদম হচ্ছে এক ধরনের প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সার্চ ইঞ্জিন গুলোতে ওয়েবসাইট এবং keyword Rank করানো হয়।
মেহেদী: বুঝলাম, কিন্তু গুগল এই তথ্যগুলো কীভাবে প্রদর্শন করে?
মবিন ভাইয়া: গুগল তথ্য প্রদর্শনের জন্য কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করে।
মেহেদী: সেগুলো কী কী ভাইয়া? তাড়াতাড়ি বলেন, আমার আর অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করছে না!
মবিন ভাইয়া: আচ্ছা বলছি। প্রথমটি হলো ওয়েব ক্রলিং (Web crawling)। যখন তুমি গুগলে সার্চ করছো, তখন প্রতিবারই গুগল তোমাকে ফলাফল দেখাচ্ছে। কিন্তু ফলাফল তোমাকে দেখানোর আগে অবশ্যই গুগলকে নিজে ফলাফল বের করতে হচ্ছে। গুগলবট নামে গুগলের একটি ওয়েব ক্রলার আছে, যার কাজ হচ্ছে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের মাধ্যমে বিশ্বের সব ধরনের ওয়েবপেজ ভিজিট করা। গুগলবট যখন একটি পেজ সংগ্রহ করে তখন এই পেজে পাওয়া লিংকগুলো তার ক্রলিং তালিকায় যোগ হয়। এই পদ্ধতিতে একই লিংক অসংখ্যবার আসে, কিন্তু গুগলবট সেগুলোকে বাদ দিয়ে একটি তালিকা তৈরি করে যাতে সবচেয়ে কম সময়ে পুরো ওয়েবকে কভার করা সম্ভব। এটিই মূলত ওয়েব ক্রলিং।
মেহেদী: কী বলছেন ভাইয়া, এত কম সময়ে?
মবিন ভাইয়া: হ্যাঁ, খুবই কম সময়ে হয় কাজটি। আচ্ছা এর পরের ধাপগুলো শুনবে না?
মেহেদী: অবশ্যই শুনবো, বলেন ভাইয়া!
মবিন ভাইয়া: দ্বিতীয়টি হলো ইনডেক্সিং (indexing)। বিশ্বজুড়ে প্রতিনিয়ত কোটি কোটি ওয়েবসাইটে তথ্য সংযুক্ত হতে থাকে। তাই স্পাইডারও প্রতিনিয়ত ক্রলিং করতেই থাকে। একটা নির্দিষ্ট পেইজ ক্রলিং করা শেষ হলে সেই তথ্য সার্ভারে ইনডেক্স করা হয়। ইনডেক্স এ শব্দ আর URL এর তালিকা থাকে। স্পাইডার যখন একটা পেইজ কে ক্রল করে তখন সেই পেইজের প্রতিটা শব্দকে সে আয়ত্ত করে। কোন শব্দ কতবার ব্যবহার করা হয়েছে এই সমস্ত কিছু সে নোট করে রাখে। এভাবেই সে একটা ইনডেক্স তৈরী করে।
মেহেদী: তার মানে, এটির মাধ্যমে সেই সব পেইজ থেকে শব্দগুলিকে আলাদা করে শব্দতালিকা তৈরী করা হয়। এরপরে প্রত্যেক শব্দের জন্য কোন কোন পেইজে তারা রয়েছে তার একটি তালিকা করা হয়। যা দেখতে একদমই বইয়ের শেষে যে index থাকে তারই মতো। তাই না ভাইয়া?
মবিন ভাইয়া: চমৎকার, এইতো বুঝে গেছো। এর পরেরটা হচ্ছে, সার্চিং (Searching)। যখনই তুমি গুগলে কোন কিছু অনুসন্ধান করো, তখন সেই অনুসন্ধান অনুযায়ী গুগলবটের সংগ্রহ করা তালিকা থেকে তথ্য নিয়ে সার্চের ফলাফলে প্রকাশ করে। এরপর তুমি তোমার পছন্দমত ওয়েবসাইটের লিঙ্কে ক্লিক করে থাকো।
মেহেদী: আসলেই তো। সেই ওয়েবসাইটের লিংকে ক্লিক করার সাথে সাথে আমি আমার প্রয়োজনীয় তথ্যটি পেয়ে যাই!
মবিন ভাইয়া: হ্যাঁ, সবশেষে আসে Ranking। সার্চ ইঞ্জিনের এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এবং এর ওপরেই একটি সার্চ ইঞ্জিনের ব্যবসায়িক বৰ্তমান ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। সার্চিং এর পরে যে পাতাগুলো এলো তাদের মধ্যে আপনার খোঁজা শব্দ বা শব্দগুচ্ছ গুলো আছে কিনা, অথবা কোন ওয়েবসাইটটি বেশি তথ্যসমৃদ্ধ এবং গ্রহণযোগ্য, সেটি নির্বাচন করাই এই Ranking এর কাজ।
মেহেদী: এখন বুঝলাম, কেন সবার আগে যে ওয়েবসাইটটি থাকে সেটাতে আমার খোঁজা তথ্য বেশি থাকে। কিন্তু একটা কথা ছিলো ভাইয়া, গুগল তো তাহলে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেয় না, গুগল শুধুমাত্র অন্যান্য ওয়েবসাইট কে আমাদের সামনে নিয়ে আসে। তাহলে তো মূলত আমরা উত্তর পাই বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে! তাই নয় কী, ভাইয়া?
মবিন ভাইয়া: একশ শতাংশ সঠিক বলেছো তুমি! আমদের সকল অনুসন্ধানের উত্তর দেয় বিভিন্ন ওয়েবসাইট। গুগল সেগুলো রিসেম্বেল করে আমাদের সামনে নিয়ে আসে।
মেহেদী: তাহলে তো গ্রুপের সেই সমালোচকগণ সবাই ভুল কথা বলেছে।
মবিন ভাইয়া: হ্যাঁ, অবশ্যই ভুল বলেছে। গুগল কখনোই নিজে নিজে উত্তর বানায় না। অর্থাৎ, গুগলে রেডিমেট উত্তর থাকে না। যদি কখনো কোনো ওয়েবসাইট না থাকতো, তাহলে গুগল কখনোই কোনো উত্তর আমাদের সামনে শো করতে পারতো না। আর তখন গুগল একটি ব্যর্থ জিনিসই থাকতো!
মেহেদী: ধন্যবাদ ভাইয়া। আমাকে এত সুন্দর করে এই বাস্তবতাটি বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।
মবিন ভাইয়া: আশা করছি গ্রুপের কন্টেস্টটিতে তুমি কথাগুলো সুন্দর করে গুছিয়ে লিখতে পারবে, ইনশাআল্লাহ।
মেহেদী: ইনশাআল্লাহ। চেষ্টা করব। আশা করছি লেখাটি পড়ার পর গ্রুপের সমালোচকগণ আর বলবেন না যে, “গ্রুপে সব উত্তর গুগল থেকে কপি করে দেওয়া হয়। গুগলে তো সবই আছে।”
মবিন ভাইয়া: আশা করা যায়।
মেহেদী একসময় আবিষ্কার করল, তার কাপে আর কফি নেই!