“বাংলাদেশি মেয়ে সেঁজুতি সাহা। তিনি যখন সেই ছোট্টটি ছিলেন, দেখতেন রাতের বেলা খাবার টেবিলে কথা হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, সংক্রামক রোগ—এসব নিয়ে।
খাওয়ার সময় এমন সব আলোচনা অনেকের কাছেই উদ্ভট ঠেকবে। কিন্তু সাহা পরিবারে এমনটাই হতো। সেঁজুতির বাবা ড. সমীর সাহা মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক। তিনি তাঁর বিজ্ঞান বক্তৃতার অনুশীলন করতেন বাড়িতে রাতের খাবার টেবিলে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি যখন যা জানতে পারতেন, তা নিয়েও কথা বলতেন ওই টেবিলে।”
এই কথাগুলো বিল গেটস লিখেছিলেন তার নিজস্ব ব্লগসাইট ‘গেটসনোট’ এ।
ডক্টর সেঁজুতি সাহা এবং তাঁর বাবা ডক্টর সমীর সাহা অনেক আগে থেকেই অণুজীববিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণায় বাংলাদেশের দুই মহারথী। কিন্তু, বাবা–মেয়ে দুইজনে একসাথে প্রথম আলোচনায় আসেন ২০২০ সালে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর। ডক্টর সেঁজুতি সাহার নেতৃত্বাধীন একটি দল বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার ঘটানো করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্সিং এর মাধ্যমে সাড়া ফেলে দেন।
তৃতীয় শ্রেণিতে থাকতে বিজ্ঞানমেলায় অংশ নিয়েছিলেন ডক্টর সেঁজুতি। সেখানে তাঁর প্রজেক্ট ছিল রক্তের গ্রুপ নির্ণয়। এই প্রজেক্টটি বেশ তাক লাগিয়েছিলো সবাইকে। বাবা–মা’র সহযোগিতায় তৈরি করা এই প্রজেক্ট ব্যবহার করে একজন শিক্ষকের রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করেছিলেন সেঁজুতি। এই ঘটনা থেকে আমরা আন্দাজ করতে পারি, ‘ভোরের অবস্থা দেখেই বলে দেয়া যায় দিন কেমন যাবে’ এই প্রবাদ বাক্যটির সার্থকতা ডাক্তার সেঁজুতির জীবনে কতখানি বাস্তব। এরপর থেকে প্রতিবছরই বিজ্ঞানমেলায় সেঁজুতির নামে কোনো না কোনো পুরস্কার থাকতোই।
ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেও প্রচুর বাংলা বই পড়তেন সেঁজুতি। নিয়মিত আবৃত্তি করতেন। পেতেন পুরষ্কার। স্কুল থেকে ফিরে বাবা অথবা মায়ের ল্যাবে সময় কাটাতেন সেঁজুতি। বাবা তাঁর মাইক্রোস্কোপের নিচে প্রায়সময়ই বিভিন্ন অণুজীব দেখাতেন। সেখান থেকেই আস্তে আস্তে অণুজীববিদ্যার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন সেঁজুতি।
২০০৩ সালে ও লেভেল দেন সেঁজুতি। ৮ টি বিষয়ের প্রতিটিতে এ পান। এ লেভেলের শুরুতেই পড়াশোনা নিয়ে বাবা–মায়ের সঙ্গে মতবিরোধের সূচনা। অংক এবং অর্থনীতিতে ভালো ছিলেন তাই বাবা–মা চাচ্ছিলেন মেয়ে যেন অর্থনীতিতে উচ্চ শিক্ষা নেয়। এর পেছনে কারণটা অবশ্য পুরোটাই বাস্তবভিত্তিক। দুজনেই কর্মজীবি হলেও তাদের ইকোনমিক হার্ডশিপ কিছুটা ছিলই। এই কারণেই তারা চাইতেন মেয়ে বিজ্ঞানে না পড়ে অর্থনীতিতে পড়ুক। স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানিয়ে দেন যে সেঁজুতি বিজ্ঞান নিচ্ছে না। কিন্তু মেয়ের জিদ সে বিজ্ঞানেই পড়বে। এবং বাবা–মায়ের সঙ্গে রীতিমত যুদ্ধ করে বিজ্ঞানে ভর্তি হন। একটি সাক্ষাৎকারে সেঁজুতি বলেন, ‘অনেকে ভাবেন বাবা–মায়ের ইচ্ছাতেই বিজ্ঞানী হওয়া কিন্তু আসলে তা নয়।’
এই ব্লগগুলি পড়তে ভুলবেন না ! যক্ষ্মা এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ও বাংলাদেশের অবস্থান |
তারপর টুয়েলভে পড়ার সময় সেঁজুতি চাইলেন বিদেশে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে। এজন্য তাঁকে পারিবারিক, সামাজিক বিভিন্ন চাপ মোকাবেলা করতে হয়। কারণ, ২০০৪ সালের দিকে কোনো মেয়ে একা একা বিদেশে যাবে পড়তে, এটা ছিল অনেকের কল্পনারও বাইরে। কানাডার চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেন সেঁজুতি সাহা। এরমধ্যে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে পান সবচেয়ে বেশি স্কলারশিপ। তাই সেখানেই ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন। এতো ভালো বিশ্যবিদ্যালয়ে স্কলারশিপ পাওয়ায় মানুষের কথা পাত্তা না দিয়েই তারা বাবা–মাও রাজি হন মেয়েকে পাঠাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরে ২০০৫ এর এপ্রিলের শেষে এ লেভেলের রেজাল্ট বের হলে দেখা গেল তিনি চার বিষয়ের সবগুলোতে এ পেয়েছেন। টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করার পর পিএইচডির জন্য আমেরিকাতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সেঁজুতি সাহা। কিন্তু পরে সেখানেই মলিকিউলার জেনেটিকসে পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি হন ২০০৯ সালে। গবেষণার বিষয় ছিল অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স।
অণুজীববিজ্ঞানীদের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সংগঠন আমেরিকান সোসাইটি অব মাইক্রোবায়োলজি ২০১৭ সালে তাদের পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করে বাংলাদেশি অণুজীববিজ্ঞানী সমীর সাহাকে।যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার বাইরে পুরস্কারটি আগে কখনো দেওয়া হয়নি। এতো মর্যাদা পেয়েও সমীর সাহা দেশ ও দেশের মানুষের কথা ভুলে যাননি। সেই বাবার মেয়ে হয়ে দেশের প্রতি টান থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
তাই দেশের মানুষের জন্য কিছু করার আগ্রহ থেকেই গবেষণার বিষয় হিসেবে ডক্টর সেঁজুতি সাহা বেছে নেন অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স। পিএইচডি প্রোগ্রাম যখন শেষ করেন, তখন বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুহার কমাতে কাজ করছিলো। সেখানে আবেদন করেন ও ২০১৬ সালে গবেষণার কাজে দেশে চলে আসেন ও বাবার প্রতিষ্ঠান চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন(সিএইচআরএফ)-এ যোগ দেন।
ঢাকায় ফিরে মনোযোগ দেন গবেষণায়। কাজ শুরু করেন জিনোম সিকুয়েন্স নিয়ে। আমাদের দেশে অনেক সময় অনেক শিশু জ্বর বা খিঁচুনিতে মারা যায়। কিন্তু এভাবে এমনি এমনি তো কেউ মারা যায় না। এর পেছনে নিশ্চয় কোন ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস জড়িত, ভাবতেন তিনি। এসব অসুখের রহস্য উদঘাটনের চেষ্টা চালিয়ে যান তাই। সেঁজুতির গবেষণার মূল বৈশিষ্ট্য হল পুরো কাজটাই তিনি দেশে সম্পাদন করার চেষ্টা করেন। কারণ, বাংলাদেশে নমুনা সংগ্রহের পর জিনোম সিকুয়েন্সের জন্য সাধারণত বিদেশে পাঠাতে হত।
এরপর উচ্চতর গবেষণার জন্য চ্যান জাকারবার্গ বায়োহাবের বৃত্তি নিয়ে আমেরিকা যান সেঁজুতি। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সানফ্রান্সিসকোর সঙ্গে কোলাবোরেশন হয় তাদের প্রতিষ্ঠানের। সে বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে বিল এন্ড মেলিন্ডা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সেঁজুতির নামে প্রথমবারের মত একটি জিনোম সিকুয়েন্স মেশিন আসে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনে। এর আগে যত মেশিন আসত তা তার বাবা ড. সমীর সাহার নামে আসতো। তাই নিজের নামে এই মেশিনও আসাটা সেঁজুতির জন্য বেশ গর্বের। এই মেশিনটা আসার পর নিজের গবেষক দল গড়ে তোলেন সেঁজুতি সাহা। কোর টিমে ছয়জন ছাড়াও আরও অনেকেই কাজ করছেন তার সঙ্গে।
এর মধ্যেই কাজের অসাধারণ এক স্বীকৃতি আসে তার জীবনে। ২০১৯ এর সেপ্টেম্বরে উন্নয়নশীল দেশের গবেষক প্রতিনিধি হিসেবে বিল গেটসের সঙ্গে জাতিসংঘের অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন তিনি। প্রতিবছরই জাতিসংঘের অধিবেশনে বিল গেটসের একটি সেশন থাকে যেখানে তিনি নিজে বক্তব্য দেন এবং উন্নয়নশীল দেশ থেকে দুজন করে বিজ্ঞানী নিয়ে যান। গতবছর বাংলদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন সেঁজুতি সাহা আর ব্রাজিল থেকে আসে আরেক মেয়ে বিজ্ঞানী। বক্তব্যের বিষয় ছিল, টেন/নাইন্টি গ্যাপ।
এর অর্থ হল উন্নয়নশীল দেশে শিশু মৃত্যুহার উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক বেশি হলেও গবেষণা হয় মূলত উন্নত দেশগুলোতে। যেখানে উন্নয়নশীল দেশে শিশু মৃত্যুহার নব্বই শতাংশ, সেখানে এসব দেশের কাছে রিসোর্স আছে মাত্র দশ শতাংশ। একেই বলা হয় ‘টেন/নাইনটি গ্যাপ।’ সারা বিশ্বের সামনে বাংলাদেশের শিশুদের অবস্থা তুলে ধরেন তরুণ এই বিজ্ঞানী।
বাংলাদেশে ২০২০ সালের মার্চের ৮ তারিখ প্রথম করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ে এবং এই রোগে প্রথম কেউ মারা যান ১৮ মার্চ। তখনই কোভিড–১৯ এর জিনোম সিকুয়েন্সের কাজ শুরু করেন সেঁজুতি ও তার গবেষক দল। কিন্তু এর মধ্যেই ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ইংল্যান্ডে যেতে হয় তাকে। কিন্তু এই বাঁধায় দমে যাওয়ার মেয়ে ডক্টর সেঁজুতি নন। তিনি বিদেশে বসেই ক্যামেরার সাহায্যে ল্যাবের কার্যক্রম চালিয়ে যান। তার টিমও সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। দিন নাই, রাত নাই ল্যাপটপের ক্যামেরায় দেখে দেখে দলকে গবেষণা কাজের নির্দেশনা দিয়ে গেছেন তিনি। এভাবেই গত ১২ মে আট সদস্যের এই দল আবিষ্কার করেন বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্স যা এই জনগোষ্ঠির জন্য কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে ভূমিকা রাখবে। সেই উদ্দেশ্যে গবেষণার ফলাফল পাবলিক করে রাখা হয়েছে যাতে যে কেউ তথ্য নিয়ে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন।
নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ডক্টর সেঁজুতি একটি সাক্ষাৎকারে জানান, ভবিষ্যতেও শিশুদের নানারকম সংক্রামক রোগ নিয়ে কাজ করতে চান। খুঁজে দেখতে চান মেনিনজাইটিস কেন হয়। চেষ্টা করবেন এর ভ্যাকসিন আবিষ্কার করতে। ছেলেবেলা থেকেই যে বাবা–মা শিখিয়েছেন বিজ্ঞানকে মানুষের কাজে লাগাতে হবে।
গতবছর ডক্টর সেঁজুতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় পোলিওবিষয়ক পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
২০১৭ সালে বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে মেনিনজাইটিসের সংক্রমণ হঠাৎ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু এর কোনো ব্যাখ্যা মিলছিল না। সেই সময় সেঁজুতি শিশুদের জিনগত উপাদান বিশ্লেষণ করে এর রহস্য উন্মোচনে সক্ষম হন। (তিনি উদ্ভাবন করেন, চিকুনগুনিয়া জ্বরের বিস্তারের কারণেই মেনিনজাইটিসের প্রকোপ বেড়েছে। আর চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস ছড়ায় মশার মাধ্যমে।) কিন্তু রহস্য সবিস্তারে জানতে নমুনা সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান তিনি। তখন থেকে তিনি বাংলাদেশে এ রোগ নির্ণয়ে স্বল্পমূল্যের একটি উপকরণ বের করেন, যাতে ভবিষ্যতে মেনিনজাইটিস ও অন্যান্য প্রাণঘাতী ব্যাধির বিস্তার দ্রুত মোকাবিলায় দেশকে সহায়তা করা যায়।
১৯৯২ সালের ২৩শে এপ্রিল (গুগল সার্চ মোতাবেক)/ ১৯৮৬ সালে (তার নিজস্ব ব্লগ মোতাবেক) বাবা ডক্টর সমীর কুমার সাহা এবং মা ডক্টর সেতারুন্নাহার এর ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন ডক্টর সেঁজুতি সাহা। দুই ভাইবোনের মধ্যে তিনি বড়। ছোটোভাই বর্তমানে টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীববিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছেন। ডক্টর সেঁজুতির স্বামীও একজন গবেষক। তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যে কর্মরত আছেন।
তথ্যসূত্রঃ১) Gatesnotes
২) প্রথম আলো