দিনের আবর্তে বহুযুগ ধরে মহাবিশ্বের অনেক অজানা জিনিস অক্ষিগোলকে আবদ্ধ হয় কিংবা প্রযুক্তির সান্নিধ্যে জমা হয় বিশাল তথ্য ভান্ডারে । নতুন নতুন আবিষ্কার নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করে। আবার কিছু জিনিস ফেলে দেয় পুরো মানবসমাজকে এক অমীমাংসিত ধাঁধায়। যার মীমাংসা করতে উঠেপড়ে লেগে যায় বহুজ্ঞানী ব্যক্তিত্ব। এ বিশাল মহাবিশ্বের কতটুকুই আমরা জানতে পেরেছি? কতটুকুর রহস্যের হেতু সমাধাণ করেছি? সেটা যে কতটা ক্ষুদ্র তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সবাইকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে ঠিক তেমনি একটা রহস্যের অজানা উৎস। যার নাম ডার্ক ম্যাটার।
ডার্ক ম্যাটার কি? কেন হয়? এর প্রভাবে কি হয় এসব জানার সুবিধার্থে কিছু জিনিস আগে জেনে নেই।
মহাকর্ষীয় বল কি?
> এই সৌরজগতের যে কোনো দুটি বস্তুর মধ্যে যে আকর্ষণ বল কাজ করে তা-ই মহাকর্ষীয় বল।
নিউট্রিনো কি?
> নিউট্রিনো হচ্ছে বৈদ্যুতিক চার্জবিহীন, দুর্বল সক্রিয় ক্ষুদ্র পারমাণবিক কণা। ধারণা করা হয়, এই ক্ষুদ্র কণা অশূন্য ভরের কণা। পর্দাথের মধ্য দিয়ে এই কণা প্রায় অবিকৃতভাবে চলাচল করতে পারে। নিউট্রিনো অর্থ হচ্ছে ‘ক্ষুদ্র নিরপেক্ষ কণা’।
সর্পিল ছায়াপথ (Spiral Galaxy) কি?
সর্পিল ছায়াপথ এক ধরনের ছায়াপথ যা দেখতে চেপ্টা, ধীরে ধীরে এর চারপাশের স্ফীত চাকতিগুলো এর কেন্দ্রকে কেন্দ্র করে পর্যাবৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। এর কেন্দ্রে নক্ষত্র, গ্যাস, ধূলিকণা, অন্ধকার বস্তু এবং শক্তিশালী কৃষ্ণ বিবর ধারণ করে। আমরা আকাশগঙ্গা (Milky Way) নামক সর্পিল ছায়াপথে বসবাস করছি। বর্তমানে মহাবিশ্বের প্রায় ৬০% ছায়াপথ সর্পিল আকারের।
কোমা ক্লাস্টার:
কোমা ক্লাস্টার হল গ্যালাক্সির একটি বড় ক্লাস্টার যাতে 1,000 টিরও বেশি চিহ্নিত ছায়াপথ রয়েছে। পৃথিবী থেকে ক্লাস্টারের গড় দূরত্ব হল ৩২১মিলিয়ন আলোকবর্ষ। কেন্দ্রীয় অঞ্চল দুটি অতিবৃহৎ উপবৃত্তাকার ছায়াপথ দ্বারা প্রভাবিত: NGC 4874 এবং NGC 4889। ক্লাস্টারটি আকাশের উত্তর গ্যালাকটিক মেরুতে কয়েক ডিগ্রির মধ্যে রয়েছে। কোমা ক্লাস্টারের কেন্দ্রীয় অংশে বসবাসকারী বেশিরভাগ ছায়াপথই উপবৃত্তাকার। কোমা ক্লাস্টারে বামন এবং দৈত্য উপবৃত্তাকার উভয়ই প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়।
ডার্ক ম্যাটার কি?
ডার্ক ম্যাটার এমন একটি অনুমানমূলক অদৃশ্য অন্ধকার ভর যা গ্যালাক্সি এবং মহাবিশ্বের অন্যান্য বস্তুগুলোর মধ্যে মহাকর্ষীয় বল যোগ করে দেয়। ডার্ক ম্যাটার সম্পূর্ণ অদৃশ্য। এটি কোন আলো বা শক্তি নির্গত করে না যার জন্য প্রচলিত সেন্সর এবং ডিটেক্টর দ্বারা এর অস্তিত্ব সনাক্ত করা যায় না। ডার্ক ম্যাটার কী দিয়ে তৈরি তা বিজ্ঞানীরা শুধু অনুমান করেন। এটি বেরিয়নের চেয়ে নন-বেরিয়নিক হওয়ার প্রবণতা বেশি, যার অর্থ এটি বিভিন্ন ধরণের কণা নিয়ে গঠিত।
ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব প্রথম অনুমান করেছিলেন সুইস আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিটজ জুইকি, যিনি 1933 সালে আবিষ্কার করেছিলেন যে, গ্যালাক্সির কোমা ক্লাস্টারের সমস্ত নক্ষত্রের ভর ক্লাস্টারের মহাকর্ষীয় টান থেকে ছায়াপথগুলিকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ভরের মাত্র 1 শতাংশ সরবরাহ করে।
বেশিরভাগ বিজ্ঞানী মনে করেন যে ডার্ক ম্যাটার নন-ব্যারিওনিক পদার্থ দিয়ে গঠিত। WIMPS (Weakly interacting massive particles-দুর্বলভাবে মিথস্ক্রিয়াকারী বৃহদায়তন কণা), একটি প্রোটনের ভরের দশ থেকে একশ গুণ বেশি বলে বিশ্বাস করা হয়, কিন্তু “স্বাভাবিক” পদার্থের সাথে তাদের দুর্বল মিথস্ক্রিয়া তাদের সনাক্ত করা কঠিন করে তোলে। কেননা এটি নিউট্রিনোর চেয়ে ভারী এবং ধীর বিশাল অনুমানমূলক কণা।
কেন আমরা মনে করি ডার্ক ম্যাটার আছে?
কিন্তু আমরা যদি ডার্ক ম্যাটার দেখতে না পাই, তাহলে আমরা কীভাবে জানব যে এটি বিদ্যমান? উত্তর হল, মাধ্যাকর্ষণ, পদার্থের তৈরি বস্তুর দ্বারা প্রয়োগ করা শক্তি তাদের ভরের সমানুপাতিক। 1920 সাল থেকে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন যে মহাবিশ্বে অবশ্যই আমরা যা দেখতে পাচ্ছি তার চেয়ে বেশি পদার্থ রয়েছে, কারণ মহাবিশ্বে যে মহাকর্ষীয় শক্তিগুলি খেলছে বলে মনে হয় তা কেবল দৃশ্যমান পদার্থের চেয়ে শক্তিশালী বলে মনে হয়।
আরোও একটু পরিষ্কার করি বিষয়টা। নবম-দশম শ্রেনিতে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র ত সবাই-ই পড়েছেন নিশ্চয়ই । এটার বিস্তারিত উচ্চমাধ্যমিকের বইয়ে আরোও সুন্দর দেওয়া আছে। সেখান থেকে কিছুটা আলোকপাত করি তাহলে বিষয়টা আরোও বোধগম্য হবে।
সূত্রটি হলো:
“এই মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে এবং এই আকর্ষণ বলের মান বস্তু কণাদ্বয়ের ভরের গুণ ফলের সমানুপাতিক, এদের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক এবং এই বল বস্তুদ্বয়ের কেন্দ্র সংযোজক সরলরেখা বরাবর ক্রিয়া করে।”
এসব থেকে বুঝা যায় দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে মহাকর্ষীয় বল কমবে যার দরুন নক্ষত্রের গতিতে ভিন্নতা দেখা দিবে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গ্যালাক্সির সবগুলোর নক্ষত্রের গতি এবং ক্লাস্টার থেকে প্রায় অধিকাংশ গ্যালাক্সির গতি সর্পিল গতি। তার মানে আমাদের দেখার বাইরেও এমন কিছু আছে যা প্রভাবিত করছে পুরো মহাবিশ্বকে।
1970-এর দশকে সর্পিল ছায়াপথ পরীক্ষা করে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বাইরের প্রান্তের তুলনায় কেন্দ্রের উপাদান দ্রুত গতিতে দেখতে পাবে বলে আশা করেছিলেন। পরিবর্তে, তারা দেখতে পেল যে উভয় স্থানেই নক্ষত্রগুলি একই বেগে ভ্রমণ করছে, যা ইঙ্গিত করে যে ছায়াপথগুলিতে যা দেখা যেত তার থেকে বেশি ভর রয়েছে।
ইয়েল ইউনিভার্সিটির গবেষক পিটার ভ্যান ডককুম একটি বিবৃতিতে বলেছেন, “নক্ষত্রের গতি আপনাকে বলে যে সেখানে কতটা বস্তু আছে, তারা বস্তুর সম্পর্কে ধারণা দেয় না, তারা শুধু বলে যে এটি সেখানে আছে।”
বিভিন্ন গ্যালাক্সিতে বিভিন্ন পরিমাণে ডার্ক ম্যাটার রয়েছে বলে মনে হয়। 2016 সালে, ভ্যান ডককুমের নেতৃত্বে একটি দল ড্রাগনফ্লাই 44 নামে একটি গ্যালাক্সি খুঁজে পেয়েছিল, যা প্রায় সম্পূর্ণরূপে অন্ধকার পদার্থের তৈরি বলে মনে হয়। অন্যদিকে, 2018 সাল থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি ছায়াপথ খুঁজে পেয়েছেন যেগুলিতে অন্ধকার পদার্থের সম্পূর্ণ অভাব রয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
মাধ্যাকর্ষণ বল শুধুমাত্র ছায়াপথের নক্ষত্রের কক্ষপথকে প্রভাবিত করে না বরং আলোর গতিপথকেও প্রভাবিত করে। বিখ্যাত পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন 20 শতকের প্রথম দিকে দেখিয়েছিলেন যে মহাবিশ্বের বিশাল বস্তুগুলি তাদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে আলোকে বাঁকিয়ে এবং বিকৃত করে। ঘটনাটিকে মহাকর্ষীয় লেন্সিং বলা হয়।
কিন্তু ডার্ক ম্যাটার আসে কোথা থেকে?
স্পষ্ট উত্তর হল আমরা জানি না। কিন্তু কিছু তত্ত্ব আছে। 2021 সালের ডিসেম্বরে দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা যুক্তি দেয় যে অন্ধকার পদার্থ ব্ল্যাক হোলে কেন্দ্রীভূত হতে পারে, শক্তিশালী গেট যা তাদের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে তাদের আশেপাশের সমস্ত কিছু গ্রাস করে। যেমন, ডার্ক ম্যাটার মহাবিস্ফোরণে মহাবিশ্বের অন্যান্য সকল গঠন উপাদানের সাথে একত্রে তৈরি হত, যেমনটি আমরা আজকে দেখতে পাচ্ছি।
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ, 25 ডিসেম্বর 2021-এ 30 বছর বিকাশের পরে চালু করা হয়েছে। তার ইনফ্রারেড চোখ দিয়ে সময়ের শুরুতে দেখতে সক্ষমতা আছে। তবে এটি ডার্ক ম্যাটার সরাসরি দেখাতে সক্ষম হবে না। ওয়েবের মূল দুইটি বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য হল ছায়াপথের জন্ম ও বিবর্তন এবং নক্ষত্র ও গ্রহসমূহের সৃষ্টি সংক্রান্ত গবেষণা। এটি জ্যোতির্বিজ্ঞান ও বিশ্বতত্ত্বের সমগ্র ক্ষেত্রজুড়ে বহু বিভিন্ন ধরনের গবেষণার দ্বার উন্মোচন করেছে।
এটির সাহায্যে পৃথিবী থেকে সবচেয়ে বেশি দূরে মহাবিশ্বে বিরাজমান বস্তু ও সংঘটিত ঘটনাগুলি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। এটা দ্বারা মহাবিশ্বের প্রথম ছায়াপথ ও আদ্যনক্ষত্রগুলি কীভাবে রূপলাভ করেছিল, তা জানা যাবে। এছাড়া মানুষের বসবাসযোগ্য সম্ভাব্য বহির্গ্রহগুলির আবহমণ্ডলের বিস্তারিত খুঁটিনাটি চরিত্রায়নও সম্ভব হবে। উপরন্তু, এটি সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ, উপগ্রহগুলোর অনেক বেশী খুঁটিনাটি দেখতে সক্ষম হবে।
সম্প্রতি নাসা থেকে প্রকাশিত ছবিগুলো বেশ সাড়া ফেলেছে যেগুলো কোটি বছর আগে ছায়াপথ থেকে বিকরিত আলোর রঙিন চিত্রায়ণ করেছে।
সেদিন বেশি দূরে নয়। যেদিন বহুল আলোচিত অদেখা কিন্তু অনুমাণ নির্ভর বিশাল শক্তির অদৃশ্য আঁধার ধরা দিবে মানুষ্য দ্বারা তৈরি আধুনিক যন্ত্রে। অদম্য গবেষণা হয়তো খুলে দিবে আরোও অজানা নতুন দ্বার। যা মানুষকে আবারও শতাব্দী ধরে ভাবাবে। ভাবাবে, কিভাবে তৈরি হলো আমাদের এ মহাজাগতিক বৈচিত্র্য । সেদিন পর্যন্ত অদম্য এই পথচলার পরিসমাপ্তি না হোক।
তথ্যসূত্র: wikipedia ; space.com ; nationalgeographic.com