ডোডো পাখি (Raphus cucullatus)
“ডোডো পাখি” নামটাই কেমন অদ্ভূত, তাই না? এই পাখিটার নামটা যেমন অদ্ভূত, পাখিটা দেখতেও ছিল তেমনই অদ্ভূত। উটপাখির মতো বিশাল আকারের শরীর, সঙ্গে কবুতর কি টিয়াপাখির মতো ছোট্ট একজোড়া ডানা! ভাবছেন, এমন অদ্ভূতুড়ে একটা পাখি, পাখিটাকে তো দেখতেই হয়। আপনাদের সে আশায় গুড়ে বালি। আপনি চাইলেও পাখিটিকে দেখতে পারবেন না। কী করে দেখবেন, পাখিটি যে আর পৃথিবীতেই নেই! ১৭০০ সালের আগেই যে ডোডো পাখি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে!
দেখতে কেমন ছিল ডোডো পাখি?
ভাবছেন, এ আর এমন কি কঠিন কর্ম! পাখি দেখতে কেমন, এটা বলতে আবার সমস্যা কোথায়! আছে আছে, সমস্যা আছে, এই ডোডো পাখি যে ১৭ শতকের আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে; এখন আপনিই বলেন, এই পাখি দেখতে কেমন তা কীভাবে জানা যায়?
তবে একটা ঘটনায় এই কাজে বেশ সুবিধে হয়েছে। একবার অনেকগুলো ডোডো পাখি ইউরোপে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিলো। কেন নিয়ে এসেছিলো কে জানে, তবে চিত্রকররা তো আর এই সুযোগ হাতছাড়া করেননি, তারা ডোডো পাখিগুলোর ছবি এঁকে রেখেছিলেন। কিন্তু সমস্যা হলো, একেকজন একেকরকম করে ডোডো পাখি এঁকেছিলেন। হয় তাদের ‘মডেল’ ডোডোগুলো বিভিন্ন বয়সী ছিল, কিংবা বিভিন্ন প্রজাতির ছিল। আবার এমনও হতে পারে কারোটা মেয়ে ডোডো ছিল, কারোটা ছিল ছেলে ডোডো।
ডোডো পাখি গায়ে গতরে যে বেশ বড়োসড়ো হতো, তা তো আগেই বলেছি। হিসেব করে বললে, ওরা প্রায় সাড়ে তিন ফুট পর্যন্ত লম্বা হতো। আর এক-একজনের ওজনই হতো প্রায় ২০ কেজি। সেই তুলনায় পাখাগুলো যে অনেক ছোট্ট ছিলো, সে তো শুনেছেন। সেই পাখাগুলো বেশ হালকাও হতো। ওদের পাখা হতো সাধারণত ধূসর বা বাদামী রঙের। আর পাখার শেষভাগ একটু কোঁকড়ানো থাকতো। মাথাটা হতো ধূসর আর তাতে কোনো পালক কি পশম কিছুই থাকতো না। আর ঠোঁট ছিলো যেমন লম্বা, তেমনি রংবাহারি, সবুজ, কালো, হলুদ রং মিলে মিশে থাকতো ওদের ঠোঁটে। কতো লম্বা হতো ওদের ঠোঁট? প্রায় ২৩ সেন্টিমিটার বা ৯ ইঞ্চি! আর ওদের পা গুলো কেমন হতো জানেন? মুরগির মতো! পায়ের রং হতো হলুদ, আর নখের রং কালো। তবে দেখতে মুরগির মতো হলেও ওদের পা’জোড়া বেশ শক্তপোক্তও হতো। তা দিয়ে অবশ্য ওরা তেমন জোরে দৌড়াতে পারতো না!
ডোডো পাখির স্বভাব চরিত্রঃ
ছবি দেখে দেখে না হয় ওরা দেখতে কেমন ছিলো সেটি জানা গেলো, কিন্তু ওদের স্বভাব চরিত্র কিভাবে জানা যায়, বলেন তো দেখি? ঐ যে, লেখালেখি; তখনকার মানুষ যে শুধু ডোডো পাখির ছবিই এঁকেছিলো, তা তো নয়, ওরা ডোডো পাখি সম্বন্ধে অল্প বিস্তর লেখালেখিও করেছিলো। আর তা থেকে খুব বেশি কিছু জানা না গেলেও হারিয়ে যাওয়া এই নাদুসনুদুস পাখির স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে কিছু অন্তত জানা গেছে। এই যেমন ধরেন, ডোডোদের খাবার ছিলো মূলত ফলমূল। আর ওরা বাসা বানাতো মাটিতেই। পাখি হয়েও গাছে বাসা না বানিয়ে মাটিতে কেন বানাতো বলো তো? আরে, ওরা তো উড়তেই পারতো না, গাছের মগডালে গিয়ে বাসা বাঁধবে কি করে! তাই বেচারাদের মাটিতেই বাসা বানিয়ে থাকতে হতো। ঘাস আর খড়কুটা জোগাড় করে সেগুলো দিয়ে জঙ্গলে গাছের গোঁড়ায় বাসা বানাতো ডোডো পাখিরা। আর সেই বাসাতেই ডিম পারতো। মুরগিদের মতোই একটা একটা করে ডিম পারতো ওরা। আর ডিমগুলো আকারে হতো বেশ বড়োসড়ো, ডিমের রং হতো সাদা।
এই ব্লগগুলি পড়তে ভুলবেন না! |
ডোডো পাখির বিলুপ্তির জন্য দায়ী কে জানেন?
মানুষ! ডোডো পাখি একে তো উড়তেও পারতো না আবার দৌড়াতেও পারতো না, তার ওপর ছিলো একদম সহজ সরল। আশেপাশে মানুষ দেখলে লুকোনোরও চেষ্টা করতো না! আর মানুষও তাই মজা করে ডোডো পাখি ধরে ধরে রান্না করে খেতো। ওদের মাংস খেতে মজা ছিল না, কিন্তু ওদের পাকস্থলী আর বুকের মাংস ছিল খুবই মজার। তার ওপর তখন মরিশাসে খাওয়ার জন্য আর কোন পশুপাখিও সহজে পাওয়া যেতো না। তাই মানুষ মাংসের জন্য ডোডোদের উপরই হামলা চালাতো। আর তখনও তো মানুষ এমন কিছু সচেতনও হয়নি, যে ডোডো পাখি সংরক্ষণের জন্য কোনো উদ্যোগ নেবে। ফলাফল, ১৭০০ সালের মধ্যে পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেলো পেটুক পাখি ডোডো। মরিশাসের বিলুপ্ত পাখিদের মধ্যে অন্যতম। এই পাখির বিলুপ্তি ঘটে ১৬৬২ সালে ওলন্দাজদের হাতে।
ডোডোকে নির্বোধ পাখি বলা হয় কেনো?
প্রাথমিকভাবে এরা মানুষের সামনে আসলেও ভয়ে পালিয়ে যেতো না। এ জন্য শিকারীরা খুব সহজেই এদের পাকড়াও করতে পারতো এবং সেখান থেকেই এদের নাম হয় Dodo। ইংরেজি ভাষায় “Dodo” শব্দের অর্থ “নির্বোধ”।
গবেষকদের মতে ডোডোরা এতোটাও নির্বোধ ছিল না। ডোডোর ব্রেইনের সাইজ কবুতরের সমান-ই ছিল।
জীববিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী, ১৬৬২ সালে শেষ ডোডো পাখির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। ডোডো পাখির কঙ্কাল অত্যন্ত যত্ন সহকারে সংরক্ষিত আছে মরিশাসের জাদুঘরে। এছাড়াও ইউরোপের বিভিন্ন জাদুঘরে ডোডো পাখির বিভিন্ন হাড় সংরক্ষিত আছে। বিজ্ঞানীরা ডোডো পাখির উপর অনেক ধরনের গবেষণা চালিয়ে আসছে। এদের হাড় পর্যবেক্ষণ করে জানা যাচ্ছে অনেক অজানা কথা। বিজ্ঞানীরা এমনও আশা করছেন যে, ভবিষ্যতে হয়তো এই পাখির জিন থেকে আবার পৃথিবীর মুখ দেখবে ডোডো পাখি।
ডোডো পাখির বিলুপ্তির কাহিনী সত্যি খুব দুঃখজনক। সেই ১৭ শতাব্দী থেকে আজ পর্যন্ত হাজারো প্রজাতির পশুপাখি ডোডোর মতো মানুষের হাতে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে।