ছোটবেলায় আমরা যখন দেশপ্রেম নিয়ে রচনা লিখতাম, তখন দেশের জন্য এটা করবো, ওটা করবো কত কিছুই না করার ইচ্ছে পোষণ করতাম। কিন্তু যখন আস্তে আস্তে বড় হতে থাকি, দেশের অবস্থান আর উন্নত দেশগুলোর অবস্থানে মধ্যে পার্থক্য করতে শিখে যায় তখন আমাদের ইচ্ছেগুলোতেও পরিবর্তন দেখা দেয়। আমরা অনেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু করি বাইরের কোন উন্নত দেশে পাড়ি জমানোর এবং নিজের জীবনটা উন্নত করার।
দেশটাকে উন্নত বিশ্বের সারিতে দাঁড় করানো ইচ্ছে আমাদের অনেকের মধ্যে থাকে কিন্তু “আমার একজনের প্রচেষ্টায় কি হবে” এমন মনোভাবে আর কিছু করা হয়ে উঠে না। কিন্তু এমন মনোভাবের বিপরীতে চলা একজন মানুষ সম্পর্কে আজ আপনাদের জানাবো। যে মানুষটা আমেরিকার মতে উন্নত এক দেশে বেড়ে উঠা সত্বেও স্বপ্ন দেখে নিজের দেশের জন্য কিছু করার।এখন তিনি প্রতিনিয়ত সেই স্বপ্ন পূরণেই কাজ করে যাচ্ছেন, ছেড়েছেন তার উন্নত দেশের উন্নত জীবন।
সেই মহান মানুষটা আর কেউ না, আমার দেশের মূল্যবান সম্পদ ডঃ মাহবুব মজুমদার। ১৯৭১ সালে ঢাকায় জন্ম নেন ড.মাহবুব মজুমদার। বাবার সাথে চলে যান আমেরিকায়, বাবা মায়ের সাথে বেড়ে উঠেন সেখানেই। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি নানা ধরনের একাডেমিক প্রতিযোগিতায় তার মেধার পরিচয় মেলে। হাইস্কুল থাকাকালীনই সেরা শিক্ষার্থী হিসেবে দুইবার অর্জন করেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অ্যাওয়ার্ড। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পর্যায়ে এবং ওয়াশিংটন স্টেট পর্যায়েও ম্যাথমেটিক্স অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন কয়েকবার।
অসামান্য প্রতিভার অধিকারী ডঃ মাহবুব বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয় যুক্তরাষ্ট্রের এমআইটি থেকে স্নাতক, স্টানফোর্ড থেকে স্নাতকোত্তর, ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ থেকে পিএচডি এবং লন্ডন ইম্পেরিয়াল থেকে পোস্ট ডক্টরাল করেন। এমআইটিতে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছেন কিংবদন্তি তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর অ্যালান গুথকে। বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী অন্যতম বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তার বইতে কিছু প্রিয় শিক্ষার্থী, সহকর্মীদের কথা লিখেছিলেন। সেই মেধাবী নামগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল, মাহবুব মজুমদার।
এ অসামান্য মেধাবী মানুষটার নাম এখনোও সাধারণ মানুষের কাছে অপরিচিত। যারা একটু জানি তাও বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড দলের কোচ হিসেবে।কিভাবে তিনি কোচ হলেন,এর পিছনের গল্পও আমাদের অনেকের অজানা।
তিনি বিদেশের সকল সুযোগ সুবিধা ফেলে দেশের তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে ২০০৫ সালে ফিরে আসেন দেশের মাটিতে। বিদেশের বিলাসী জীবন ও কোটি টাকা বেতনের চাকরি ছেড়ে দেশে ফেরার পর ড.মাহবুব মজুমদার চেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে। কিন্তু শুনতে খারাপ লাগলেও সত্য এটাই যে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগ দেয়া হয়নি।
এরপর নিজ উদ্যোগেই গনিত উৎসব ও আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য বাংলাদেশ দল গঠনের প্রতি সদ্যপ্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডঃ জামিলুর রেজা চৌধুরীর সাথে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তাঁর নিরলস পরিশ্রম ও অভিনব প্রশিক্ষণের ফলে গত ১৫ বছরে বাংলাদেশের ঝুলিতে এসেছে ২৮টি ব্রোঞ্জ পদক, ৭টি রৌপ্য পদক ও একটি স্বর্ণপদক। তার প্রচেষ্টায় এবছরই বাংলাদেশ প্রথমবারের মতন অংশগ্রহণ করে ইউরোপিয়ান গার্লজ ম্যাথমেটিকাল অলিম্পিয়াড-২০২১ এ।
মেয়েদের জন্য আয়োজিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই অলিম্পিয়াডে প্রথমবার অংশ নিয়ে রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ জিতে নেয় বাংলাদেশের মেয়েরা। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের সাফল্যের মূল কারিগর মাহবুব মজুমদার।
২০১৮সালে ড.মাহবুব মজুমদার তাঁর এক আর্টিক্যালে লিখেন,বাংলাদেশে যখন গণিত অলিম্পিয়াড শুরু হলো, আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের প্রশ্ন দেখে দেশের অনেক বিখ্যাত গণিতবিদ বলেছিলেন, আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা কোনো দিন স্বর্ণপদক পাবে না। এমনকি ৬টি প্রশ্নের মধ্যে ১টিও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা সমাধান করতে পারবে কি না, সে ব্যাপারেও সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন কেউ কেউ।
জাওয়াদের স্বর্ণপদক প্রমাণ করে দিয়েছে, আমাদের ছেলেমেয়েদের ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি জাওয়াদ যে বিরল মেধাবীদের একজন, তা–ও নয়। জাওয়াদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আমরা সব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ মানের সেবা দাবি করতে পারি। শিক্ষা, শিক্ষার অবকাঠামো কিংবা অন্য যেকোনো খাতেই এই দাবিতে অনড় থাকা উচিত।
স্বেচ্ছাসেবক, তরুণ এবং কিছু নিরহংকার মানুষের পরিশ্রমে বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াড পরিচালিত হয়। মানের দিক থেকে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না বলেই দেশসেরা মানুষেরা এই আয়োজনের সঙ্গে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন। উদ্যমী মানুষদের কাজে লাগাতে পারলেই জাতি হিসেবে আমরা অনেক দূর যেতে পারব।
এ থেকেই বোঝা যায় কোনোরকম ব্যাক্তিস্বার্থ বা সুবিধাগ্রহণ ছাড়াই তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের উন্নতির জন্য,তাও বিনামূল্যেই। শুধু তাই নয়, প্রফেসর মজুমদারের প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের মেধাবী ও পদকজয়ী শিক্ষার্থীরা বৃত্তি নিয়ে পড়তে গিয়েছে এমআইটি, অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, স্ট্যানফোর্ড, প্রিন্সটন-এর মতো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।
বর্তমানে ড.মাহবুব মজুমদার নিয়োজিত আছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ ডেটা আন্ড সায়েন্সেস-এর ডিন ও অ্যাকাডেমিক স্ট্যান্ডার্ডের অ্যাসোসিয়েট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে। শুরু থেকেই শিক্ষা কারিকুলাম ও মূল্যায়ন ব্যবস্থায় উন্নতি ও আধুনিকায়নে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। তার পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয়টির স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এখন অভিজ্ঞ অধ্যাপক ও গবেষকদের কাছে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ক্যাটাগরি থিওরি, টপলোজির মতো বিষয়গুলোতে অ্যাডভান্সড ক্লাসগুলো করতে পারছে।
মহামারির এই চরম সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা যাতে ব্যাহত না হয় তাই ড.মাহবুব তার সহকর্মীদের সহায়তায় তৈরি করেন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম buX, যা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম। যেকোনো বিষয়ে শিক্ষার্থী থেকে শিক্ষক যে কেউই তার সাথে আলাপ করতে পারে বন্ধুর মতো। সবসময় শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেন গ্রেড নয়, বরং জ্ঞানার্জনের দিকে মনোযোগ দিতে।
এই ব্লগ পড়তে ভুলবেন না ! |
নিজের ব্যক্তিগত অর্জন বা কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলা একেবারেই পছন্দ করেন না ড.মাহবুব মজুমদার। তবে তরুণ প্রজন্মকে গড়ে তোলার সাধনায় শুরু থেকেই সম্মুখীন হয়েছেন নানান প্রতিকূলতার। সেসব বাধা ও বাধাপ্রদানকারীদের নিয়েও কথা বলতে পছন্দ করেন না তিনি।এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে,ওনার মতো একজন মানুষ এতো সুযোগ সুবিধা ছেড়ে দেশে আসলো কেন??
এর উত্তরও তিনি দিয়েছেন কয়েকবছর আগে একটি ইন্টারভিউতে।তিনি বলেছিলেন,
“ক্যারিয়ারটা আসলে কী? আমি যদি এমআইটির একজন প্রফেসর হই বা নোবেল প্রাইজও পাই,তবুও সেটা হবে শুধুই একটা নিজস্ব অর্জন। আমার দেশের তরুণ প্রজন্মকে যদি তৈরি করতে পারি, সেটাই হবে আমার সত্যিকারের সাফল্য।
এমন একজন মানুষকে কেমনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপক হিসেবে রাখতে নারাজ।অথচ এই মানুষটা পেতে কত দেশ অপেক্ষায় বসে আছে। সৌদি সরকারের কাছ থেকে ড.মাহবুব মজুমদার এর কাছে চিঠি আসে সৌদি আরবের গনিত অলিম্পিয়াড দলকে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ওরা মাহবু্বকে চায়। ডঃ মাহবু্ব তাদের চিঠির উত্তরে বলেছিলেন” আমি বাংলাদেশেই থাকব”।
আমার মতে, যারা সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিক হতে চায়, দেশের জন্য কিছু করতে চায় তাদের জন্য ড.মাহবুব অনন্য এক উদাহরণ।
সোর্সঃ
https://roar.media/bangla/main/biography/life-and-work-of-prof-dr-mahbub-majumdar
https://engineersdiarybd.com/mahbub-mojumder/