প্রথম বারের মত মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে তৈরি হবে অক্সিজেন। “আমাদের নীল গ্রহ পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য অক্সিজেন এখনো যথেষ্ঠ পরিমাণে আছে, কিন্তু মানব জাতি শুধুমাত্র এই নীল গ্রহেই সীমাবদ্ধ থাকতে চায়না, সম্ভাব্য অসীম এই মহাবিশ্ব হয়ত পুরোটা ঘুরে দেখা মানব জাতির পক্ষে কখনোই সম্ভব হবেনা, বা হলেও কবে তা অজানা। কিন্তু অনন্ত এই মহাবিশ্বে বিচরন করবে মানুষ, এর শুরুটা হয়েছিল সফলভাবে মানুষের চাঁদে পৌঁছানোর মাধ্যমে, এখন লক্ষ্য আরো দূরে, নিজ গ্রহ ছেড়ে যেতে হবে মঙ্গলে তবেই নিজেদের ইন্টার প্লানেটারি সিভিলাইজেশন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারব যা মানব সভ্যতাকে আরো এক ধাপ উন্নত করবে “
এই লক্ষ্যেই মঙ্গলে পাঠানো হয়েছে কিছু রোভার যেগুলো মানুষ যাওয়ার আগেই পরখ করে নিচ্ছে অচেনা এই লাল গ্রহটাকে, সর্বশেষ গত ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২১ এ নাসার পাঠানো রোভার পারসিভিয়ারেন্স মঙ্গলে সফলভাবে অবতরণ করে, এই রোভার কে অনেকগুলো নির্দিষ্ট কাজের জন্য পাঠানো হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে মঙ্গলের কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে অক্সিজেন উৎপাদন।
মানুষের মঙ্গলে বসবাসের জন্য প্রধান একটি উপকরন হচ্ছে অক্সিজেন, আর পারসিভিয়ারেন্স রোভার এ থাকা স্বর্ণ আবৃত এক জাদুর বাক্স মঙ্গলে তৈরি করবে অক্সিজেন।
আসলে কোন জাদু টাদু নেই, এই বক্স টিকে বলা হয় MOXIE যার পূর্ণরূপ Mars Oxygen ISRU Experiment , আর MOXIE স্বর্ণ দ্বারা আবৃত কারণ, অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য এর ভেতর যে তড়িৎ বিশ্লেষণ বিক্রিয়া ঘটবে এর জন্য উচ্চ তাপমাত্রা(৮০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস) প্রয়োজন এবং সেই তাপমাত্রায় যেন রোভার ক্ষতিগ্রস্থ না হয় তাই বাইরের দিকে আবরণ হিসেবে স্বর্ণ ব্যবহার হয়েছে যা তাপ নিরোধক এর কাজ করবে।
মঙ্গলের বায়ুমন্ডলের ৯৬ ভাগ ই হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড, MOXIE মঙ্গলের বায়ুমন্ডল থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করবে এবং তড়িৎ-বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সেই কার্বন ডাই-অক্সাইড ভেঙে ফেলবে, যাতে করে আলাদা ভাবে মুক্ত হবে এক অণু কার্বন মনো-অক্সাইড এবং দুই অণু অক্সিজেন। এভাবে প্রতি ঘন্টায় প্রায় ১০ গ্রাম অক্সিজেন উৎপন্ন করতে পারবে, মূলত পরীক্ষামুলক ভাবে এটির দ্বারা নাসা মঙ্গলে অক্সিজেন উৎপাদন করবে, পরবর্তীতে এর চেয়ে ২০০ গুণ বড় MOXIE মঙ্গলে পাঠানোর পরিকল্পনা আছে সেখানকার বায়ুমন্ডলে অক্সিজেন বৃদ্ধির লক্ষ্যে।
” MOXIE নামক ১৭ কেজি(পৃথিবী) বা ৬ কেজি(মঙ্গল) ওজনের বাক্সটি পারসিভিয়ারেন্স রোভারের পেটের দিকে অবস্থিত। এটা কাজ করার জন্য ৩০০ ওয়াট শক্তির প্রয়োজন হয়, যা রোভারের ব্যাটারি হতে পাবে (রোভারের ব্যাটারি সোলার প্যানেলের সাহায্যে সূর্যের আলো থেকে চার্জ হয়)। এবং এটা সর্বক্ষণ চালু থাকবেনা, সাধারণত প্রতি মাসে এক থেকে দুইটি এক্সপ্যারিমেন্ট করা হবে, প্রতিবার এক ঘন্টা করে চালানো হবে এটি “
এবার একটু দেখা যাক এটা কাজ করে কিভাবে, The Martian মুভিটা যদি দেখে থাকেন সেখানে অক্সিজেনেটর নামক একটি যন্ত্রের কথা বলা হয় যা সেখানে অক্সিজেন উৎপন্ন করে, কিন্তু সেটা ঠিক কিভাবে কাজ করে তা মুভিতে স্পস্ট করে বলা হয়নি, সম্ভবত সেটা MOXIE এর মতই কিছু ছিল।
MOXIE তে মূলত যে প্রযুক্তি ব্যবহার হয়েছে একে বলে সলিড অক্সাইড ইলেক্ট্রোলাইসিস বা তড়িৎবিশ্লেষণ।
” এক্ষেত্রে একটি দ্রবণ কে উচ্চ তাপমাত্রায় নেয়া হয় যেন এর অনুগুলো আলাদা হয়ে যায়, তারপর এর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ পরিচালনা করা হয়, যার ফলে এর মধ্য দিয়ে ইলেক্ট্রণ প্রবাহিত হয়, এতে দুইটি প্রান্ত থাকে যার একটি দিয়ে ইলেক্ট্রন বের হয় এবং অন্য পান্তে প্রবেশ করে, প্রান্ত দুটিকে ইলেক্ট্রোড বলা হয় এবং যথাক্রমে ঋনাত্নক আধানযুক্ত ইলেক্ট্রোড দিয়ে ইলেক্ট্রন এসে ধনাত্নক আধানযুক্ত ইলেক্ট্রোডে প্রবেশ করে এভাবে ইলেক্ট্রন প্রবাহ চলতে থাকে, ধনাত্নক ইলেক্ট্রোড কে বলে এনোড এবং ঋণাত্নক ইলেক্ট্রোডকে বলে ক্যাথোড, এর ফলে ধনাত্নক আধানযুক্ত অনুগুলো ক্যাথোড এর দিকে আসে আর ঋণাত্নক আধানযুক্ত অনুগুলো এনোডের দিকে চলে যায়। এতে করে একটি মৌলের মধ্যে থাকা ভিন্ন অণু আলাদা হতে পারে”
MOXIE প্রথমে মঙ্গলের বায়ুমন্ডল হতে একটি হাতলের দ্বারা বাতাস গ্রহণ করবে, এটা তেমন কিছুনা, আমাদের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার যেভাবে বাতসা টেনে নেয় অনেকটা এভাবেই পাম্পের সাহায্যে বাতাস ভেতরে টেনে নেয়, তবে এতে ফিল্টার দেয়া আছে যেন মঙ্গলের ধুলাবালি ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে, পরবর্তীতে সেই বাতাসকে সংকুচিত করবে, এর জন্য MOXIE এর ভেতরে আছে কম্প্রেসর, কারণ মঙ্গলের বায়ুমন্ডল আমাদের পৃথিবীর চেয়ে অনেক হালকা তাই বিক্রিয়ার আগে একে পৃথিবীর মত ঘন করার জন্য সংকুচিত করে নিতে হবে।
তারপর এই Co2 প্রবেশ করবে ইলেক্ট্রোলাইসিস সিস্টেমে যেখানে ৮০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় তড়িৎ-বিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় Co2 ভেঙে কার্বন এবং অক্সিজেন হিসেবে আলাদা দুটি রাস্তা দিয়ে উন্মুক্ত হবে যা মঙ্গলের বায়ুমন্ডলে ছড়িয়ে যাবে। (তড়িৎ-বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে উপরে সংক্ষেপে বলা হয়েছে) , এটিই হবে মঙ্গলে প্রথম বারের মত অক্সিজেন উৎপাদন।
এভাবেই বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে তড়িৎবিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় পানি ভেঙে অক্সিজেন উৎপন্ন করা হয় আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে, তাই নাসা প্রথমে ভেবেছিল যেহেতু মঙ্গলে জমাট বরফ আছে তাই সেই বরফ গলিয়ে পানি থেকে তড়িৎবিশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন উৎপন্ন করবে, কিন্তু এতে মঙ্গলের ভূপৃষ্ঠ হতে বরফ সংগ্রহ একটি কঠিন কাজ হয়ে দাড়াত, তারপর ভাবা হয়েছিল ক্যাপসুলের ভেতর গাছ লাগিয়ে সেগুলো হতে অক্সিজেন উৎপাদন করা কিন্তু গাছ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষন করে অক্সিজেন উৎপন্ন করত সেই একই কাজটি MOXIE করবে এবং কোন ঝামেলা ছাড়াই।
লেখকের এই লেখাটি পড়তেও ভুলবেন না, ক্লিক করুন এখানে। |
এটি যেহেতু পরীক্ষামুলক ভাবে করতে যাচ্ছে আশা করি সফলতার পর, ভবিষ্যতে প্রচুর পরিমাণে এরকম MOXIE মঙ্গলের ভূমিতে স্থাপন করা হবে যেগুলো ধীরে ধীরে মঙ্গলের কার্বন ডাই-অক্সাইড কে অক্সিজেনে রূপান্তর করবে এবং লাল গ্রহ হয়ে উঠবে আমাদের বসবাসের উপযোগী।
সবশেষে কারো যদি প্রশ্ন জাগে মঙ্গল পরে আগে পৃথিবীর কার্বন ডাই-অক্সাইড এর কিছু অক্সিজেনে রুপান্তর করুক এটা দিয়ে। এক্ষেত্রে আরো সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে, MOXIE কাজ করার জন্য প্রয়োজন বিদ্যুৎ শক্তি, এটা যতটুকু কার্বন ডাই-অক্সাইড কে ভেঙে অক্সিজেন উৎপন্ন করবে, এর বিদ্যুৎ যোগান দেয়ার জন্য সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে যদি বিদ্যুৎকেন্দ্রে আরো বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়ে যায় তাহলে আর কমানো যাবে কিভাবে।
তবে যদি সম্পূর্ণ সৌরশক্তি বা অন্যভাবে এর বিদ্যুৎ যোগান দেয়া যায় যাতে কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন না হয় তাহলে এটা ব্যবহার করে পৃথিবীর কার্বন ডাই-অক্সাইড কিছুটা কমিয়ে অক্সিজেন বাড়ানো সম্ভব হতে পারে।