অন্যান্য যতগুলো প্রাণীর মধ্যে গৃহপালিত পশুর বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায় তাদের থেকে কিন্তু শিয়াল অনেকটাই আলাদা। আর এটি এতটাই রহস্যময় যে এই শিয়াল নিয়ে চলেছে বিশাল সময় ধরে গবেষণাও।
বংশগতিবিদ্যা বা জেনেটিকস এর যতগুলো পরীক্ষা হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত হচ্ছে “শিয়াল গৃহপালিতকরণ পরীক্ষা”। এই পরীক্ষাটি চলেছিল প্রায় ছয় দশক জুড়ে। ১৯৫০ সালে দিমিত্রি বেলায়েভ তখনকার শিয়ালগুলো আসলে গৃহপালিত পশুতে পরিণত হচ্ছে কিনা সেটা যাচাই করার জন্য প্রায় ১৩০ টি সিলভার ফক্সকে নিয়ে তার ইন্সটিটিউটে পরীক্ষা চালান।
সাধারণত মেন্ডেলের বংশগতিবিদ্যা থেকে আমরা জানি আমাদের জিনে যে বৈশিষ্ট্যগুলো থাকবে সেগুলোই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের দিকে ধাবিত হবে। কিন্তু বেলায়েভ ভেবেছিল, এমনটাই যদি ঘটে থাকে তাহলে তো সব শিয়ালই বন্য হবে, এমন কি হতে পারে যে শিয়ালগুলোকে কুকুরের মতো ট্রেনিং দিলে তাদের আচরণে পরিবর্তন হবে আর সেই আচরণের পরিবর্তনগুলোই পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হবে?
ঠিক সেজন্যই তিনি রেড ফক্সের মেলাটোনিন ভ্যারিয়েন্ট সিলভার ফক্স নিয়ে তার পরীক্ষা শুরু করেন। তিনি যে সংখ্যক শিয়ালের আচরণে কোমলতা দেখেন তার কেবল ১০% কে তিনি প্রজননের জন্য বাছাই করেন। তিনি অবশ্য প্রথমদিকে সেসব শিয়ালগুলোকে নিয়েই পরীক্ষা শুরু করেছিলেন যাদের মধ্যে অন্যান্য শিয়ালদের থেকে ক্ষুব্ধ হওয়ার প্রবণতা তুলনামূলক কম।তবে পরবর্তীতে তিনি ঠিক এর বিপরীত বৈশিষ্ট্যের শিয়াল নিয়েও পরীক্ষা চালিয়ে যান।
পরীক্ষার সময়ে তিনি দেখেন শিয়ালগুলো তার প্রভুর গাল চেটে দেয়া,প্রভুকে দেখামাত্র লেজ নাড়ানো বা প্রভুকে কাছে না পেলে কুকুরের মতো গোঙানির শব্দ করে। সাধারণত গৃহপালিত পশুগুলোর বিভিন্ন প্রজাতিগুলো নিজেদের মধ্যে শরীরের আকারে পরিবর্তন, পশমের রঙ ,নিম্নগামী কান, দীর্ঘ প্রজনন চক্র, লেজের বক্রতা ইত্যাদি এমন কিছু কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। যেগুলো ডারউইন ডমেস্টিকেশন সিনড্রোম হিসেবে অনেক বছর আগেই ধারণা দিয়েছিলেন ।
দিমিত্রি তার পরীক্ষার এক দশকে খেয়াল করলেন তিনি প্রাণীগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখতে পারছেন। তিনি দেখতে পান প্রাণীগুলোর স্ট্রেস হরমোন অন্যান্য বন্য শিয়ালদের প্রায় অর্ধেক পরিমাণে নেমে এসেছে। এড্রেনালিন গ্রন্থি ছোট হয়ে আসছে এবং যত প্রজন্মের সংখ্যা বাড়ছে ঠিক ততোই সেরোটোনিনের পরিমাণ বাড়ছে আর এই কারণেই দিনকে দিন তারা আক্রমণাত্মক থেকে আনন্দময় প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে তো মেন্ডেলের এক প্রজন্মের জীনের তথ্যগুলো পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হয় এ ধারণা ফিকে হয়ে গেল! আজ্ঞে না, কোন প্রাণীকে শিখিয়ে নেওয়া আচরণ তার হরমোন এবং নিউরোক্যামিকেলে যে পরিবর্তন ঘটায় তা প্রাণীটির এনাটমি ও ফিজিওলজিতে জড়িত হতে পারে। আর সে কারণেই সেটি পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত হতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।
ধরে নিতে পারেন হয়তো আমাদের এখনকার শখের পালিত শিয়ালগুলোকে তবে আমরা মানবজাতিরাই ট্রেনিং দিয়ে বন্য থেকে সভ্য করেছি। হ্যাঁ, আগে হলে হয়তোবা এই বিশ্বাসেই আমরা বাস করতাম। তবে এখন প্রশ্ন এসেছে যেহেতু বেলায়েভ সাহেব প্রথম থেকেই এমন শিয়ালগুলোকে বাছাই করেছিলেন যারা আগে থেকেই কম ক্ষুব্ধ,কম আক্রমণাত্মক,ভীত এবং যাদের লোমে আগে থেকেই কিছুটা পরিবর্তন ছিল তাহলে এটাও হতে পারে সেই পরীক্ষাটি সঠিকভাবে হয়নি। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, যেকোন পরীক্ষা নিরপেক্ষভাবে করার জন্য অনেক বিপুল সংখ্যক পরীক্ষায় ব্যবহৃত প্রাণী বা বস্তু নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে কিন্তু বেলায়েভের পরীক্ষায় সেই সংখ্যাটিও খুব সামান্য।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!! রায়চৌধুরী ইকুয়েশনঃ সিঙ্গুলারিটির সমাধানে এক বাঙ্গালি বিজ্ঞানী ব্ল্যাকহোলে আশার আলো: পোনরোজের নোবেল বিজয় |
এছাড়াও বর্তমানে দেখা গেছে যেসকল শিয়াল গ্রামাঞ্চলে বা বন রয়েছে এমন জায়গায় বাস করে তাদের সাথে যেসকল শিয়াল শহুরে পরিবেশে বাস করে তাদের আচরণ, দৈহিক গঠনে বিস্তর পরিবর্তন রয়েছে। দেখা যায় বন্য পরিবেশের চাইতে শহুরে পরিবেশের শিয়ালগুলির মাথার খুলির গঠন বেশী মজবুত ও দৃঢ় এবং বন্য শিয়ালের চাইতে শহুরে শিয়ালের চেহারার আকার-আকৃতি তুলনামূলক ছোট এবং কোমল। শহুরে শিয়ালগুলো খুব দ্রুত দৌড়াতে পারে এবং এটা হতে পারে ময়লা- আবর্জনা থেকে সুযোগ পেলেই খুব কম সময়ের মধ্যে খাবার সংগ্রহ করতে হয় বলে।
এভাবে এই দুইরকম বৈশিষ্ট্যের কারণে বিজ্ঞানীরা আজো সন্দেহ পোষণ করছেন আদৌ ডমেস্টিকেশন সিনড্রোম আছে কিনা।এমনও হতে পারে শিয়াল নিজেরাই নিজেদের প্রজন্মে প্রতিনিয়ত বিবর্তন ঘটিয়ে আজকের সহনশীল,ভীত,প্রভুভক্ত প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। এই রহস্যের বিভেদ হতে হয়তোবা অপেক্ষা করতে হতে পারে আরো কয়েক দশক।