বর্তমান বিশ্বে মহামারি পরিস্থিতির শুরুতে যে প্রাণীটি সবচাইতে বেশি আলোচনায় এসেছিলো সেটি হচ্ছে বাদুড়। বাদুড় প্রকৃতপক্ষে এর জন্য সরাসরি দায়ী নয় বরং বনরুই কে বাদুড় ও মানুষের মাঝে ভাইরাসের যোগসূত্র হিসেবে ধারণা করা হচ্ছে।
বাদুড় হচ্ছে একটি নিশাচর স্তন্যপায়ী প্রাণী। এরাই একমাত্র প্রজাতি যারা উড্ডয়ন ক্ষমতা সম্পন্ন হয়েও পক্ষীকূলের অন্তর্ভুক্ত নয়। পৃথিবীতে প্রায় ১১০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে এবং এরা সমস্ত স্তন্যপায়ীদের ২১ শতাংশ। এদের অধিকাংশ প্রজাতিই পতঙ্গভুক, বাকীরা ফলমূলের উপর নির্ভরশীল। বাদুড় ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন হলেও একেবারেই যে চোখে দেখে না, তা ভুল ধারণা। এরা প্রায় ২০ কিলোহার্জ শব্দ অর্থাৎ আল্ট্রাসাউন্ড উৎপন্ন করতে সক্ষম।
বাদুড়ের কিছু অসাধারণ পরাশক্তি(Superpower) রয়েছে যা উল্লেখযোগ্য। এদের এই পরাশক্তি আচরণই তাদের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে যা আমাদের জন্যেও উপকারী। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা পরিবেশবান্ধবও বটে।
উল্লেখযোগ্য পরাশক্তিসমূহ (Superpowers):
- সুপারপাওয়ার-০১ঃ একমাত্র উড়ন্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী (Flying mammals)
মানুষ, গরু, ছাগল ইত্যাদির মত বাদুড়ও একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। তবে এদের বিশেষত্ব এই যে, তারা উড্ডয়নে(Flying) সক্ষম। তারা পক্ষীকূলের চাইতে ভালো উড়তে পারে। তাদের প্রসারিত ডানা তাদের বিভিন্ন দিকে যেতে সাহায্য করে এবং কম শক্তি ব্যয়ে উপরের দিকে (Lifting) উঠতে সাহায্য করে। ডানাটি যদিও চামড়ার তৈরি !
- সুপারপাওয়ার-০২ঃ উপুড় হয়ে ঝুলে থাকা বা যুক্ত থাকা (Hang upside down)
উড্ডয়নের পাশাপাশি এরা উপুড় হয়ে ঝুলে কিংবা আটকে থাকতে পারে কোন ডালে অথবা আশ্রয়স্থলে। স্বভাবত যে কোন প্রাণীর পক্ষে উপুড় হয়ে কোন স্থানে আটকে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু বাদুড় এই পজিশনে (Hang upside down) নিদ্রা যেতে পারে কিংবা শীতযাপন (Hibernate) করতে পারে বিনা দ্বিধায় এবং তারা সেখান থেকে পড়েও যায় না। এই বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বনের পেছনে বিশেষ কারণ হলো এই যে, তারা তাদের ডানাগুলিকে প্রসারিত রাখতে পারে এবং বিপদের মূহুর্তে উড্ডয়নের সময় স্পষ্ট দৃষ্টি ও শব্দের ভিত্তিতে সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করতে পারে।
- সুপারপাওয়ার-০৩ঃ ধারালো দাতেঁর অধিকারী (Razor-sharp teeth)
ফল, কীটপতঙ্গ, ব্যাঙ ও রক্ত খাওয়ার জন্য ধারালো দাতেঁর প্রয়োজন এদের। ভ্যাম্পায়ার বাদুড়ের তিনটি প্রজাতি রয়েছে যারা রক্তের উপর নির্ভরশীল বলা যায় এরা “রক্তের তরল ডায়েটের” উপর টিকে আছে। প্রচলিত মিথগুলিতে মূলত আপনি যে ভ্যাম্পায়ার সম্পর্কে পড়ে থাকেন তাতে তারা রক্তচোষা নয়। মধ্য এবং দক্ষিণ আমেরিকায় ভ্যাম্পায়ার বাদুড়ের শিকারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গরু, শূকর এবং ঘোড়া। এদের ধারালো খাজঁযুক্ত দাত দিয়ে এরা যখন শিকার আক্রমণ করে তারা প্রায় আধ ঘন্টায় উক্ত শিকারের রক্তের ওজনের অর্ধেক পান করতে সক্ষম। ভ্যাম্পায়ারের লালায় ড্র্যাকুলিন নামক বিশেষ পদার্থ শিকারের রক্ত বিনা জমাট বাধায় অবাধে প্রবাহিত করতে সহায়তা করে।
- সুপারপাওয়ার-০৪ঃ সুপার নাক (Super Nose)
ভ্যাম্পায়ার বাদুড়ের নাকে তাপ-সেন্সর (Heat sensor) রয়েছে যা শিকারকে কামড়ানোর সঠিক জায়গা নির্ধারণে সহায়তা করে। ভ্যাম্পায়ার বাদুড়েরা উড্ডয়নের পাশাপাশি একপায়ে লাফ, হামাগুড়ি দিতে পারে। এছাড়াও এরা শিকারকে মাটি থেকে আঘাত করতে পারে। তবে কোন শিকারের ক্ষেত্রে সুবিধা করতে না পারলে তারা একপায়ে লাফ(Hop) পদ্ধতি অবলম্বনে আত্মরক্ষা করে থাকে।
- সুপারপাওয়ার-০৫ঃ প্রতিধ্বনির সাহায্য পথচলা ও শিকার ধরা (Echolocation)
বেশিরভাগ বাদুড় রক্তচোষা নয়। এরা পতঙ্গভুক অর্থাৎ পতঙ্গের উপর নির্ভরশীল। একটি বাদুড় ১ ঘন্টায় প্রায় ৬০০-১০০টি পতঙ্গ ভক্ষণে সক্ষম। বাদুড় নিশাচর প্রাণী তাই এদের চলাচল রাতের বেলায়। তবে, প্রশ্ন জাগে না এই অন্ধকারে তারা কীভাবে এই কীটপতঙ্গ শিকার ধরে বেড়ায়?
এরা আলট্রাসাউন্ড বা শব্দোত্তর তরঙ্গ (প্রায় ২০ কিলোহার্জ) সৃষ্টি করে এবং প্রতিধ্বনির মাধ্যমে শিকার খুঁজে পায়। এরা চলনের সময় প্রচুর আল্ট্রাসাউন্ড তৈরী করে থাকে এবং এই শব্দ প্রতিবন্ধকে বাধা পেয়ে শিকারের অবস্থান, দূরত্ব কিংবা আকার বুঝতে সাহায্য করে।
- সুপারপাওয়ার-০৬ঃ শীতযাপন (Hibernation)
শীতকালে পোকামাকড় কমে যাওয়ায় বাদুড়ের খাদ্যাভাব সৃষ্টি হয় এবং এই প্রতিকূলতা দূর করতে এরা এই বিশেষ পদ্ধতি (Hibernation) অবলম্বন করে থাকে। এক্ষেত্রে গুহার দেয়াল কিংবা সিলিংয়ে কয়েক হাজার বাদুড় একত্রে একগুচ্ছে অবস্থান করে থাকে। এরা বলের মত কুকড়ে যায় এবং দীর্ঘ ছয় মাস অব্দি গভীরনিদ্রায় চলে যায়। এই সময়ে এরা মাত্র কয়েক গ্রাম সঞ্চিত চর্বি নিয়ে টিকে থাকে। এক্ষেত্রে তাদের শরীরের তাপমাত্রা হ্রাস পায় এবং হার্টবিট মিনিটে ২০ টি হয়ে যায়। পরবর্তীতে বসন্তে এরা কাপুঁনি দিয়ে জেগে উঠে ও এদের ওজন হ্রাস পায়।
এই সুপারপাওয়ার কিংবা পরাশক্তিসম্পন্ন প্রাণীটি পরিবেশবান্ধব হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
বাদুড় বিভিন্ন রোগ বহনকারী ও ফসলের জন্য ক্ষতিকারক পোকামাকড় ধ্বংস করে থাকে এবং পরিবেশবান্ধব হিসেবে কাজ করে। একটি শহরে এক রাতে বাদুড়রা প্রায় ৩০,০০০ পোকামাকড় ভক্ষণ করতে পারে। এছাড়াও ঘন্টায় প্রায় ৬০০ মশা সাবাড় করতে পারে। কৃষকদের একটি নিখরচায় পরিষেবা হিসাবে এটি আমাদের অর্থনীতিতে ফিরে আসা আনুমানিক ৩ বিলিয়ন ডলার সমতুল্য।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না!! যক্ষ্মা এর জীবাণু যখন ড্রাগ রেজিস্ট্যান্টঃ MDR-TB ও XDR-TB |
বিভিন্ন ফুল-ফল খেয়ে বাদুড়েরা পরোক্ষভাবে পরাগায়ন কিংবা বীজ স্প্রেডার (Seed spreader) হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষত আম, পীচ ও স্যাপোডিলা গাছের পরাগায়নে ভূমিকা পালন করে। এছাড়া বাদুড়ের মল প্রাকৃতিক সার হিসেবে কাজ করে থাকে যা পরিবেশের পক্ষে উপকারী ও রাসায়নিক সারের বিকল্প।
অর্থাৎ বাদুড় ই আমাদের অন্যতম পরিবেশবান্ধব ও Superpower সম্পন্ন প্রাণী। তবে এক সমীক্ষায় দেখা যায় বিশ্বের প্রায় এক-চতুর্থাংশ বাদুড় বিলুপ্তির আশংকা করা যাচ্ছে। তাই এদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার পূর্বেই এদের আবাসস্থল রক্ষা করা প্রয়োজন।