আমাদের পৃথিবীর সকল শক্তির উৎস সূর্য। সূর্যের আলো ও তাপ ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব ছিল না। সূর্যের আলোর কারণেই পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা হয়েছে।
কিন্তু আজ থেকে প্রায় 4.57 বিলিয়ন বছর আগে আমাদের সৌরজগতের কোন অস্তিত্ব ছিল না। পুরো মহাবিশ্বে তখন বিক্ষিপ্ত ভাবে ছিলো অসংখ্য নেবুলা, গ্যালাক্সি, সুপারনোভা ও ছায়াপথ। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে ঘুরে বেড়ানো অসংখ্য গ্যাস ও ধূলিকণাকে নেবুলা বলে। নেবুলার বেশিরভাগ পদার্থ ছিল হাইড্রোজেন হিলিয়াম অতিসামান্য ভারী মৌল। তারপর হঠাৎ করেই নেবুলার মহাকর্ষীয় পতন ঘটে, ধারণা করা হয় অন্য কোন নক্ষত্রের প্রভাবে বা “সুপারনোভা” থেকে আসা শকওয়েভ-ই এই পতনের জন্য দায়ী।
এই পতনের ফলে ধূলিকণা ও গ্যাস একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় হয়, এবং এর সাথে সাথে নেবুলার কেন্দ্রে ভর জমা হতে থাকে। সময়ের সাথে সাথে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে কেন্দ্রটি আরো ভর নিজের দিকে টেনে নিয়ে গোলাকার বস্তুতে পরিণত হয় এবং ভরবেগের সংরক্ষণশীলতার কারণে এটি ঘুরতে শুরু করে এবং ভর বৃদ্ধির সাথে সাথে এর চাপ ও তাপ বৃদ্ধি পায়। নেবুলার প্রায় ৯৯.৯৮ শতাংশ এই গোলাকার বস্তুটির সাথে যুক্ত হয়। বাকি পদার্থগুলো চ্যাপ্টা এবং ডিস্কের মতো আকারে এর চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে ও “প্লোটোপ্লাটিনারি” ডিস্কে পরিণত হয়।
পরবর্তীতে এই ডিস্কগুলো থেকে গ্রহ ও সৌরজগৎ এর বিভিন্ন নানা জিনিসের উদ্ভব ঘটে। কেন্দ্রের গোলাকার বস্তুটি পরবর্তী এক লক্ষ বছর পর্যন্ত প্রোটোস্টার হিসেবে থাকে এবং ভর অধিগ্রহণ করতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত গোলাকার বস্তুরটির কেন্দ্রে চাপ ও তাপের প্রভাবে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া শুরু না হয়। পরবর্তী কয়েক মিলিয়ন বছরের মধ্যে এটি নির্দিষ্ট আকার ধারণ করে ফলে জন্মায়
সূর্য।
সূর্যে সংঘটিত নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়াঃ
সূর্যে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া ঘটে এবং তাপ ও শক্তি নির্গত হয়। সাধারণত নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় যুক্ত থাকা পরমাণুর ভারী নিউক্লিয়াস ও দুটি হালকা পদার্থ একত্রিত হয়ে তৈরি করে একটি ভারী পদার্থ। শক্তির নিত্যতার সূত্র অনুযায়ী শক্তি কোন সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই। শক্তি কেবল এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। সূর্যের নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া সংঘটিত হয় হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম এর মাধ্যমে। এক্ষেত্রে আমরা হাইড্রোজেনের আরো দুইটি আইসোটোপ, ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়ামকেও অংশ নিতে দেখতে পাই।
আমরা জানি, হাইড্রোজেন সরল প্রকৃতির পরমাণু। এই পরমাণুর কেন্দ্রে রয়েছে একটি প্রোটন যাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে একটি ইলেকট্রন। অন্য আরেকটি পরমাণুর হচ্ছে হিলিয়াম যার কেন্দ্রে রয়েছে দুটি প্রোটন এবং যাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে দুটি ইলেকট্রন। প্রোটনের আধান ধনাত্মক হয়, এরা একসাথে নিউক্লিয়াসে থাকতে পারে না। এদেরকে একসাথে আটকে রাখার কাজ হচ্ছে নিউট্রনের।
নিউট্রনের ভর প্রোটনের কাছাকাছি কিন্তু চার্জবিহীন। দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু একভূত হয়ে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ায় হিলিয়াম উৎপন্ন করে। আলাদাভাবে দুটি প্রোটন এবং দুটি নিউট্রনের ভর, “হিলিয়াম” এর “নিউক্লিয়াস”এর ভরের চেয়ে কিছুটা কম (0.007 ভাগ)। এর ফলে যে ভরটি হারায় সেটি শক্তিতে রূপান্তরিত হয় যা আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র (E=mc^2) মাধ্যমে জানা যায়৷ সুতরাং সূর্যে থেকে নির্গত সকল শক্তি এই হারানো ভর থেকে পাওয়া যায়।
পৃথিবীর মৃত্যুঃ
সূর্য প্রতি সেকেন্ডে 600 মিলিয়ন টন এর চেয়ে বেশি হাইড্রোজেন নির্গত করে। বর্তমানে প্রায় সূর্যের অর্ধেক পরিমাণ হাইড্রোজেন→ হিলিয়াম এ পরিণত হয়েছে, এবং সূর্য তার জীবন চক্রের সবচেয়ে আদর্শ অবস্থানে রয়েছে। এই অবস্থানকে যেকোনো নক্ষত্রের প্রধান ক্রম অবস্থা বলে। অন্যান্য সকল নক্ষত্রের মতো সূর্যের জ্বালানিও একদিন শেষ হয়ে যাবে। সূর্যের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এই মহাবিশ্বে আমাদের পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি হুমকির সম্মুখীন হতে থাকবে।
প্রতি 100 কোটি বছরের ব্যবধানে সূর্যের “লুমিনোসিটি” 10% বৃদ্ধি পায় (‘লুমিনোসিটি’ হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে সূর্য থেকে নির্গত শক্তির পরিমাণ)। এর ফলে সময়ের সাথে সাথে পৃথিবী ক্রমাগত উত্তপ্ত হতে থাকবে। বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী 100 কোটি বছর পর পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা থাকবে 70 ডিগ্রি সেলসিয়াস। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা যদি 70 ডিগ্রি সেলসিয়াস হয় তাহলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব ধ্বংস হয়ে যাবে এবং এর সাথে সাথে আগামী 200 কোটি বছর পর পৃথিবীর সাগর মহাসাগর এর পানি বাষ্প হয়ে বায়ুমন্ডলে চলে যাবে “গ্রীনহাউস ইফেক্ট” এর কারণে। পৃথিবী তখন নিষ্প্রাণ মরুভূমি হয়ে থাকবে।
তবে সূর্যের জীবনচক্রের অনেকটা পথ বাকি থাকবে। 4.5 বিলিয়ন বছর পর “সূর্যে” হাইড্রোজেন এর তুলনায় হিলিয়াম এর পরিমাণ বেশি হয়ে যাবে ফলে অবশিষ্ট “হাইড্রোজেন” আরো দ্রুত “হিলিয়াম” এ পরিণত হতে থাকবে। তখন “সূর্য” আরো বেশি উত্তপ্ত হবে ফলে সূর্যের ‘বাইরের স্তর’ ক্রমাগত সৌরজগতের দিকে প্রসারিত হতে থাকবে অর্থাৎ সূর্যের আকৃতি বৃদ্ধি ঘটবে। একপর্যায়ে সূর্য বড় হয়ে বিশাল আকার ধারণ করার পর সূর্যকে বলা হবে Red Gaint star একে বাংলায় লোহিত দানবীয় নক্ষত্রও বলা যেতে পারে।
সে সময়ে সূর্যের ব্যাসার্ধের বৃদ্ধি ঘটবে বর্তমান সময়ের তুলনায় 100 গুণ ও সূর্যের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পাবে ২ হাজার গুণ। সূর্যের এই প্রসারণ তার আশেপাশের গ্রহ যেমনঃ- বুধ ও শুক্র-এর জন্য হবে বিধ্বংসী। এই দুটি গ্রহ সূর্যের তাপের প্রভাবে বাষ্পে পরিণত হবে এক পর্যায়ে সূর্যের সাথে মিশে যাবে। পৃথিবীর অবস্থা তখন অনেকটা বর্তমান বুধ গ্রহের মতো হবে, প্রচন্ড উত্তপ্ত ও প্রাণহীন সেই সাথে সাথে চাঁদও গলে গিয়ে তরলে পরিণত হবে। পৃথিবী থেকে ওই সময় সূর্যকে 20 গুন বড় দেখাবে।
সূর্যের মৃত্যুঃ
সূর্যের সম্পূর্ণ হাইড্রোজেন বিক্রিয়া করে হিলিয়াম এ পরিণত হওয়ার পর তাপমাত্রা হবে 100 মিলিয়ন কেলভিন। অতি উচ্চ’তাপমাত্রায় হিলিয়াম নিজেদের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বন এবং অক্সিজেন এ রূপান্তরিত হতে শুরু করবে। হিলিয়ামের এই রূপান্তর পক্রিয়া চলবে পরবর্তী ১০ কোটি বছর। এভাবে সূর্য হিলিয়াম হারিয়ে সূর্যের কেন্দ্রে অবশিষ্ট অক্সিজেন ও কার্বন বিদ্যামান থাকবে, এ পর্যায়ে সূর্য পুরোপুরি অস্থায়ী হয়ে পড়বে।
ফলে সূর্যে ক্রমাগত থার্মাল পালস শুরু হবে। থার্মাল পালসের ফলে সূর্যের বাইরের অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং সূর্যে আর কোনো জ্বালানী অবশিষ্ট না থাকার ফলে সূর্য পৃথিবীর আকারের উচ্চ ঘনত্বের শ্বেত বামনে পরিণত হবে। সূর্যের উজ্জ্বলতা আরো কমে আসবে কিন্তু তখনও সূর্যকে প্রায় কয়েকশো আলোকবর্ষ দূর হতে দেখা যাবে। সময়ের সাথে সাথে শ্বেত বামনও ছোট ও অণুজ্বল হতে থাকবে, এবং একসময় শ্বেত বামন পুরোপুরি অণুজ্বল ও পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যাবে।
একে আক্ষরিক অর্থে “সূর্যের মৃত্যু” বলা যেতে পারে।
এর সাথে নক্ষত্রের সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে এটি একটি ব্ল্যাক হোল এ পরিণত হয়ে যাবে।
তথ্যসূত্র- নিউক্লিয়ার ফিউশন, ওয়েস্টার্ন ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি