সভ্যতা আজ একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছেছে। চাকা আবিস্কারের সময়টা ছিলো বিপ্লবের মতো। আর আজ মহাকাশে পাড়ি জমানো মানুষের কাছে নিত্য নতুন ব্যাপার।
প্রযুক্তি ছাড়িয়ে গেছে মানুষকেও। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্রযুক্তি আবিস্কারের কথা শোনা যাচ্ছে। জীবনধারা উন্নত হচ্ছে। পৃথিবীর এই আমূল পরিবর্তনের পেছনে রয়েছেন কিছু মহারথী যাদের জন্য আমরা আজ এতো এতো প্রযুক্তির ছোঁয়া পাচ্ছি।
প্রযুক্তি জগতের এমনই এক মহারথীর নাম এলন মাস্ক। প্রথাগত চিন্তাধারার বাইরে এসে এলন মাস্ক দেখিয়ে দিয়েছেন কীভাবে সফল হওয়া যায়। পৃথিবীর ভাগ্য পরিবর্তনের চাবিকাঠি ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের হাতে থাকলেও নতুন দিনের এই পার্শ্বনায়কেরাই হয়ে উঠছেন আগামী পৃথিবীর প্রচ্ছদচিত্র। তাদের হাত ধরেই প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা পাচ্ছে নতুন মাত্রা। জীবন ধারণে, জীবন যাপনে আসছে বর্ণিল বৈচিত্র্যের ছোঁয়া। উদ্ভাবন ও নতুন নতুন প্রযুক্তি দিয়ে এলন মাস্ক সবাইকে অবাক করেছেন। আজ এমনই কিছু উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি সম্পর্কে জানবো।
এলন মাস্কের নাম শুনলে সবার প্রথমে যে নামটি মাথায় আসে তা হলো স্পেস–এক্স।
এলন মাস্কের প্রথম চমক ছিলো স্পেস–এক্স। নাসা এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে অনেক রকেট পাঠিয়েছে, চাঁদে মানুষ গিয়েছে। কিন্তু তারা কোনো মহাকাশযানকেই পুনঃব্যবহারযোগ্য করতে পারেনি। এখানেই এলন মাস্ক একটু অন্যভাবে চিন্তা করলেন। যদি রকেটগুলোর কিছু অংশও পুনরায় ব্যবহার করা যায় তাহলে লাখ লাখ ডলার বেঁচে যাবে। এমন চিন্তা থেকে ২০০২ সালে ১০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে মাস্ক তৈরি করলেন তার স্বপ্নের স্পেস–এক্স।
মাস্কের ভাবনা ছিলো রকেটের বিভিন্ন অংশ পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় তা সমুদ্রের মাঝে অস্থায়ীভাবে তৈরি একটি হেলিপ্যাডে ল্যান্ড করানো। এতে করে সেই অংশটুকু আবার ব্যবহার করা যাবে। স্পেস– এক্সের শুরুর সময়টা ভালো ছিলো না। তাদের প্রথম তিনটি উৎক্ষেপণই ব্যর্থ হয়। তখন সময় ২০০৭ সাল। সকল বিনিয়োগকারীরা কোম্পানি ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এলন মাস্ক ছিলেন ফিনিক্স পাখির মতো। তীব্র ইচ্ছা শক্তি এবং বুদ্ধিমত্তার জোরে –এক্সের চতুর্থ উৎক্ষেপণ সফল হয়। যার ফলশ্রুতিতে নাসা স্পেস–এক্সের সাথে ১.৬ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে। শুরু হয় স্পেস–এক্সের জয়যাত্রা যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
মাস্কের রক্তে মিশেছিলো আবিষ্কারের নেশা। প্রতিনিয়ত তিনি ছুটেছিলেন নতুন কিছু উদ্ভাবনের স্বপ্নলীলায়। মাস্ক সবসময় ৫ টি বিষয় নিয়ে ভাবতেন। তিনি মনে করতেন ইন্টারনেট, পরিবেশবান্ধব জ্বালানি, মহাকাশ ভ্রমণ, আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স এবং বায়োটেকনলজি পুরো সভ্যতাকে পালটে দিতে পারে।
ইন্টারনেটের প্রতি প্রবল ঝোঁক থাকার কারণে যোগ দিয়েছিলেন সেই সময়ের ইন্টারনেট জায়ান্ট নেটস্কেপে। নেটস্কেপ থেকে নিগৃহীত হয়ে তাঁর ভাই কিম্বাল মাস্ককে নিয়েই প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের একটি কোম্পানি জিপ২(zip2) । জিপ২ একটি ওয়েব নির্ভর সফটওয়ার কোম্পানি যার কাজ ছিল ইন্টারনেটে একটি বিজনেস ডিরেক্টরি ও ম্যাপ তৈরি করা। সেই সময়ে ব্যাবসায়ীরা ইন্টারনেটে বিজ্ঞাপন দিয়ে পয়সা খরচ করাকে বোকামি মনে করত, কিন্তু ধীরে ধীরে ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তার সাথে সাথে জিপ২ ও ফুলেফেঁপে উঠল। বিশ্বখ্যাত কোম্পানি কমপ্যাক জিপ২ কে ১৯৯৯ সালে ৩০৭ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়।
নিখুঁত ভবিষ্যতদ্রষ্টা এলন মাস্ক মাত্র ২৭ বছরেই হন মিলিওনেয়ার। মিলিওনেয়ার হবার পর মাস্ক থেমে থাকেননি। রক্তে যার মিশে ছিলো আবিষ্কারের নেশা, তিনি কেন থেমে থাকবেন!
জিপ২ থেকে পাওয়া অর্থের তিন চতুর্থাংশই বিনিয়োগ করেন তার নতুন আইডিয়ার পেছনে। তৈরি হয় এক্স.কম (X.com)। এখান থেকেই সূচনা হয় পেপ্যাল এর। উল্লেখ্য স্টেডিয়ামের লকার রুমে রাত জেগে জেগে কাজ করে মাস্ক X.com তৈরি করেছিলেন।
মূলত পেপ্যাল হলো দুইটি ফিনান্সিয়াল কোম্পানির যৌথ উদ্যোগ। X.com এর অফিস বিল্ডিং এ পিটার থিলের ইন্টারনেট ফিনান্সিয়াল কোম্পানি ‘কনফিনিটি‘ র অফিস ছিলো।
ইন্টারনেটে অর্থ লেনদেনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা বুঝতে পেরে প্রতিযোগিতা ছেড়ে দুটি কোম্পানি একসাথে হয়ে গঠন করে ‘পেপ্যাল’। এই পেপ্যাল বর্তমানে লক্ষ লক্ষ ফ্রিল্যান্সারের টাকা লেনদেনের একমাত্র ভরসা। পরবর্তীতে ২০০২ সালে ওয়েব জায়ান্ট ebay পেপ্যালকে ১.৫ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয়, যেখানে সর্বোচ্চ শেয়ার–হোল্ডার হিসেবে ট্যাক্স বাদ দিয়েই মাস্ক উপার্জন করেন ১৮০ মিলিয়ন ডলার।
স্পেস–এক্সের যখন খারাপ সময় যাচ্ছিলো তার মাঝে মাস্ক গঠন করেন ”সোলার সিটি” নামে আরেকটি কোম্পানি। এই কোম্পানি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিলো সৌর শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা এবং জ্বালানি তেলে বা গ্যাসের ব্যবহার কমিয়ে আনা। আজও যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশাল অংশের কলকারখানায় সোলার সিটি থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।
স্পেস–এক্সে মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করার পরও এলন ক্ষান্ত ছিলেন না। একই সময়ে টেসলা অটোমোবাইলস তৈরি করেন। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই টেসলা লোকসান গুনতে শুরু করে। এতে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। ঠিক সেই সময় স্পেস–এক্সও খারাপ অবস্থায়। কিন্তু মাস্ক তো দমে যাবার পাত্র নয়। ২০০৮ সালে টেসলা বের করলো টেসলা–রোডস্টার মডেল। বাজারে তুমুল সাড়া ফেললো গাড়িটি। এই ‘টেসলা রোডস্টার’ আরাম, সৌন্দর্য, ব্যয়বহুলতা এবং গতি– সবদিক থেকেই যেকোনো দামী গাড়ির তুলনায় কোনো দিক থেকেই কম নয়। তাছাড়া আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্তেই তিনি তৈরি করলেন গাড়ি চার্জ করার পাম্প, যেখানে কিনা বিদ্যুৎ সরবরাহ হয় তার সেই সোলার সিটি থেকেই।
এলনের ‘টেসলা রোডস্টার’ গাড়ির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো– একবার সম্পূর্ণ চার্জ করার পর তা একটানা ৪৫০ কিলোমিটার চলতে সক্ষম ছিলো। ২০০৮ থেকে এখন পর্যন্ত ইলন মাস্কের সবকটি প্রোজেক্টের উন্নতির গ্রাফ উর্ধ্বমূখী।
মাস্কের সর্বশেষ আবিষ্কার হলো সৌর শক্তি চালিত হাই স্পিড মোটর ‘হাইপারলুপ’। এই হাইপারলুপ মোটরের সাহায্যে লস এঞ্জেলস থেকে সানফ্রান্সিসকো পর্যন্ত ৬১৪ কিলোমিটার পথ যেতে সময় নেবে মাত্র ৩০ মিনিট। এলন মাস্কের দাবি, হাইপারলুপ হবে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির যোগাযোগ প্রযুক্তি। সৌরশক্তিনির্ভর এ ব্যবস্থায় ঘণ্টায় ৬০০ মাইলেরও বেশি গতিতে যোগাযোগ করা যাবে, অথচ এ যোগাযোগ প্রযুক্তি হবে প্লেন বা ট্রেনের চেয়ে সাশ্রয়ী।
স্টেশন থেকে দ্রুতগতির হাইপারলুপ প্রযুক্তির যানে চেপে দ্রুততম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। হাইপারলুপ প্রযুক্তি মার্কিন ব্যাংকগুলোর অর্থ লেনদেনের একটি পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
হাইপারলুপ নিয়ে বিস্তারিত থাকছে এখানেঃ হাইপারলুপ: বাস্তবতার কাছাকাছি যেতে এলন মাস্কের নতুন প্রকল্প
এলন মাস্কের মতে, হাইপারলুপ হবে শব্দের চেয়ে দ্রুতগতির কনকর্ডবিমান, দ্রুতগতির ট্রেন ও এয়ার হকির নকশার সমন্বিত রূপ। এটি এমন একটি যোগাযোগব্যবস্থা হবে, যার মাধ্যমে একটি টিউব কয়েকটি দেশ অথবা শহরজুড়ে থাকবে। টিউবের ভেতর থাকবে ক্যাপসুল। টিউব ব্যবস্থার মধ্যে কোনো বায়ু থাকবে না। ফলে থাকবে না কোনো প্রকার ঘর্ষণশক্তি। এই দ্রুতগতির ক্যাপসুলে চড়ে ঘণ্টায় ৬০০ মাইল বেগে ভ্রমণ করা যাবে।
হাইপারলুপ ব্যবস্থায় ঘণ্টায় দুই লাখ মানুষের ভ্রমণের সুযোগ থাকবে। আর নিউইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসে যেতে সময় লাগবে মাত্র ৪৫ মিনিট এবং নিউইয়র্ক থেকে বেইজিং যেতে লাগবে দুই ঘণ্টা। মাস্ক প্রবর্তিত এই হাইপারলুপ প্রযুক্তি পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় এ বছর। হাইপারলুপ ট্র্যাক নির্মাণে খরচ হবে ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার।
বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সিস্টেম চালু করার লক্ষ্যে স্পেস-এক্স এর কর্ণধার এলন মাস্ক স্টারলিংক স্যাটেলাইট প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। স্পেসএক্সের এই মিশনের লক্ষ্য মূলত ছোট ছোট প্রায় ১২ হাজারের মতো স্যাটেলাইটের সাথে আন্তঃসংযোগ এর মাধ্যমে সে সকল স্থানে উচ্চমানের ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক প্রদান করা, যে সকল স্থানে নেটওয়ার্ক নেই বললেই চলে এবং ব্যয়বহুল।
স্টারলিঙ্ক নিয়ে বিস্তারিত থাকছে এখানেঃ ১২ হাজার স্যাটেলাইটের স্টারলিংক প্রোজেক্ট; ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটে যুগান্তকারী বিপ্লব
তাঁর আরেকটি সাড়া জাগানিয়া উদ্যোগের নাম নিউরালিঙ্ক, বিস্তারিত থাকছে এখানেঃ বুদ্ধির সাহায্যে ভিডিও গেমস খেললো বানর: নিউরালিংক এর নতুন সাফল্য
এছাড়াও পড়ুনঃ ইলন মাস্কের উত্থান: যেভাবে তিনি আজ শ্রেষ্ঠ ধনী
শুরুর সময়টাতে মাস্ককে সবাই পাগল ভাবতো। তার কাজগুলো মানুষের কাছে উদ্ভট মনে হতো। প্রকৃত অর্থে মাস্ক ভবিষৎ দেখতে পেতেন এবং সেভাবেই তিনি পরিকল্পনা করতেন। আর এই জন্যই মাস্ক সেরা এবং সময়ের তুলনায় অধিক সফল।
এলন মাস্ক যেন যুগান্তকারী আবিষ্কারের এক অনবদ্য প্রতিশব্দ। তিনি যেন নিজেকে ক্রমান্বয়ে ছাড়িয়ে যাওয়া এক নিরলস উদ্ভাবক, বিনিয়গকারী কিংবা বিলিয়নারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই সব কিছুর পেছনে ছিলো মাস্কের কাজের প্রতি ভালবাসা এবং স্বপ্নের প্রতি একাগ্রতা।
জীবনের উন্নয়ের সিঁড়িতে অনেক চড়াই উৎরাই পার হতে হয়েছে। সাময়িক অনেক বাঁধা এসে স্থবির করে দিতে চেয়েছিলো পথ চলা। কিন্তু এলন মাস্ক ছিলেন অদম্য। জীবনের অসাধ্যের দিনলিপিতে যত বিদঘুটে সমীকরণ ছিল, সব সমীকরণ তিনি পাল্টে দিয়েছেন। সময়ের চেয়ে আধুনিক চিন্তা করে তিনি নিজেই হয়েছেন নিজের ভবিষ্যৎ নির্মাতা।