জীবজগতের বসবাসের জন্য চাই সুন্দর একটি পরিবেশ। ১৭৬০ সালে শিল্পবিপ্লবের ফলে মানবসভ্যতার উত্তরোত্তর উন্নতি সাধিত হয়েছে। কিন্তু চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এই যুগের পথপরিক্রমায় মানবজাতি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে পরিবেশের। চারদিকে কলকারখানার বর্জ্য, পয়ঃবর্জ্য, ট্যানারির বর্জ্য, পানি দূষণ, মাটি দূষণ ইত্যাদি সমস্যা। বর্তমানে বায়োরিমেডিয়েশন, বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট ইত্যাদি পদ্ধতিতে এসব সমস্যার সমাধানের চেষ্টা চলছে এবং অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা সফল। এই পদ্ধতিকে মেটাজিনোমিক্স (Metagenomics) আরও ফলপ্রসূ করতে পারে।
মেটাজিনোমিক্স (Metagenomics) কি?
‘মেটাজিনোমিক্স’ যেটিকে আমরা ‘এনভায়রনমেন্টাল জিনোমিক্স, ইকোজিনোমিক্স বা কমিউনিটি জিনোমিক্স‘ বলতে পারি। ‘মেটাজিনোমিক্স’ জীববিজ্ঞানে আবিষ্কৃত অপেক্ষাকৃত নতুন একটি কৌশল, যার জন্ম হয়েছিল একুশ শতকের শুরুর দিকে। সেই থেকে বিজ্ঞানীদের আগ্রহ চিকিৎসা, বায়োটেকনোলজি, কৃষি বা জেনেটিক্সের মতো বিজ্ঞানের বৈচিত্র্যময় শাখার পাশাপাশি এই কৌশলের দিকে বাড়তে থাকে।
‘মেটাজিনোমিক্স’ শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে ‘মেটা’ ও ‘জিনোমিক্স’ এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে। যেখানে ‘মেটা’ শব্দের অর্থ একটি পরিবেশে বা কালচারে উপস্থিত সকল অনুজীব। ‘জিনোমিক্স’ শব্দের অর্থ জিনোম নিয়ে স্টাডি বা এনালাইসিস করা, অর্থাৎ জিনোম সিকোয়েন্স করা। সহজ ভাষায়, পরিবেশের কোনো নমুনা (পানি,মাটি,কলকারখানার বর্জ্য ইত্যাদি)হতে অনুজীব সংগ্রহ করে তাদের ডিএনএ সিকোয়েন্স বের করে বিশদ বিশ্লেষণ করার প্রক্রিয়াই হলো মেটাজিনোমিক্স।
মেটাজিনোমিক্স জীববিজ্ঞান গবেষণায় একটি সহায়ক কৌশল। যখনই আমরা অনেকগুলো অনুজীব নিয়ে কাজ করব এবং একটি অনুজীবকে অন্য অনুজীব থেকে আলাদা করতে পারব না কেবলমাত্র তখনই মেটাজিনোমিক্স কৌশলটি ব্যবহার করব।
‘মেটাজিনোমিক্স’ প্রক্রিয়া কিভাবে সংঘটিত হয়?
মেটাজিনোমিক্স প্রক্রিয়ার কিছু প্রয়োজনীয় ধাপ তুলে ধরা হলো,
(১)নমুনা সংগ্রহ করা
মাটি,মানুষের অন্ত্র,পানি,কলকারখানার বর্জ্য ইত্যাদি মাধ্যম থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়।(২)ডিএনএ সিকোয়েন্স করা
ডিএনএ সিকোয়েন্সিং হচ্ছে একটি জীবের দেহে থাকা তার সকল জেনেটিক কোডকে একের পর এক বিন্যস্ত করা। সিকোয়েন্সিংয়ের পূর্বে অনুজীবের জিনোমগুলি থাকে অজানা। সিকোয়েন্সিং এর মাধ্যমে ডিএনএ শর্ট রিড করা হয়।
(৩)এসেম্বলি
সিকোয়েন্সকৃত জিনোমকে এসেম্বলি করা হয়।এরপর সফটওয়্যার এর সাহায্যে এসেম্বলি এলগরিদম ব্যবহার করে সিকোয়েন্সকৃত জিনোম শর্ট রিডগুলোকে ‘কনটিগ(contig)’ এ পরিণত করা হয়।
কনটিগ হলো ওভারলেপ করেছে এরকম ডিএনএ সিকোয়েন্সের একটি সিরিজ। বায়োইনফরমেটিক ডেটা এনালাইসিস অনুজীবদের মধ্যে কমন প্যাটার্ন তুলে ধরতে সহায়তা করে।
(৪)বাইনিং
ডিএনএ সিকোয়েন্স গুলোকে গ্রুপ করে ভাগ করা হয়, যেখানে এক একটি গ্রুপ পৃথক জিনোমের প্রতিনিধিত্ব করে।প্রতিটি কনটিগকে একটি জিনোমে পরিণত করা হয়।
(৫)এনোটেশন
সংগ্রহকৃত ডেটা পর্যালোচনা করে অনুজীবটির জিন সম্পর্কে ধারণা করা হয়,স্পেশিস সম্পর্কে ধারণা করা হয় এবং উপকারী ও অপকারি দিক চিহ্নিত করে জিনগুলো কি কাজে লাগানো যাবে তা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
(৬)এনালাইসিস
এ ধাপে গবেষকরা তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু গ্রাফ,চার্ট,টেবিল এর মাধ্যমে উপস্হাপন করেন।
মেটাজিনোমিক্স প্রক্রিয়ার উপকারী দিক
আমাদের চারপাশে ট্যানারির বর্জ্যে, শিল্প কারখানার বর্জ্যে সয়লাব। ধরুন, আপনি অণুজীবের সহায়তায় শিল্প কারখানার বর্জ্য সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। এক্ষেত্রে মেটাজিনোমিক্স আপনাকে কিভাবে সহায়তা করবে?
এ প্রক্রিয়ায়, শিল্প-কারখানার বর্জ্য কে নমুনা হিসেবে নিয়ে এনালাইসিস করে, সেখানে উপস্থিত অনুজীবদের জিনোম সিকোয়েন্স বের করা হয়। সিকোয়েন্সের পর যদি নতুন জিনোম পাওয়া যায়, তাহলে এ থেকে ধারণা করা হয় এই অণুজীবগুলি শিল্প-কারখানার বর্জ্য থেকে পুষ্টি নিতে পারে অথবা শিল্প-কারখানার বর্জ্যকে শোধন করতে পারে। এসব জিনোমের নতুন বৈশিষ্ট্য সংবলিত প্রোটিনগুলো বাছাই করে ল্যাবের কৃত্রিম পরিবেশে সাড়া দেয় এমন ব্যাকটেরিয়াতে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ফলে এমন নতুন জিএম ব্যাকটেরিয়া তৈরি হবে যা শিল্প কারখানার বর্জ্যকে কার্যকরভাবে শোধন করতে পারবে। একইভাবে চিকিৎসা, কৃষি ইত্যাদি ক্ষেত্রে এ প্রক্রিয়ায় সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
সম্প্রতি মেটাজিনোমিক্স (Metagenomics) প্রক্রিয়ায় শিশুদের মেনিনজাইটিস রোগ নিয়ে গবেষণা করে সাড়া ফেলে দেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. সেঁজুতি সাহা।
এছাড়া মেটাজিনোমিক্স প্রক্রিয়ায় গবেষকরা অনুজীবদের মধ্যে বৈচিত্র্য বিশ্লেষণ করতে পারেন।নতুন প্রোটিন, এনজাইম এবং জৈব রাসায়নিক পদার্থ সনাক্ত করতে পারেন।পরিবেশ থেকে নতুন ও উপকারী জিনগুলি সনাক্ত করতে, নতুন অ্যান্টিবায়োটিক উৎপন্ন করতে, বায়োডিগ্রেডেবল এনজাইমগুলি চিহ্নিত করে নতুন প্রোডাক্ট উৎপাদন করতে মেটাজিনোমিক্স প্রয়োজনীয়।
এই ব্লগগুলি পড়তে মোটেও ভুলবেন না!! Quantum Gravity বা কোয়ান্টাম মধ্যাকর্ষণ: আদ্যপান্ত |
মেটাজিনোমিক্স প্রক্রিয়ার সীমাবদ্ধতা
জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রকল্পগুলো অনেক ব্যয়বহুল, সিকোয়েন্সকৃত ডেটা বিশ্লেষণ করা কঠিন,
মাঝারি বা উচ্চ বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুজীবগুলোকে সমাবেশ করে একত্রিত করে উপস্হাপন করা প্রায় অসম্ভব। মেটাজিনোমিক্স প্রাকৃতিক বিভিন্ন অনুজীব সম্পদায়ের মধ্যে উপস্থিত ‘পলিমর্ফিজম‘(বহুরূপতা) শনাক্ত করে, যা সিকোয়েন্সকৃত জিনোম কোডের ক্রম সমাবেশকে আরও কঠিন করে তোলে।
নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং এর অনেকগুলো কার্যকরী প্রক্রিয়া থাকতে মেটাজিনোমিক্স কেন প্রয়োজন?
ধারণা করা হয় যে প্রকৃতিতে উপস্থিত অনুজীবগুলোর প্রায় >৯৯% কে প্রচলিত প্রক্রিয়ায় কালচার করা যায় না। এক্ষেত্রে মেটাজিনোমিক্স প্রক্রিয়া সহায়ক হতে পারে।
মেটাজিনোমিক্স এর ক্ষেত্রে আমরা এখনো নতুন যুগের শুরুতে দাড়িয়ে আছি। তরুণ প্রজন্মই পারে এই কৌশলকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ও সমৃদ্ধ তথ্য ভান্ডার গড়ে তুলতে।
তথ্যসূত্রঃ
১)https://en.m.wikipedia.org/wiki/Metagenomics
২)https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC3351745/
৩)https://youtu.be/Yo4OWpgOsMU
৪)https://www.genome.gov/genetics-glossary/Metagenomics