বরফে ঢাকা পৃথিবীর একমাত্র মহাদেশ হলো অ্যান্টার্ক্টিকা। আয়তনের দিক থেকে এটি পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম মহাদেশ। বরফ আচ্ছাদিত এই মহাদেশে অধিবাসী বলতে আছে কিছু পেঙ্গুইন, সীল, মেরু ভাল্লুক বা শ্বেতভাল্লুক, ইত্যাদি।
প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে এটিই পৃথিবীর একমাত্র মহাদেশ যেখানে কোনো স্থায়ী জনবসতি নেই। কিন্তু এরপরও প্রতিবছর গবেষণা কাজে ও অবকাশ যাপনে অনেক মানুষই অ্যান্টার্ক্টিকা ভ্রমনে যায়।
অবাক হচ্ছেন না? কেন মানুষ ঘুরতে যায় এই বরফ প্রান্তরে? চলুন এখন আপনাদেরকে এখন এটাই বলি, কেন যাবেন অ্যান্টার্ক্টিকা!
এটি পর্যটক ও গবেষকদের অন্যতম আকর্ষনের কারণ হয়ে ওঠার পেছনে আছে এর বৈচিত্র্যময় জীবজগত। প্রায় ৪৫ প্রজাতির পাখি এই মহাদেশে আছে, যার মাঝে রয়েছে পেঙ্গুইন, অ্যান্টার্কিক পেট্রেল, অ্যালবাট্রস, সী-গালস ইত্যাদি। এছাড়াও আছে তিমি, সীল, এলিফ্যান্ট সীল, মেরু ভাল্লুক সহ বিভিন্ন প্রাণি, যাদের দেখে আপনি মুগ্ধ হবেনই!
তবে বিভিন্ন প্রাণি থাকলেও অ্যান্টার্ক্টিকাতে কোনো গাছ নেই। তাই ওখানে হাঁটতে গেলে আপনার মনে হতে পারে আপনি অন্য আরেকটি জগতে চলে এসেছেন, যেখানে চারদিকে শুধুমাত্র বরফ আর পাথর; কোনো গাছ নেই, পরিচিত পরিবেশের মতো কোনো বাড়ি বা বিল্ডিং নেই, কিছুই নেই।
ওশেনিয়া ও ইউরোপের চেয়ে বড় এই মহাদেশে আপনি যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই দেখবেন শুধু বরফ আর বরফ। পুরো পৃথিবীর প্রায় ৯০% বরফ রয়েছে অ্যান্টার্ক্টিকায়।
অ্যান্টার্ক্টিকার সব বরফ যদি গলে যায়, তবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে প্রায় ২০০ ফিট! পৃথিবীর সুপেয় পানির প্রায় ৭০% মজুদই রয়েছে অ্যান্টার্ক্টিকায়। অ্যান্টার্ক্টিকায় বরফের পুরুত্ব প্রায় এক মাইল কিছু কিছু স্থানে যা ৪ মাইল পর্যন্তও যেতে পারে!
বরফের দেশ মাথায় আসলে চোখে ভেসে উঠে রাশি রাশি পানির চিত্র। কিন্তু জেনে অবাক হবেন, অ্যান্টার্কিকার শুকনো অঞ্চলগুলো আদতে পৃথিবীর শুষ্কতম অঞ্চল। এখানে বাতাসে আর্দ্রতা এতই কম, বরফ এবং তুষারও পুরোপুরি মিশে যায় না। অবশ্য এমন শীতল অঞ্চল উষ্ণমণ্ডলীয় দেশগুলোর অধিবাসীদের জন্য বেশ প্রিয় অবকাশ যাপনের জায়গা।
অ্যান্টার্ক্টিকা বরফে ঢাকা হলেও এখানেই কিন্তু পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ পর্বতশ্রেণি- দ্য গ্যামবার্টসেভ মাউন্টেন্স। এই পর্বতশ্রেণি প্রায় ৭৫০ মাইল বিস্তৃত এবং এর সর্বোচ্চ চূড়ার উচ্চতা ৯,০০০ ফুট; যা পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের এক তৃতীয়াংশ।
এটি অবস্থিত অ্যান্টার্ক্টিকার শীতলতম অঞ্চল ডোম-এ তে। এখানে আছে ট্রান্স অ্যান্টার্ক্টিকা পর্বতশ্রেণি যা অ্যান্টার্ক্টিকা এর সবচেয়ে দীর্ঘ পর্বতশ্রেণি এবং এটি পুরো মহাদেশকে পূর্ব ও পশ্চিম দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। এই পর্বতশ্রেণি অ্যান্টার্ক্টিকার দুই প্রান্তের Ross Sea এবং Weddell Sea জুড়ে বিস্তৃত। হাইকিং ও এক্সপ্লোরিং এর জন্য এটি চমৎকার একটি স্থান।
অ্যান্টার্ক্টিকায় আছে ছোট-বড়, সক্রিয়- নিষ্ক্রিয় ১৩৮টির বেশি আগ্নেয়গিরি। এখানে অবস্থিত পৃথিবীর দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ‘মাউন্ট এরেবাস’, যা ১.৩ মিলিয়ন বছর আগ থেকে এখন পর্যন্ত সক্রিয় আছে।
মাউন্ট এরেবাসকে অনেকে ‘লাভা লেক’ নামেও চিনেন, কারণ এর জ্বালামুখের ভেতরে আছে উত্তপ্ত গলিত লাভা-র হ্রদ। তবে মাউন্ট এরেবাস কিন্তু সর্ববৃহৎ আগ্নেয়গিরি নয়, সর্ববৃহৎ হলো মাউন্ট সিডলে, যা বর্তমানে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে।
এই মহাদেশের বিভিন্ন অনন্য বৈশিষ্ট্যের মাঝে একটি হলো দিন ও রাতের পার্থক্য। সেখানে আপনার মিডনাইট মুন এর পরিবর্তে দেখা হয়ে যেতে পারে মিডনাইট সান এর সাথে। কারণ, গ্রীষ্মের সময়ে এখানে সূর্যাস্ত হয়না। এর উল্টো টাও কিন্তু হয়, শীতকালে পুরোটা সময় এখানে অন্ধকার থাকে, তখন এ অঞ্চলে সূর্যোদয় হয়না।
শীতকালে গড়ে এখানের তাপমাত্রা থাকে -৭২ ডিগ্রী ফারেনহাইট, যা সে সময়ে সেখানে অবস্থান করা মানুষের জন্য প্রতিকূল করে তোলে। তাই পর্যটকরা শুধু ২৪ ঘন্টা দিনই দেখতে পাবেন, কারণ অ্যান্টার্ক্টিকার পর্যটন মৌসুম শেষ হয়ে যায় গ্রীষ্মের পরেই। তবে যে গবেষকরা গবেষণা কাজে পুরো বছরই থাকেন, তারা এই দুটো ঘটনাই দেখতে পারেন।
অ্যান্টার্ক্টিকা গবেষকদের জন্য স্বর্গরাজ্য, তা তো আগে বলেছিই। আর সে কারণেই পৃথিবীর ২৯ টি দেশের ৭০ টি স্থায়ী গবেষণা কেন্দ্র বা রিসার্চ স্টেশন আছে সেখানে। প্রতিবছর গড়ে ১২০০-১৫০০ বিজ্ঞানী পুরো বছরজুড়ে এখানে তাদের গবেষণা কার্য চালিয়ে যান।
শীতকালে দীর্ঘ রাত, জনশূন্যতা, আশেপাশের আলোক দূষণ না থাকায় অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে আগ্রহীদের জন্য রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণের একটি দারুণ স্থান অ্যান্টার্কিকা।
যদিও এখানে পর্যটন মৌসুম শেষ হয়ে যায় গ্রীষ্মের পরেই, তবুও আপনি যদি পরিষ্কার রাতের আকাশে তারাদের মেলা উপভোগ করতে চান, সেক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিবেশ স্বত্বেও যেতে পারেন সেখানে।
এতক্ষন তো বলে গেলাম অ্যান্টার্ক্টিকার অপরুপ সৌন্দর্যের কথা। কিন্তু আপনি চাইলে যেতে পারেন এই অপরূপ সৌন্দর্যের মহাদেশে। অ্যান্টার্ক্টিকায় যাবার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সহজলভ্য উপায় হলো জলপথ, কিন্তু বর্তমানে ২ ঘন্টার ফ্লাইটের মাধ্যমেও সেখানে যাওয়া সম্ভব।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!বিজ্ঞান মেলা -কিছু সহজ ও মজার প্রজেক্ট প্রজাতি তে ইমিউন ও প্যারাসাইটিজম: সম্পর্ক যখন স্ত্রী ও পুরুষে |
এর পর্যটন মৌসুম হলো নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত, এ সময়ে এখানে গ্রীষ্মকাল এবং দীর্ঘতম দিন হবার কারনে আপনি আপনার সময়ের সবচেয়ে ভালো ব্যবহার করতে পারবেন। গ্রীষ্মকাল জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণের সর্বোত্তম সময় তবে নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরে পেঙ্গুইন ও ফেব্রুয়ারী থেকে মার্চ তিমি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। আর রাতের আকাশ দেখতে চাইলে আপনাকে সেখানে যেতে হবে পর্যটন মৌসুমের পরে।
বেশিরভাগ পর্যটকই অ্যান্টার্ক্টিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন দক্ষিণ আমেরিকার দুটি দেশ চিলি ও আর্জেন্টিনা থেকে। আর অন্য আরেকটি রুট হলো নিউজিল্যান্ডের সাউথ আইল্যান্ড থেকে, যা আপনাকে ঘুরিয়ে আনবে এর সবচেয়ে নির্জন প্রান্তর Ross Sea. আর এছাড়া আকাশ পথে আপনি পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই উড়ে যেতে পারেন অ্যান্টার্ক্টিকায়।
বাংলাদেশ থেকে আর্জেন্টিনা, চিলি বা নিউজিল্যান্ড যাবার খরচ বাদ দিলে অ্যান্টার্ক্টিকায় ১০-১৩ দিনের একটি ট্যুরে আপনার সর্বনিম্ন খরচ পড়বে ৫৯৫০ ডলার, যা আপনার ক্রুজ শীপ ও ঘুরার স্থান অনুযায়ী আরও পরিবর্তিত হবে।
কিন্তু যা কিছুই হোক, ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের জন্য অ্যান্টার্ক্টিকা একটি চমৎকার স্থান। এর শান্ত-শীতল পরিবেশ ও প্রাণিদের মুক্ত বিচরণ আপনাকে নিয়ে যাবে প্রকৃতির আরো কাছে এবং অবশ্যই এই ভ্রমণ আপনার জন্য চিরস্মরণীয় একটি স্মৃতি হয়েই থাকবে।
এবার বলুন, যাবেন নাকি অ্যান্টার্ক্টিকায়, শুভ্র বরফ প্রান্তরে?
তথ্যসূত্রঃ swoop-antarctica, antarcticaguide, crosscut, global.hurtigruten, উইকিপিডিয়া