এন্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থের ধারণা বিজ্ঞানীদের সামনে আসার পরে ধরা হয়েছিলো যে, প্রতিপদার্থ পৃথিবীতে পাওয়া বা তৈরী করা সম্ভব নয়। এটি হতে পারে একটি মহাজাগতিক বস্তু কিন্তু পৃথিবীর বাইরেও এর কোন সন্ধান মেলেনি। ধারণা করা হয় Matter(সাধারণ কণা)+Antimatter(প্রতি কণা)= Annihilation(ধ্বংস).
তাহলে কণা কী? প্রতিকণা কী? আর প্রতিকণা কেন সবচেয়ে দূর্লভ এবং দামী বস্তু?
কণাঃ এই মহাবিশ্বে যা কিছু আছে ধূলা-বালি, পোকা-মাকড়, মানুষ, গাছ, রকেট, চাঁদ, গ্রহ, নক্ষত্র থেকে গ্যালাক্সি সবকিছু কণা বা পার্টিকেল দিয়ে গঠিত। আমরা জানি, তিনটি মৌলিক কণার (ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউট্রন) সমন্বয়ে পরমাণু গঠিত। ইলেক্ট্রন(-) এবং প্রোটনের(+) আলাদা চার্জ বা আধান রয়েছে কিন্তু নিউট্রন নিরপেক্ষ। নিউট্রন ও প্রোটন নিয়ে নিউক্লিয়াস গঠিত। নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেক্ট্রন নির্দিষ্ট কোয়ান্টাম নিয়ে ঘুরতে থাকে।
এখন আসি,
প্রতিকণাঃ এন্টি ম্যাটার বা প্রতিকণা বা প্রতিপদার্থ হচ্ছে কণার মতো, কিন্তু সাধারণ কণার বিপরীতধর্মী। এটি বিপরীত চার্জযুক্ত মৌলিক কণা দিয়ে গঠিত। যেখানে সাধারণ কণার মতো প্রতিকণার ভর এবং স্পিন এক কিন্তু চার্জ, লেপ্টন এবং ব্যারিয়ন সংখ্যা সমান কিন্তু বিপরীতধর্মী।
প্রতিকণা এন্টিপ্রোটন, এন্টিনিউট্রন এবং পজিট্রন (এন্টিইলেক্ট্রন) দ্বারা গঠিত হয়। কিন্তু প্রতিকণায় সাধারণ কণার বিপরীতধর্মী চার্জ বা আধান থাকায় এর প্রোটন (এন্টিপ্রোটন) ধনাত্মক না হয়ে ঋণাত্মক(-) হয় এবং পজিট্রন ধনাত্মক (+) আধানের হয়। এই কারণে বস্তুও প্রতিবস্তুর প্রকৃতি, স্বভাব, ধর্ম বা আইন-কানুন একে অপরের সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। যেমনঃ একটি এন্টিপ্রোটন(-) এবং একটি পজিট্রন(+) মিলে তৈরী হয় এন্টি -হাইড্রোজেন।
বস্তু ও প্রতিবস্তুর মধ্যে পারস্পরিক সংস্পর্শ মানেই তাদের ধ্বংস অনিবার্য। আপনার প্রতিবস্তু যদি আপনার সাথে একটি ছোট্টহ্যান্ডসেক করারও ইচ্ছা পোষণ করেন, তবে সেই একটি হ্যান্ডসেক এর প্রথম স্পর্শই আপনাদের উভয়কেই ধ্বংস করে দেবে চিরতরে। বস্তু ও প্রতিবস্তুর মধ্যে পরস্পরের কোন রকম স্পর্শই তাদের মধ্যে এক প্রলয়ঙ্কারি বিস্ফোরণ এর মাধ্যমে উভয়েরই অস্তিত্বই বিলীন করে দেবে।
এই পোস্ট পড়তে ভুলবেন না! |
১৮৯৮ সালে জার্মান বিজ্ঞানী আর্থার শুস্টার প্রথম এন্টিম্যাটারের ধারনা দেন এবং এন্টিএটম বা প্রতিপরমানুর অস্তিত্ব অনুমান করেন। তবে তাঁর অনুমান নির্ভর তত্ত্বের অনেকাংশই পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা পরিমার্জন করেন। ১৯২৮ সালে বিজ্ঞানী পল ডিরাক তাঁর একটি গবেষণাপত্রে এন্টিম্যাটারের আধুনিক তত্ত্ব ব্যাখা করেন। এর ধারাবাহিকতায় শ্রোডিংগারের তরঙ্গতত্ত্বের আলোকে ইলেক্ট্রনের বিপরীত পদার্থ পজিট্রন তৈরির সম্ভাবনা দেখা যায় এবং ১৯৩২ সালে বিজ্ঞানী কার্ল ডি এন্ডারসন পজিট্রন আবিষ্কার করেন। পরবর্তীতে আরো কিছু পারমাণবিক মূল কণিকা যেমন, এন্টিপ্রোটন, এন্টিনিউট্রন এবং এদের সমন্বয়ে এন্টি নিউক্লিয়াস তৈরি করা হয়। এন্টিনিউক্লিয়াস এবং পজিট্রনের সমন্বয়ে পরমাণুর বিপরীত কণিকা এন্টিএটম বা প্রতিপরমানু তৈরি করা হয় ১৯৯৫ সালে। প্রযুক্তিগত উন্নতির সাথে সাথে গবেষণাগারে তুলনামূলক বড় আঙ্গিকে এন্টিম্যাটার তৈরি করা হয়।
এন্টিম্যাটার তৈরির পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এটাকে টিকিয়ে রাখা। কারন একে যে পাত্রে রাখা হবে সেটা কোন না কোন পদার্থ দ্বারা তৈরি করতে হবে। ফলে সেই পদার্থ প্রতিপদার্থের সাথে মিলে নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে। তবে বিজ্ঞানীরা এই সমস্যার সমাধান করে ফেলেছেন। তাঁরা বিশেষ স্থিতিশীল চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে তার ভিতরে এন্টিম্যাটার সংরক্ষণ করেন। যেহেতু চৌম্বকক্ষেত্র কোন পদার্থ দিয়ে তৈরি হয় না। এটা শুধুমাত্র একটি বলক্ষেত্র যেখানে প্রতিপদার্থ আকৃষ্ট হয়ে বিঁধে যায় এবং যার ফলে কোন পদার্থের সংস্পর্শে না আসতে পারবার কারনে সংরক্ষিত থাকে।
কিন্তু কী কারণে এন্টিম্যাটার বা প্রতিপদার্থ সবচেয়ে দামী পদার্থ?
একগ্রাম এন্টিম্যাটার তৈরীতে খরচ হয় ৬৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। যা টাকার অংকে 508000000000000 টাকা। এন্টিম্যাটার তৈরীর সামগ্রিক পদ্ধতি একে এতটাই দূর্লভ করে তুলেছে যার ফলে এর দাম আকাশচুম্বী। এছাড়া ম্যাটার ও এন্টিম্যাটারের মিলনের ফলে ধ্বংসযজ্ঞ রুখতে এন্টি ম্যাটার মানুষের হাতের নাগালে নেই। এছাড়াও এন্টি ম্যাটার সংরক্ষণ করতে খরচ হয় প্রচুর বেশি। CERN প্রতিবছর 1×10^15 পরিমাণ এন্টিপ্রোটন তৈরী করতে পারে যার ভর মাত্র ১.৬৭ ন্যানোগ্রাম।