“রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে
কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা
যদি তেমন বই হয়”।
[কবি ওমর খৈয়ামের একটি কবিতার ভাবানুবাদ]
ফারসি (পার্সিয়ান) সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্ব সাহিত্যেও একজন কিংবদন্তি ছিলেন পারস্য কবি ওমর খৈয়াম। তবে শুধুমাত্র ‘কবি’-ই তার একমাত্র পরিচয়? তার কাব্যপ্রতিভার আড়ালে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা এবং দর্শনে তার অবদানগুলো অনেকাংশে চাপা পড়ে গিয়েছে। এসবকিছু ছাড়িয়ে তিনি একজন কিংবদন্তি ‘কবি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। কী ছিল সেই চাপা পড়া ইতিহাস? চলুন জেনে নিই গণিত, জ্যোতির্বিদ্যায় ‘কবি’ ওমর খৈয়ামের অবদানগুলো। তুলে আনি সেই প্রায় হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসগুলো।
‘গিয়াসউদ্দিন আবুল ফাতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহিম আল-খৈয়াম নিশাপুরি’ সংক্ষেপে ওমর খৈয়াম হিসেবে পরিচিত। তার নাম ‘ওমর’ এবং তার বাবার নাম ছিল ‘খৈয়াম’। ধারণা করা হয়, তিনি তার বাবার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে তার নামের শেষে তার বাবার নাম যুক্ত করেন। সে-থেকে নাম হয় ‘ওমর খৈয়াম’। তিনি আনুমানিক ১০৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের ‘নিশাপুর’ এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তবে যুবক বয়সে তিনি নিশাপুর ত্যাগ করে সমরখন্দে চলে যান এবং সেখানেই তার শিক্ষাগ্রহন সমাপ্ত করেন।
যেহেতু তিনি ইসলামের স্বর্ণযুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সে-সময় ছিলো সকল ধরনের গোঁড়ামি, কুসংস্কার বিবর্জিত। এছাড়াও তার বাবাও ছিলেন তার মতই জ্ঞানপিপাসু। তাই তিনিও ‘ওমর খৈয়াম’-র জন্য উপযুক্ত উস্তাদ নিয়োগ দিয়েছিলেন, যিনি তাকে গণিত, বিজ্ঞান ও দর্শন শিক্ষা দিতেন। মধ্যযুগে কয়জন মুসলিম বিদ্বান ব্যক্তি জ্ঞানের পথে আলো জ্বালিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে ‘ওমর খৈয়াম’ ছিলেন অন্যতম। যদিও বর্তমানে তার ‘কবি’ পরিচয়ের আড়ালে সেই সোনালি ইতিহাস হারাতে বসেছে। সমরখন্দে জ্ঞানার্জন শেষে তিনি বুখারায় যান জ্ঞানচর্চার জন্য। সেখানেই তিনি হয়ে ওঠেন তার সময়ের সেরা একজন গণিতবিদ এবং জ্যোতির্বিদ। তিনি মূলত মূসা আল খোয়ারিজমী, আল বিরুনী, ইবনে সিনা এবং ইবনে আল-হাইসাম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন।
১০৬৬ সালের কথা, তখন তার বাবা এবং উস্তাদ উভয়ে মারা যান। আবার সে-বছরই হ্যালির ধূমকেতু দেখা যায়, যা জ্যোতির্বিজ্ঞানে তার আগ্রহ বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। তবে তিনি পুনরায় সমরখন্দে ফেরত যান। তারপর ১০৭৩ সাল, তখন সেলজুকের বাদশাহ ছিলেন সুলতান মালিক শাহ্ । তিনি একটি স্থায়ী বর্ষপঞ্জি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন, কেননা সে-সময়কার অধিকাংশ বর্ষপঞ্জি ছিলো ত্রুটিযুক্ত, সে-গুলো কয়েকবছর পরপর গোলমাল লেগে যেত, ফলে আবার নতুন আরেকটি বর্ষপঞ্জি তৈরির প্রয়োজন দেখা দিতো। তবে, সেটিও বেশিদিন স্থায়ী হতো না।
তো, সুলতান মালিক শাহ্ সে-সময়কার একদল বিখ্যাত বিজ্ঞানীর সাথে ‘ওমর খৈয়াম’-কেও আমন্ত্রণ জানান তার দরবারে। এছাড়াও, সুলতান মালিক শাহ্ একটি মানমন্দির তৈরির পরিকল্পনাও করেন। সেখানে ‘ওমর খৈয়াম’ প্রায় সফলভাবে সৌর বছরের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেন (দশমিকের পর প্রায় ছয় ঘর পর্যন্ত)। তার হিসেবে সৌরবর্ষের দৈর্ঘ্য ছিল ৩৬৫.২৪২১৯৮৫৮১৫৬ দিন(প্রায়)। এই ক্যালেন্ডারের হিসেবে প্রতি ৫৫০০ বছরে একবার ‘এক ঘন্টা’-র জন্য গড়মিল হয়ে থাকে। অন্যদিকে আমরা বর্তমানে যে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি ব্যবহার করে থাকি সেটির ক্ষেত্রে প্রতি ৩৩০০ বছরে একবার ‘এক দিন’-র জন্য গড়মিল হয়ে থাকে! সে-সময়কার প্রেক্ষাপটে এটি ছিলো একটি অভূতপূর্ব সাফল্য। তিনি সম্পূর্ণ বর্ষপঞ্জিটি তৈরি করেন ১০৭৮ সালে এবং সুলতান মালিক শাহ্ ১০৭৯ সালে বর্ষপঞ্জিটি প্রচলন করেন।
১০৬৮ সালে সমরখন্দে ফেরার পর তিনি তার জ্ঞানের জাদুতে সবাইকে মাতিয়ে তোলেন এবং সমরখন্দের তৎকালীন গভর্নর আবু তাহিরের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। তার গাণিতিক প্রতিভার জেরে কয়েকমাসের মধ্যেই রাজকীয় কোষাগারে তিনি কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানেই তিনি বীজগণিত চর্চা শুরু করেন, বলতে গেলে বীজগণিতের মাধ্যমেই তিনি তার গবেষণাজীবন শুরু করেন। প্রাচীনকালে গ্রিকরা বীজগণিত নিয়ে অনেক কাজ করেছিলো, তবে মধ্যযুগে এসে ‘ওমর খৈয়াম’ লক্ষ করেন যে, গ্রিকদের প্রণীত পদ্ধতিতে ‘ত্রিঘাত সমীকরণ’ সমাধান করা যাচ্ছে না। তখন তিনি ‘ত্রিঘাত সমীকরণ’-র সমাধান নিয়ে কাজ শুরু করেন।
১০৭০ সালে তিনি ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান আবিষ্কার করে ফেলেন। সে-বছরই তিনি ‘Demonstration of Problems of Algebra’ নামে তার একটি বই প্রকাশ করেন, যেটি বীজগণিতের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। সেখানে তিনি ‘ত্রিঘাত সমীকরণ’-র একাধিক সমাধান নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। তবে তিনি ঋণাত্মক সংখ্যা এবং ঋণাত্মক বর্গমূল নিয়ে কোনো আলোচনা করেন নই। সে-সময় আরব মুসলিম গণিতবিদরা ঋণাত্মক সংখ্যার ব্যবহার করতেন না। তবে, তার এই ‘ত্রিঘাত সমীকরণ’ সমাধান পদ্ধতি ছিল জ্যামিতিনির্ভর। কিন্তু, তিনি চাইতেন, বীজগণিত নির্ভর সমাধান পদ্ধতি ব্যবহার করতে। তবে তিনি পুনরায় ‘Treatise on Demonstration of Problems of Algebra’ নামে বীজগণিতের আরেকটি বই প্রকাশ করেন, সেখানে তিনি সম্পূর্ণ বীজগাণিতিক পদ্ধতিতে ‘ত্রিঘাত সমীকরণ’-র সমাধান আলোচনা করেন। ১৫৩৫ সালে ‘নিকালো টার্টাগিলা’ ত্রিঘাত সমীকরণের সাধারণ সূত্র আবিষ্কার করার আগ অবধি ‘ত্রিঘাত সমীকরণ/-এ তেমন কোনো উন্নতি সাধন হয়নি!
আগেই বলা হয়েছে যে, সবকিছু ছাড়িয়ে ‘ওমর খৈয়াম’ একজন ‘কবি’ হিসেবেই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি মূলত চার লাইনের বা চতুষ্পদী কবিতা লিখতেন, সেগুলো ‘রুবাই’ হিসেবে পরিচিত। তবে একটি বিশাল সময় যাবত এগুলো লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিলো। ১৮৫৯ সালে তার এই ‘রুবাই’ গুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করে ‘এডওয়ার্ড ফিটরেজাল্ড’ একটি ‘রুবাই’-এর সংকলন প্রকাশ করেন। যার নাম ছিলো ‘রুবাইয়াত অব ওমর’। তার ‘রুবাই’ গুলো পাঠ করলে তার চিন্তার গভীরতা এবং দর্শন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি জীবন এবং জগতের পাশাপাশি পরলৈকিক জীবন নিয়েও তার লেখা ‘রুবাই’ গুলোতে বলেছেন। যা জ্ঞান-পিপাসু মানুষদেরকে আরোও ভাবিয়ে তোলে!
এই বিখ্যাত কবি এবং অসাধারণ একজন ‘গণিতবিদ’-এর শেষ জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায়। তিনি আনুমানিক ১১৩১ সালে তার জন্মস্থান ‘নিশাপুর’-এ মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তার মৃত্যুর পূর্বে এমন একটি বাগানে সমাহিত করার নির্দেশ দিয়ে যান , যেখানে বছরে মাত্র দু’বার ফুল ফুটত। যতদূর জানা যায়, তার শেষ ইচ্ছা মোতাবেক তাকে সেখানেই দাফন করা হয়েছিল। তবে, দীর্ঘকাল তার কবরের কোনো সন্ধান পাওয়া যায় নই। ১৯৬৩ সালে প্রত্নতাত্বিক খননে তার কবরের সন্ধান পাওয়া যায় এবং সেটিকে ‘নিশাপুর’-এ স্থানান্তরিত করা হয়। বর্তমানে সেটি জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে।
“করাও যে-সব মন্দ ভালো
দয়াল সে কি আমার কাজ!
মোর ললাটের লিখন
সে তো তোমার হানা কঠিনবাজ!”
[- ওমর খৈয়াম]
References: ব্রিটানিকা, আল-জাজীরা, যুগান্তর, উইকিপিডিয়া, Omar Khayyam