১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল চেরনোবিলে ঘটে যায় ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক দুর্ঘটনা। সেদিন চেরনোবিলের রিয়েক্টর-৪ এ এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। সেখান থেকে বিকিরিত তেজস্ক্রিয়তার পরিমাণ ছিল হিরোশিমায় ফেলা বোমার প্রায় ৫০০ গুণ। কি ঘটেছিল সেদিন রিয়েক্টর-৪ এর কন্ট্রোল রুমে? সেটা কী নিছকই দুর্ঘটনা ছিল? নাকি কারো অবহেলা ও দায়িত্বহীনতার ফলস্বরূপ বিস্ফোরণ হয়েছিল?
চলুন জেনে নেয়া যাক ,পারমাণবিক বিদ্যুতের সূচনা এবং চেরনোবিলের সেই ভয়াবহ দূর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে। ২১ শতকে এসে বায়ুমন্ডলে কার্বন নিঃসরণের হার ব্যাপক আকার ধারন করেছে। বিভিন্ন কলকারখানা থেকে প্রতিনিয়ত প্রচুর পরিমান কার্বন নিঃসরিত হচ্ছে। কিন্তু পারমাণবিক শক্তি এমন একটি জাদুকরী জিনিস যা কোনো কার্বন নিঃসরণ ছাড়া, কোনো ধোঁয়া ছাড়া, শব্দ দূষণ ছাড়াই শক্তি উৎপাদন করতে পারে। পারমাণবিক শক্তির সাহায্যে সাশ্রয়ী মূল্যেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।
পারমানবিক বিদ্যুতের সূচনা হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যে ওকে ব্রিজের এক্স-১০ গ্রাফাইট চুল্লী ছিল প্রথম পারমাণবিক কেন্দ্র। এখানেই প্রথমবারের মতো পারমাণবিক শক্তি দ্বারা উৎপন্ন বিদ্যুৎ দিয়ে একটি বাল্ব জ্বালানো হয়েছিল। দ্বিতীয়বার ১৯৫১ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহো অঙ্গরাজ্যের আর্কোর কাছাকাছি ইবিআর-১ পরীক্ষামূলক স্টেশনে বৃহৎ পরিসরে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করা হয়।
১৯৫৪ সালের ২৭ জুন বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাওয়ার গ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অবনিনিস্ক শহরে সঞ্চালন করা হয়। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র অন্যসকল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতোই কাজ করে। শুধু তাপের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয় পারমাণবিক শক্তি। এই তাপ পানিকে বাষ্পে পরিনত করে এবং বাষ্পচালিত টারবাইনের মাধ্যমে জেনারেটর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লির কর্মীদের মূল কাজ হচ্ছে কন্ট্রোল রডের সাহায্য চুল্লির অভ্যন্তরে তাপমাত্রা ও পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণে রাখা।
২৬ এপ্রিল চেরনোবিলের কর্মীদেরই কিছু ভুলের কারণে চুল্লির অভ্যন্তরে তাপমাত্রা ও পানির প্রবাহের অসামঞ্জস্যতার তৈরি হয়। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে দুটো জিনিসকে দায়ী করা হয়। প্রথম কারণ টা হলো মানুষ সৃষ্ট। দুটো শিফটে চেরনোবিলের সবগুলো রিয়েক্টর চালানো হতো- ডে শিফট এবং নাইট শিফট।
১৯৮৬ সালের ২৬ এপ্রিল চেরনোবিলের রিয়েক্টর ৪- এ জরুরী অবস্থা সৃষ্টি করে নিরাপদ শীতলীকরণের উপর একটি সেফটি টেস্ট পরিচানলার কথা ছিল।
সেফটি টেস্ট টি করার কথা ছিল ডে শিফটে। এজন্য রিয়েক্টর-৪ এর উৎপাদন ১৪০০ মেগাওয়াট থেকে ৭০০ মেগাওয়াটে নামিয়ে আনা হয় দূর্ঘটনার ১০ ঘণ্টা আগে। কিন্তু পাওয়ার গ্রিড থেকে অনুরোধ করা হয় মধ্যরাতের আগে বিদ্যুৎ উৎপাদন না কমাতে। এজন্য তারা সেফটি টেস্ট টি করার দায়িত্ব দেয় রাতের শিফট কে।
কিন্তু রাতের শিফটের কোনো কর্মকর্তাই সেফটি টেস্টের ব্যাপারে জানতেন না। এটা ছিল দুর্ঘটনার সবচেয়ে বড় কারণ। তাদেরকে টেস্টের ব্যাপারে কোনো পূর্ব নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল না।
দ্বিতীয় কারণ হলো বৈজ্ঞানিক। চেরনোবিলের রিয়েক্টরগুলো ছিল “RBMK” টাইপ নিউক্লিয়ার রিয়েক্টর। “RBMK” রিয়েক্টর কোরের কন্ট্রোল রডগুলো গ্রাফাইট দিয়ে ঢাকা থাকে এবং এসব রিয়েক্টরে কন্ট্রোল রড হিসেবে ব্যবহার করা হয় বোরন রড। একেকটি বোরন রডের ওজন প্রায় ৩৬৫ কেজি।
পারমাণবিক চুল্লিতে ফুয়েল হিসেবে ব্যবহার করা হয় ইউরেনিয়াম-২৩৫।
চুল্লিতে ইউরেনিয়াম-২৩৫ ভেঙে তৈরি হয় নতুন মৌল জেনন। উপরে বলেছি রিয়েক্টর-৪ এর উৎপাদন ৭০০ মেগাওয়াটে নামিয়ে আনা হয়েছিল এবং মধ্যরাতের আগে পর্যন্ত প্রায় ১০ ঘণ্টা এভাবেই চলছিল। “RBMK” রিয়েক্টর পূর্ণ ক্ষমতায় চলানোর সময় এই নতুন সৃষ্ট মৌলও পুড়ে যায়।
কী ঘটবে যদি ৫ সেকেন্ডের জন্য কোনো মহাকর্ষ বল না থাকে? |