স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুকে বলা হয় ভারতীয় উপমহাদেশের বিজ্ঞানচর্চার জনক। তার জন্ম বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। পরিবারের সদস্যরা বাস করতেন প্রথমে বিক্রমপুরের রাঢ়িখালে, তারপর কলকাতায়।ময়মনসিংহে ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর জন্ম এই বিজ্ঞানীর।
বিখ্যাত এই বাঙালির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীজুড়ে। বিবিসির জরিপে শ্রেষ্ঠ ২০ বাঙালির মধ্যে তার স্থান সপ্তম।
জগদীশ চন্দ্র বসুর বাবা ছিলেন ডেপুটি কালেক্টর। পরিবারে অর্থের অভাব ছিল না। চাইলেই ছেলেকে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে পারতেন। কিন্তু, ছেলেকে বাংলা মাধ্যমে ভর্তি করালেন তিনি। তাও ফরিদপুরের একটি স্কুলে। বাবা চাইলেন— সবার আগে নিজের ভাষায় জ্ঞান লাভ করুক তার ছেলে।
ফরিদপুরের স্কুল থেকে জগদীশ চন্দ্র বসুর যাত্রা হয় কলকাতায়। মেধাবী এই মানুষটি ফরিদপুর থেকে ভর্তি হলেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। মেধার প্রমাণ দিলেন স্কুলে। শিক্ষক ও ছাত্ররা জেনে গেল— জগদীশ চন্দ্র বসু নামে একজন মেধাবী ছাত্র তাদের স্কুলে এসেছে।বিশেষ করে সেই স্কুলেই জগদীশ চন্দ্র বসুর বিজ্ঞানশিক্ষা শুরু হয় জোড়ালোভাবে।
সেন্ট জেভিয়ার্সের পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন ফাদার লাফো। বেশ নামডাক ছিল তার পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে। জগদীশ চন্দ্র বসু পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি প্রবল আগ্রহী হয়ে ওঠেন ফাদার লাফোর ক্লাসে গিয়ে।
জগদীশ মাত্র ১৬ বছর বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উওীর্ণ হয়ে শিক্ষাবৃত্তি ঘরে তুলেছিলেন।
ছেলেকে ডাক্তার বানানোর ইচ্ছা ছিল পরিবারের। জগদীশ এক সময় চিকিৎসা বিজ্ঞানে পড়ালেখা শুরুও করেছিলেন বিলেতে গিয়ে। কিন্তু, বাধা হয়ে দাঁড়ায় ম্যালেরিয়া। তার শরীর ভেঙে পড়ে। আর ডাক্তারি পড়া হয়নি তার।
আসলে তাকে বিজ্ঞান হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। একজন বাঙালি হয়ে তিনি এই উপমহাদেশ ছাড়িয়ে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে নামি হয়ে উঠবেন তার আবিষ্কার দিয়ে, তাই হয়ত ডাক্তারি পড়াটা বিদায় নিয়েছিল।
এরপর জগদীশ ভর্তি হলেন কেমব্রিজ এ— প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করার জন্য। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স শেষ করে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন কৃতিত্বের সঙ্গে।
এদিকে, বিলেতের পড়ালেখা শেষ করে জগদীশ নিজ দেশে ফিরে আসেন। পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে যোগদানের বেশ আগেই ডাক্তার মহেন্দ্র লাল সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স। মহেন্দ্র লাল সরকার মনে করেন এই এসোসিয়েশনের মাধ্যমে তার দেশের মানুষ বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন হবে, বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।
জগদীশ চন্দ্র বসু প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি এই এসোসিয়েশনে ক্লাস নিতে শুরু করেন একসপেরিমেন্টাল ফিজিকস বিষয়ে।
এগুলো পড়েছেন? ১।ডক্টর অরুণ কুমার বসাক স্যার এর সাথে একদিন ২।রায়চৌধুরী ইকুয়েশনঃ সিঙ্গুলারিটির সমাধানে এক বাঙ্গালি বিজ্ঞানী ৩।আমাদের গর্ব জামাল নজরুল ইসলাম (১ম পর্ব) |
এরপর শুরু হলো তার নতুন অধ্যায়।
বিজ্ঞানের নানা শাখায় কাজ করেছিলেন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি পদার্থবিদ, উদ্ভিদবিদ, জীববিজ্ঞানী এবং প্রথম কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা। তার গবেষণার ফলে উদ্ভিদবিজ্ঞান শাখা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা হয় তার হাত ধরে।
জগদীশ চন্দ্র বসু সারাজীবন মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার জন্য কাজ করে গেছেন। তার আবিষ্কার, গবেষণা সভ্যতাকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। আজও তার সুফল ভোগ করছেন সবাই।
ভারতীয় উপমহাদেশে তিনিই পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানচর্চা (এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্স) শুরু করেছিলেন। তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের বই লিখেছেন। তার গবেষণা উদ্ভিদবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে তোলে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে তিনি ব্যবহারিক ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা করেন।
বিখ্যাত এই বাঙালি বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম গবেষণা শুরু করেন মাইক্রোওয়েব প্রযুক্তি নিয়ে। তিনি সফলতাও পান। তার এমন গবেষণার কারণে রেডিও আবিষ্কৃত হয়।
বিজ্ঞানী মার্কনি রেডিও আবিষ্কারের আগেই বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসু বিনা তারে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে তথ্য-সংকেত বিনিময়ে সক্ষম হয়েছিলেন এবং প্রদর্শনও করেছিলেন।
নিরহংকারী এই মহাত্মা গোটাকয়েক যন্ত্রের আবিষ্কার করলেও পেটেন্টের প্রতি বিশেষ অনুরাগী ছিলেন না। এমনকি রেডিও সিগনাল শনাক্তকরণে সেমিকন্ডাক্টরের ব্যবহার বিষয়ে তার করা গবেষণাপত্র তিনি উন্মুক্ত করে দেন যেন অন্যান্য বিজ্ঞানীগণ এটি নিয়ে গবেষণা করতে পারেন।
১৯০৯ সালে মার্কনিকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হলো। আর বাঙালি বিজ্ঞানী বেতার তরঙ্গের সৃষ্টির আবিষ্কারক হিসেবে অজ্ঞাত থেকে গেলেন।
“যদিও বেতারের আবিষ্কারক হিসাবে বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন মার্কনি, কারণ জগদীশ বসু এটার আবিষ্কারকে নিজের নামে পেটেন্ট করেননি। এ কারণেই এই আবিষ্কারের জন্য তাঁর দাবি স্বীকৃত হয়নি,” বলেন দ্বিজেন শর্মা।
নতুন নতুন আবিস্কারের নেশায় দিন-রাত কাজ করতে থাকেন তিনি। গাছের জীবন আছে এটি জগদীশ চন্দ্র বসুর আবিষ্কার। ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্র আবিষ্কার করে তিনি এটি প্রমাণ করতে সক্ষম হন।
জগদীশ চন্দ্র বসুর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হচ্ছে মাইক্রোওয়েব রিসিভার ও ট্রান্সমিটারের উন্নয়ন।
জগদীশ চন্দ্র বসু ডক্টর অব সায়েন্স উপাধি পেয়েছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৮৯৪ সালে তিনি বৈদ্যুতিক তরঙ্গের ওপর গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন। এ কারণেই তাকে এতো বড় উপাধি দেওয়া হয়েছিল। এবং ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স তাকে রেডিও বিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করে।
বিজ্ঞান বিষয়ে জগদীশ চন্দ্র বসু বই লিখে গেছেন যা এখনকার সময়ে এসেও বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন জগদীশ চন্দ বসুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বিলেত থেকে বসু যখন খ্যাতি অর্জন করে কলকাতায় ফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথ তার জন্য ফুলের তোড়া নিয়ে দেখা করতে গিয়েছিলেন। একবার টাকার অভাবে জগদীশের গবেষণা প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল। সে সময় রবীন্দ্রনাথ পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
জগদীশ পদার্থবিজ্ঞানে ব্যাপক অবদান রাখার পরও দুনিয়াব্যাপী আরও খ্যাতি লাভ করেছিলেন উদ্ভিদবিজ্ঞানী হিসেবে।জীব ও জড় বস্তু নিয়ে তিনি দীর্ঘ গবেষণা করেছেন।
তিনি সব সময় জীব ও জড়ের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান খুঁজতেন। বিজ্ঞানের ও জ্ঞানকাণ্ডের বিভিন্ন শাখায় জগদীশ কাজ করেছিলেন শুধু সত্য জানার উদ্দেশ্যে।
তিনি বিশ্বকে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন উদ্ভিদেরও প্রাণ আছে। তা নিয়েও প্রথমে কম কথা শুনতে হয়নি তাকে। যদি তার প্রথম আবিষ্কার (রেডিও)টার মূল্য দেওয়া হয়নি ,তবে অনেক লড়াইয়ের পর এই আবিষ্কারটা তার থেকে আর কেউ ছিনিয়ে নিতে পারেনি একে।।
বিশ্বজুড়ে স্বনামধন্য বাংলার এই বিজ্ঞানীর জন্মদিন আজ।
শুভ জন্মদিন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু