আমি আজকে এসেছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আসার উদ্দেশ্যটা অবশ্য আমার জন্য অনেক উত্তেজনাময়। বাংলাদেশের পদার্থবিদ্যার এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং বাংলাদেশে পদার্থবিদ্যার একমাত্র প্রফেসর এমিরেটাস ডক্টর অরুণ কুমার বসাক স্যার এর সাক্ষাৎকার নিতে এসেছি আমি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনের সমাবর্তন বক্তা ছিলেন এই অসম্ভব রকমের বিনয়ী মানুষটি। যাইহোক, আমি এখন স্যারের রুমের সামনে চলে এসেছি।
-শুভ সকাল স্যার। আসতে পারি?
-শুভ সকাল আপনাকে। অবশ্যই।
-কেমন আছেন স্যার?
-ভালো আছি। আপনি?
-জি আমিও ভালো আছি। আমরা তাহলে সরাসরি প্রশ্নোত্তরে চলে যাই স্যার?
-নিশ্চয়।
-শুরুটা তাহলে আপনার শৈশব দিয়েই শুরু করি স্যার। আপনার ছোটবেলা কেমন কেটেছে?
-আমার জন্ম ১৯৪১ সালের ১৭ অক্টোবর পাবনা শহরের রাধানগর মহল্লায়।ছেলেবেলা পাবনা শহরেই কাটে। দেশভাগের সময় আমার বাবা ভারতের মালদহে চাকরি করতেন। তবে দেশভাগের পর মা জন্মভূমি ছেড়ে যেতে রাজি হননি।ফলে বাবাকে চাকরি ছেড়ে চলে আসতে হলো।আস্তে আস্তে সংসারে অভাব দেখা দিলো। তবুও আমার মা আমাকে টিউশনি করতে দিতেন না তখন। সারাদিন সংসারের কাজ করে গভীর রাত পর্যন্ত চরকায় সুতা কাটতেন। ভোরে আমি মায়ের রিলে করা সুতার বান্ডিল কাঁধে করে নিয়ে সেগুলো ফ্যাক্টরিতে দিয়ে আসতাম। সোয়া মাইল হেঁটে নতুন সুতা বাড়িতে রেখে বিদ্যালয়ে পড়তে যেতাম। এই ছিলো মোটামুটি আমার শৈশব।
কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলাম এই অসাধারণ মানুষের অতি সাধারণ শৈশবের কথা। সেইসাথে ভাবছি, অনেককিছু শিখার আছে। যদিও অনেকে যুগের অজুহাত দেন, তবে পরিশ্রম আর ইচ্ছাশক্তি তো আর যুগে যুগে পরিবর্তিত হতে পারেনা।
-অনেক সংগ্রাম আর তীব্র সদিচ্ছার ছিলো আপনার শৈশব। যা নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে যদি বলতেন স্যার।
-আমি ১৯৫৭ সালে পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমি হতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকা এর অধীনে ফার্স্ট ডিভিশনে মেট্রিকুলেশন পাস করি। তারপর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ভর্তি হই এবং ১৯৫৯ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করি।
-আপনার ইন্টারমিডিয়েট এর রেজাল্টও তো চমকপ্রদ ছিলো।
-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তদানীন্তন রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করি।
-আপনার শিক্ষকদের মধ্যে কার অনুপ্রেরণা আপনি বিশেষভাবে স্মরণ করবেন?
-এডওয়ার্ড কলেজে একজন শিক্ষক ছিলেন। মাখন লাল চক্রবর্তী স্যার। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সময়ের প্রথম শ্রেণি পাওয়া। এই শ্রদ্ধেয় শিক্ষকই আমার মনের মধ্যে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন।
-ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর কী করলেন?
-তখন তো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সে অনার্স ছিলো না। তাই রাজশাহী কলেজে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে দুই বছরের অনার্সে পড়েছি। সেখানে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। তারপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে মাস্টার্স করলাম। সেখানেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হলাম।
-এরপর কি কর্মজীবনে প্রবেশ করলেন?
-যেদিন এমএসসি’র রেজাল্ট বের হলো, তার পরদিনই আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাই। প্রথম ক্লাসটি নিতে হয়েছিলো এমএসসি’র। মজার ব্যাপার হলো, ক্লাসের প্রায় ৬০ ভাগ শিক্ষার্থী আমার ক্লাসমেট, আর বাকিরা এক ব্যাচ সিনিয়র। তখন দুইটি কোর্স পড়াতাম আমি।
-আপনার গবেষণা কর্ম সম্পর্কে জানতে চাই।
-আমার গবেষণা জীবন শুরু হয় ১৯৬৩ সালে। এমএসসি’র থিসিসের মাধ্যমে। আমার সুপারভাইজার ছিলেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক আহমদ হোসেন। বিষয়বস্তু ছিলো ‘কণাবিজ্ঞান’। এক বছরের মাথায় ফলাফল পেয়েছিলাম। এটি নিয়ে তখনকার ডেইলি পাকিস্তান অবজারভারে খবর প্রকাশিত হয়।
-এই থিসিসটি আমার জানামতে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল পর্যন্ত পৌঁছেছিলো।
-হ্যাঁ। থিসিস পেপারটি প্রথম উপস্থাপন করা হয় ১৯৬৪ সালের ২৭ আগস্ট চীনের চায়না সিম্পোজিয়ামে।
-আপনার উচ্চতর শিক্ষার জন্য লন্ডনে যাবার কথা ছিলো। না যাওয়ার কারণটা যদি বিস্তারিত বলতেন।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !! |
-১৯৬৫ সালে আমার লন্ডন যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু পাকিস্তান সরকার আমার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করায় সেটি সম্ভব হয়নি। ১৯৭২ সালে আমার পাসপোর্ট নতুন করে ইস্যু হয়। ঐ বছরই কমনওয়েলথ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট স্কলারশিপ নিয়ে আমি লন্ডন যাই। কিন্তু ব্রিটেনের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয় জানায় যে, কণাবিজ্ঞানে গবেষণার জন্য পোস্ট ফাঁকা নেই। নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে গবেষণার সুযোগ আছে। এখান থেকেই মূলত আমার গবেষণা ভিন্নদিকে মোড় নেয়। এরপর ১৯৭৫ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করি।
-এরপর সেখানে থেকে গেলেন?
-হ্যাঁ। ১৯৮১-১৯৮২ সাল পর্যন্ত আমি পোস্ট ডক্টরাল ফেলো ইন নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, দি ওহায়ো স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র এবং পরবর্তীতে রিসার্চ ফেলো ইন লো এনার্জি নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্যে ছিলাম।
-আপনি কোন কোন বিষয় নিয়ে এখন পর্যন্ত গবেষণা করেছেন?
-ব্রিটেনে আমি প্রোট্রন, নিউট্রন, হিলিয়াম থ্রি ইত্যাদি কণার আচরণ সম্পর্কে গবেষণা করি।দেশে এসে ‘ নিউট্রন স্টার‘ নামক একপ্রকার তারা, সেগুলোর স্থিতিস্থাপকতা নিয়ে গবেষণা করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে দেশের একমাত্র গবেষক হিসেবে আমি এই প্রজেক্টে গবেষণা করছি। প্রথম ধাপে ১৯৯৮-২০০১ সালের জুলাই এবং দ্বিতীয় ধাপে ২০০২ এর আগস্ট থেকে ২০০৮ এর জুলাই পর্যন্ত গবেষণা চালাই।
-আপনার গবেষণাগুলোর প্রকাশনা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছি স্যার।আমরা জেনেছি আপনার এ্যালুমিনিয়াম এবং সিলিকন এর নিউক্লিয়ার মিথস্ক্রিয়ার এর উপর কিছু উচ্চমানের গবেষণা রয়েছে।
এই প্রশ্নের উওর দিলেন স্যারের কাছে থাকা আরেকজন ছাত্র ।
-এ পর্যন্ত তিনি ৫৫ টি এমএসসি, ২ টি এম. ফিল এবং ৬ টি পিএইচডি রিসার্চ পেপার তত্ত্বাবধায়ন করেছেন। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জার্নালে তার ১৩৯টি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৮৬ টি স্বীকৃত আন্তর্জাতিক জার্নালে, ২৫ টি দেশীয় জার্নালে এবং বাকিগুলো বিভিন্ন বিজ্ঞান বিষয়ক কনফারেন্সে প্রকাশিত হয়।
আমরা আবার স্যারের কাছে ফিরে আসি ।
-আচ্ছা স্যার, আপনি মূলত নিউক্লীয় মিথস্ক্রিয়ার নতুন একটি তত্ত্ব দিয়ে পৃথিবীতে বাংলাদেশকে আবারো নতুন করে পরিচিত করিয়েছেন। সেই তত্ত্বটা যদি পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলতেন!
-আচ্ছা। পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য ঘুরছে, এটি ছিলো টলেমির তত্ত্ব। টলেমির এ তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করেন কোপার্নিকাস। এ কথা সবার জানা। জগতের নিয়ম এই যে, ধ্রুবতারার উর্ধ্বে উঠে নির্মাণ-পুনর্নির্মাণে নতুন সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পরমাণুর দুইটি নিউক্লিয়াসের মিথস্ক্রিয়ার ক্ষেত্রে এ রকমই একটি নতুন তত্ত্ব তুলে এনেছি আমি ও আমার গবেষক দল। আমরা প্রমাণ করেছি যে, দুইটি নিউক্লিয়াস খুব কাছাকাছি এলে তাদের মধ্যে আকর্ষণী বলের পাশাপাশি এক ধরণের বিকর্ষণী বলেরও উদ্ভব হয়।
– আমাকে আপনার মূল্যবান সময় থেকে এই সময়টুকু দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা রইলো স্যার। আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
– আপনাকেও ধন্যবাদ।
[ ডক্টর অরুণ কুমার বসাক স্যার এর এই কাল্পনিক সাক্ষাৎকারের প্রতিটি তথ্য সঠিক। এই সকল তথ্যের জন্য বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকা এবং অনলাইন পোর্টালের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।]