“হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না)
হয়ে গেল “হাঁসজারু” কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে – “বাহবা কি ফুর্তি !
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি ।””
বিখ্যাত ননসেন্স লেখক সুকুমার রায়ের খিঁচুড়ি কবিতার কাল্পনিক জগাখিচুড়ি নয়, বাস্তবিক অর্থেই রয়েছে এমন এক প্রাণি যার একই দেহে অনেক প্রাণির অঙ্গ! অদ্ভুত এই প্রাণির নাম “জারবোয়া”। শনাক্ত হবার পর থেকেই এর অদ্ভুত দৈহিক গঠনের জন্য বেশ আলোচনায় রয়েছে প্রাণিটি।
জারবোয়ার দৈহিক গঠন:
জারবোয়ার ছবির দিকে তাকালে প্রাথমিকভাবে একে ইঁদুর ভেবে ভুল করতে পারেন। এদের দেহ ইঁদুরের দেহের সাথে অনেকটা মিলে যায়। সমস্ত শরীর নরম পশমে আবৃত, মেটে রঙা দেহ এবং ইঁদুরের মতো মাথার খুলি থাকলেও মুখের সামনে তুণ্ডটি শুকরের সাথে মিলে যায়। আবার মাথার উপর লম্বা লম্বা দুটো কান দেখে এদেরকে ক্ষুদ্র খরগোশ বলে মনে হতে পারে। তবে জারবোয়ার সবচেয়ে অবাক করা বৈশিষ্ট্য দেহের পেছনের দিকে।
সেখানে রয়েছে বিশাল দুটো পা যেই পা জোড়া সামনের দুটো পায়ের চেয়ে অন্তত চারগুণ লম্বা। এইক্ষেত্রে আপনি একে একরকম ক্যাঙারু বলতেই পারেন। এবং এটি চলাচলও করে ক্যাঙারুর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে। পেছনের পায়ের মতোই আরেকটি অদ্ভুত অংশ জারবোয়ার লেজ। শরীর ও মাথার চেয়ে বড় লেজটি দেখে আপনার কাঠবিড়ালির কথা মনে পড়ে যাবে। লম্বা এই লেজের মাথায় রয়েছে কাঠবিড়ালি লেজের মতো ঘন চুল। লেজ ব্যবহৃত হয় দেহের ভারসাম্য রক্ষার কাজে। লেজ ছাড়া শরীরের মূল অংশের দৈর্ঘ্য ২.৮ ইঞ্চি থেকে ৩.৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়।
বাসস্থান:
জারবোয়ার পরিসর এশিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এরা সাধারণত শুষ্ক বালুকাময় মরু অঞ্চলে থাকতে বেশি পছন্দ করে। গোবি মরুভূমিতে সর্বপ্রথম জারবোয়া শনাক্ত হয়।
খাবার:
জারবোয়া নিশাচর প্রাণি। এরা পুরোদিন মাটি বা বালির নিচে কাটায় খাবার সংগ্রহের জন্য রাতের বেলা গর্ত থেকে বের হয়। এরা ছোট লতানো উদ্ভিদ, বীজ খেয়ে থাকে। অবশ্য কিছু প্রজাতি পোকামাকড় শিকারেও বেশ দক্ষ। দেহের প্রয়োজনীয় পানি এরা গৃহীত খাবার থেকেই পায়, তাই এদের অনেক বেশি পানি পান করতে হয় না। এর শক্ত বীজ খেতে পারে না। কখনো খাবার জমিয়ে রাখে না।
জারবোয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ এর পা। সামনের দুটো পায়ের তুলনায় পেছনের পা গুলো অনেক বেশি লম্বা হওয়ায় এরা বেশ লম্বা লাফ দিতে পারে। শিকারী জারবোয়া এই অভিনব পা দিয়ে অনেক সামনের অথবা অনেক উপরের পোকামাকড় শিকার করতে পারে। এশিয়াতে জারবোয়াগুলো সাধারণত পেঁচার দ্বারা শিকার হয়ে থাকে। শিকারীর কাছ থেকে পালাতে এরা ঘণ্টায় ২৪ কিলোমিটার (প্রায় ১৫ মাইল) বেগে ছুটতে পারে।
সাধারণত জারবোয়া একাকী থাকতে বেশি পছন্দ করে। এরা কলোনি গঠন করে না। দাঁত, নখ ও নাক ব্যবহার করে এক থেকে দুই ফুট গভীর একটি সাধারণ গর্ত খুঁড়ে। এই গর্ত মূলত শিকারীর আক্রমণ থেকে বাঁচা ও অত্যধিক তাপমাত্রা সহ্য করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
জারবোয়ার ঘ্রাণশক্তি ও শ্রবণশক্তি বেশ তীব্র। আবার ম্লান আলোতে এদের দৃষ্টিশক্তিও বেশ প্রখর।
জীবনচক্র:
জারবোয়া প্রতি বছর দুই থেকে তিনবার বাচ্চা প্রসব করে। স্ত্রী জারবোয়া একসাথে দুটি থেকে ছয়টি সন্তানের জন্ম দেয়। সদ্য জন্ম নেয়া শিশু জারবোয়ার সামনের ও পেছনের পায়ের দৈর্ঘ্য প্রায় সমান থাকে। ছোট্ট লেজ, লোমমুক্ত দেহ এবং চোখ ও কান বন্ধ থাকে। অন্যান্য Rodents (তীক্ষ্মদাঁত বিশিষ্ট প্রাণীদের বর্গ) এর তুলনায় জারবোয়ার দৈহিক বিকাশ দেরিতে হয়। ১১ মাস বয়স হবার আগ পর্যন্ত জারবোয়া লাফাতে পারে না। এরা যৌনক্ষম হয় ১৪ সপ্তাহ বয়সে যা একটি ইঁদুরের তুলনায় দ্বিগুণ সময়। একবার বাসা ছেড়ে স্বাধীন জীবন পাবার পর এরা প্রায় ৬ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে তাও একটি ইঁদুরের তুলনায় দ্বিগুণ।
জারবোয়ার কিছু প্রজাতি যেমন পাঁচ পা ওয়ালা জারবোয়া, তীক্ষ্ম লেজের জারবোয়া (Salpingotus crassicauda) বিপদাপন্ন। এছাড়াও কিছু জারবোয়া যেমন লম্বা কানওয়ালা জারবোয়া (Euchoreutes naso) এবং মিশরীয় জারবোয়া (Jaculus jaculus) IUCN এর তালিকায় তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে।
শ্রেনিবিন্যাস:
Kingdom : Animilia
Phylum : Chordata
Class: Mammalia
Order : Rodentia
Family : Depodidae
স্তন্যপায়ী প্রাণীটি শ্রেণিবিন্যাসগতভাবে Rodentia বা ‘তীক্ষ্মদন্ত’ বর্গের অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ শ্রেণিবিন্যাসগত ভাবে এটি ইঁদুর বা কাঠবিড়ালি সমগোত্রীয়।