” মাছ আবার উড়তেও পারে!? এও নাকি সম্ভব! কি আজগুবি কথাবার্তা!” শিরোনাম পড়ার পর কি এরকম কিছুই মনে উঁকি দিচ্ছে? আমি বলি কি এতো ভাবাভাবি বাদ দিয়ে ব্লগটি পড়ে ফেলুন, সব রহস্য উদঘাটন করতে পারবেন।
Flying Fish বা উড়ন্ত মাছ পৃথিবীতে রয়েছে বহুকাল ধরে। তবে এরা যে পাখিদের মতো উড়ে উড়ে বেড়ায় সেরকম টা নয়। এরা কিছু সময়ের জন্য পানি থেকে উঠে বাতাসে ভেসে থাকতে পারে, যাকে বলা হয় গ্লাইডিং। গ্রীষ্মমন্ডলীয় সাগরে এই প্রজাতির মাছ দলবেঁধে রাজত্ব করে বেড়ায়। ধারণা করা হয় ডাইনোসর এর আগে থেকেই এদের উৎপত্তি। এমনকি আকাশে পাখি ওড়ার আট কোটি বছর আগে থেকেই এই উড়ন্ত মাছ উড়ে বেড়াচ্ছে।
এই উড়ন্ত মাছদের ইংরেজিতে বলা হয় Flying Fish বা Flying cod. এদের বৈজ্ঞানিক এবং লাতিন উভয় নামই Exocoetidae। এই সামুদ্রিক বা লোনা পানির মাছ Beloniformes বর্গের অন্তর্ভূক্ত। সারাবিশ্বে এই মাছটির প্রায় ৭১ টি প্রজাতি বিদ্যমান।
“Flying Fish” এর প্রধান আবাসস্থল হলো গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের উন্মুক্ত এবং গভীর সমুদ্র (৬৫৬ ফুট গভীরতায়)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরেও এদের দেখা মেলে। সাধারণত সাগরের Epipelagic জোনে এরা অবস্থান করে।
এছাড়াও “Barbados” হলো ইস্টার্ন ক্যারিবিয়ান একটি দ্বীপ, যা “The land of the flying fish” নামে পরিচিত। এই মাছটি সেই দেশের অন্যতম জাতীয় প্রতীকের একটি। দেশটিতে ব্যবহৃত মুদ্রা, কৃত্রিম ঝর্ণার ভাস্কর্য, বিভিন্ন শিল্পকর্ম, ট্যুরিস্ট অথোরিটির অফিশিয়াল লোগো এমনকি পাসপোর্টেও ফ্লাইং ফিশ এর চিহ্ন রয়েছে।
ফ্লাইং ফিশের গ্লাইডিং কৌশল:
কল্পনা করুন তো, একটি মাছ হঠাৎ সাগরের তলদেশ হতে পাখনা ঝাপটিয়ে কিছুক্ষণ উড়ে আবার পানিতে ডুবে গেলো। পৃথিবীর বিস্ময়কর ও সুন্দর দৃশ্যের মধ্যে এটি হলো একটি। কিন্তু সেই মাছের দেহের গড়নে কি এমন ভিন্নতা আছে যার ফলে সে উড়তে পারছে ?
এবার তাহলে ধাপে ধাপে কারণগুলো জেনে নিন:
- গ্লাইডিং এ সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে এদের স্ট্রীমলাইনড দেহের Aerodynamic ডিজাইন। যেমন: হাইপারট্রফিড পাখনা এবং এদের সিলিন্ড্রিক্যাল বডির ভেন্ট্রাল সারফেস(ভেন্ট্রাল সারফেস কোন প্রাণীর সামনের নিম্ন পৃষ্ঠের সাথে সম্পর্কিত)। একজোড়া পেকটোরাল(অন্যান্য মাছের তুলনায় অনেক বড়) ও পেলভিক ফিন এদের দেহে বিদ্যমান। পাখনা গুলো হাওয়া দ্বারা পূর্ণ থাকায় সেগুলো ওজনে অনেক হালকা হয়।
- আরো কিছু মর্ফোলজিক্যাল বৈশিষ্ট্য উড়ন্ত মাছের গ্লাইডিং এর সাথে সম্পর্কিত। এদের স্কেলেটন এ সম্পূর্ণ প্রশস্ত নিউরাল আর্ক বিদ্যমান, এগুলো কানেকটিভ টিস্যু ও লিগামেন্ট এর মধ্যে সন্নিবেশকারক হিসেবে কাজ করে।
- এই সম্পূর্ণ প্রশস্ত নিউরাল আর্কগুলো অনেক বেশি দৃঢ় ও স্থিতিশীল হওয়ার কারণে ভার্টিব্রাল কলাম এবং ক্রেনিয়াম এর মধ্যে খুব সুন্দর ভাবে সংযোগ রক্ষা করে। ভার্টিব্রাল কলাম এর শক্তপোক্ত গঠনই গ্লাইডিং করার সময় বিভিন্ন Aerodynamic সুবিধা দেয়।
- এবার একটু সহজভাবে চিন্তা করুন, আমরা যখন ভূমি থেকে লাফ দিয়ে ওপরে উঠতে চাই তখন অভিকর্ষ বলের কারণে আমাদের এর বিপরীতে কিছুটা বল প্রয়োগ করতে হয়,তবেই উঠতে পারি। সেরকম এই মাছ যখন পানি থেকে বায়ুতে প্রবেশ করে তখন অনেক টা বল খাটালে তবেই উঠতে পারে। ফ্লাইং ফিশের উন্নত ভার্টিব্রাল কলাম এবং হাড়যুক্ত কডাল কমপ্লেক্স তাদের পানি থেকে উঠে আসতে বল প্রয়োগে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করে।
- বাতাসে ভাসতে থাকা অবস্থায় এরা লেজ নাড়ানোর মাধ্যমে গতি বৃদ্ধি করতে পারে। লেজের উপরের অংশ নিচের অংশ থেকে ছোট হয়। গ্লাইডিং এর শেষ পর্যায়ে, তারা পুনরায় সমুদ্রের পানিতে প্রবেশের প্রস্তুতি নেয়। পানি থেকে অল্প দূরত্বে থাকাকালীন এরা পেকটোরাল পাখনা গুলো প্রসারিত ও শক্ত করে ফেলে এবং লেজ পানিতে ভিজিয়ে ধীরে ধীরে পানির ওপর চাপ প্রয়োগ করে বক্ররেখার মতো সৃষ্টি করে।
এদের পানি থেকে উঠে আসার কারণ:
প্রকৃতিতে চলমান ঘটনাগুলোর পিছনে কোনো না কোনো কারণ বিদ্যমান। তেমনি, ফ্লাইং ফিশের পানি থেকে উঠে আসার প্রধান কারণ হলো বিভিন্ন শিকারী মাছের থেকে নিজেদের আত্মরক্ষা করা। এছাড়াও পানির উপরিতলে ভাসমান প্ল্যাংকটন খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেও এরা উপরে উঠে আসে।
ফ্লাইং ফিশ সম্পর্কে কিছু মজার তথ্য:
১.এদের বৈজ্ঞানিক নাম Exocoetidae এসেছে লাতিন শব্দ exocoetus থেকে, যার অর্থ হচ্ছে “sleeping outside”. যারা এই নাম দিয়েছেন তারা গবেষণা করে দেখেছেন পূর্বে ফ্লাইং ফিশ ঘুমানোর জন্য পানি থেকে তীরে উঠে আসতো।
২. ১৯০০ থেকে ১৯৩০ এর দশকে, বিমানের বিভিন্ন মডেলের উন্নয়নের জন্য ফ্লাইং ফিশের উড্ডয়ন পর্যবেক্ষণ করা হতো।
৩. রঙ-বেরঙের আলোর প্রতি এদের রয়েছে তীব্র নেশা। আলোর প্রতি এই আগ্রহকে মাছ শিকারিরা কাজ লাগায়। তারা ফ্লাইং ফিশের ওপর আকর্ষণীয় আলো ফেলে তাদের জালে আটকে ফেলে। তবে, যখন চাঁদের পূর্ণ আলো থাকে তখন এই মাছগুলোকে ধরা যায় না।
৪.এদের পাখনার বাঁকানো অংশটি পাখির aerodynamic পাখার সাথে অনেকটা তুলনামূলক।
৫. ২০০৮ সালে জাপানের একজন টেলিভিশন ক্রু একটি ফ্লাইং ফিশের গ্লাইডিং চিত্রায়িত করেছিলো। সেই মাছটি ৪৫ সেকেন্ড পানির উপরে ভেসে ছিল। সাধারণত এই মাছগুলোর গ্লাইডিং এর সময়কাল ৩০ সেকেন্ড।
৬. এই মাছগুলো প্রায় ৭০ কি.মি/ঘণ্টা বেগে ভ্রমণ করতে পারে। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে সর্বাধিক ২০ ফুট ওপরে উঠতে পারে। তবে, প্রায়শই দুর্ঘটনাক্রমে এরা জাহাজের ডেকে অবতরণ করে।
উড়ন্ত মাছ কি খাওয়া যায়?
হ্যাঁ, খাওয়া যায়। এই মাছগুলো খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি এতে বিভিন্ন ম্যাক্রোনিউট্রিয়েন্টসও বিদ্যমান। Barbados এর জাতীয় মাছ “ফ্লাইং ফিশ”। এছাড়াও, জাপান, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ইন্ডিয়ায় বানিজ্যিক ভাবে এই মাছ ধরে বাজারজাত করা হয়। বাংলাদেশেও দুটি গণ-এর অন্তর্ভূক্ত তিনটি প্রজাতির উড়ন্ত মাছ পাওয়া যায়। সেইন্ট মার্টিন স্থানীয় মাছের বাজারেও কদাচিৎ এদের দেখা মেলে।
এই হলো উড়ন্ত মাছের জানা-অজানা তথ্য। আমার সাধ্যমত আমি এই আশ্চর্যকর “উড়ন্ত মাছ” সম্পর্কে আপনাদের জানাতে চেষ্টা করেছি। নিজের চোখে এদের গ্লাইডিং দেখতে চাইলে ইউটিউবে “Flying Fish” লিখে সার্চ করুন আর উপভোগ করুন এদের দুর্দান্ত উড্ডয়ন প্রক্রিয়া!