১৯৬১ সালের ১২ ই এপ্রিল। ইউরি গ্যাগারিনের হাত ধরে মানুষ প্রথমবারের মতো পৃথিবী অতিক্রম করে পাড়ি জমিয়েছিল মহাকাশের পথে। এই মহাকাশই আদিম মানুষের কাছে একসময় ছিল অজেয়, কিন্তু মানবজাতির জন্য কোনো কিছুই বোধহয় অসাধ্য ছিল না। তাইতো আজ আমরা পৃথিবী রেখা অতিক্রম করে ছুটে গিয়েছি মহাকাশের অদূর প্রান্তে, তৈরি করেছি কৃত্রিম উপগ্রহ, পাঠিয়েছি নভোযান, এখন তো আবার মহাকাশে থাকার ও ব্যবস্থা আছে; যার নাম ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশন (ISS)।
এফআরআই এর মানদণ্ড অনুসারে, ১৯৬১ সাল থেকে ৪১ দেশের মোট ৫৭৪ জন নাগরিক মহাকাশে গিয়েছে। মহাকাশের এই লুকায়িত রহস্য উদঘাটনের দুঃসাহসিক অভিযানে প্রাণ হারিয়েছিল বহু নভোচারী, তবুও রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষের মহাকাশযাত্রা আজও থেমে নেই। মহাকাশে এমন কয়েকটি গা হিম করা মৃত্যু দূর্ঘটনার মধ্যে মিশন সয়ুজ-১১ এর নাম আসবেই; যেই দূর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিল তিনজন নভোচারী।
মিশন সয়ুজ ১১ (Soyuz 11) -এর ক্রুয়েরা তিন সপ্তাহ মহাকাশে থাকার পর যখন মহাকাশ স্টেশন- স্যালিউট-১ (Salyut 1) থেকে পুনরায় পৃথিবীতে প্রবেশের জন্য মহাকাশযানে নিম্নচাপের সৃষ্টি করে তখনই এ প্রাণহানি ঘটে। উদ্ধারকারী দল তিনজন ক্রু-কেই মৃত অবস্থায় পায়। এই তিনটি প্রাণহানি হল (২০২১ সাল পর্যন্ত হিসাবে) মহাকাশে মানুষের প্রথম প্রাণহানি (পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটারের উপরে )।
সয়ুজ-১১ এর মহাকাশযানের মৃত ক্রুদের নিয়ে অবতরণের স্থানটির স্থানাঙ্ক হলো 47.35663 ° N 70.12142 ° E । এই স্থানটিতে একটি ত্রিমাত্রিক ধাতব কলামের আকারে একটি স্মৃতিস্তম্ভ যার প্রতিটি পাশে কলামের উপরের অংশে একজন ক্রু সদস্যের ছবি খোদাই করা হয়েছে)।
মহাকাশে যে তিনজনের প্রাণহানি হয়েছে:
জর্জি ডোব্রোভোলস্কি (১জুন ১৯২৮- ২৯ জুন ১৯৭১), একজন সোভিয়েত মহাকাশচারী ছিলেন যিনি Soyuz 11 মহাকাশযানের তিন সদস্যের ক্রুকে কমান্ড করেছিলেন। তার মৃতদেহের ছাই মস্কোর রেড স্কোয়ারে “ক্রেমলিন ওয়াল নেক্রোপলিসের”একটি কলসে রাখা হয়েছিল।
ভিক্টর পাটসায়েভ ( ১৯ জুন ১৯৩৩- ২৯ জুন ১৯৭১), একজন সোভিয়েত মহাকাশচারী ছিলেন যিনি Soyuz 11 মিশনে ক্রু ছিলেন। তিনি Salyut 1 স্পেস স্টেশনে ওরিয়ন 1 স্পেস অবজারভেটরি পরিচালনা করেন এবং তিনিই পৃথিবীর প্রথম বায়ুমণ্ডলের টেলিস্কোপ পরিচালনা করেন।
ভ্লাদিস্লাভ ভলকভ ( ২৩ নভেম্বর ১৯৩৫- ২৯ জুন ১৯৭১), একজন সোভিয়েত মহাকাশচারী ছিলেন যিনি Soyuz 7 এবং Soyuz 11 মিশনে অংশ নিয়েছিলেন। যদিও তার দ্বিতীয় মিশন সমাপ্ত হয়েছে তার মৃত্যুর মাধ্যমে। তাকে “হিরো অব সোভিয়েত ইউনিয়ন” হিসেবে দুবার সম্মানিত করা হয় (প্রথম ২২ অক্টোবর ১৯৬৯ এবং মরণোত্তর ৩০ জুন ১৯৭১)।
মহাকাশে মৃত্যু হলে দেহে কি ধরনের অস্বাভাবিকতা দেখা যায়- এখন আসি সে কথায়:-
- মহাকাশে প্রাণত্যাগ করা কোনো নভোচারীর দেহ পচার সুযোগ পাবেনা। রেডিয়েশন ও বায়ুশূন্যতায় শরীরের যত ব্যাকটেরিয়া আছে, ওগুলো মারা যাবে বা শীতনিদ্রায় চলে যাবে।
- লাশ যদি পৃথিবীর কক্ষপথের সাথে চলে তবে তা কম চাপের কারণে সিদ্ধ হয়ে মমিতে পরিণত হবে।
- অন্যদিকে, যদি লাশ পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে সৌরজগতের বাইরের দিকে থাকে, যেখানে তাপমাত্রা শূন্যের নীচে থাকায়, লাশটা জমে শক্ত হয়ে যাবে। যেহেতু বায়ু শূন্যতায় তাপের পরিবহনও দ্রুত হয়না তাই এরকম হতে কয়েকদিন এমনকি কয়েক সপ্তাহও লেগে যেতে পারে।
- মাউন্ট এভারেস্ট বা আল্পস পর্বতমালার হিমবাহের মাঝে লাশ যেমন বছরের পর বছর ভালো থাকে, মৃতদেহ চেনার মতো থাকে, তেমনি মহাকাশেও লাশটা কয়েক মিলিয়ন বছর পরেও চেনা যাবে।
- ২০০৫ সালে একটি সুইডিশ কোম্পানি এমন একটি সিস্টেম প্রস্তাব করেছিল যা মূলত শুষ্ক মৃতদেহগুলোকে বরফে পরিণত করবে এবং তা ছোটো ছোটো টুকরোয় পরিনত করবে এতে করে জায়গা অনেক কমে যাবে এবং সেই মৃতদেহকে পৃথিবীতে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া যাবে।
মহাকাশ ভ্রমণের শুরু থেকে এই পর্যন্ত মহাকাশ ফ্লাইট মিশনের সময় মোট ১৮ জন নভোচারী/ মহাকাশচারী মারা গেছেন। এর মধ্যে মহাকাশে থাকাকালীন অবস্থায় ৩ জন মৃত্যু-বরণ করেছেন। ১৯৭১ সালে, তিনজন মহাকাশচারী, ভ্লাদিস্লাভ ভোলকভ, ভিক্টর পাটসায়েভ এবং জর্জি ডোব্রোভোলস্কি স্যালিউট-১ স্পেস স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাদের অকাল মৃত্যু হয়েছিলো। পরে তাদের মৃত্যু দেহ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তাদের মুখে গাঢ় নীল দাগ, এবং নাক, কান দিয়ে রক্ত ঝরতে দেখা যায়। পরে একটি তদন্তে জানা গেছে যে শ্বাস -প্রশ্বাসের বায়ুচলাচল ভালভ ফেটে যাওয়ার পরে তারা শ্বাসরোধে মারা যায়।
ক্রেডিট: টিম নিকোলা টেসলা, ক্যাম্পাস এম্বাসেডর ব্যাচ-২, সাইন্স বী।
তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, অ্যাস্ট্রোনমি.কম, স্ল্যাট নিউজ, নাসা।