এই আর্টিকেল লিখতে বসে এক গল্প মনে পরে গেলো; ২০১২ সালের কথা, নোকিয়ার কোন এক জাভা ফোন ব্যবহার করতাম (সেম্বিয়ান ফোনও ছিল যদিও), তখন ইন্টারনেট এতোবেশি ফাস্ট ছিল না, সর্বচ্চ গতি ছিল ২০-৩০ কিলোবাইট/সেকেন্ড! তো ইউটিউব সম্ভবই ছিল না, ইন্টারনেট থেকে ভিডিও কন্টেন্ট ডাউনলোড করে তারপরে উপভোগ করতে হতো। কিন্তু তখনকার ফোনে এখনকার মতো হাই রেজুলেশন ভিডিও সাপোর্ট করতো না, এতো ভালো কোডেক সাপোর্টও ছিল না ফোনের জন্য!
আমার ফোনের স্ক্রীন ছিল 320×240 রেজুলেশনের, এখন কোন ভিডিও প্লে করতে হলে এই রেজুলেশনেরই হতে হবে সাথে বিটরেট বেশি হলে বা x264 কোডেক হলেও ভিডিও বেঁধে বেঁধে প্লে হতো। যাইহোক, আসল কাহিনীতে আসি, তো অনলাইনে ৭২০পি রেজুলেশনের ভিডিও আমি ফোনে কনভার্ট করে 320×240 বানিয়ে তারপরে প্লে করতাম। ইয়েস, জাভা ফোনে ভিডিও কনভার্ট!
ওয়েল, সেটা ট্রুলি ফোনে কনভার্ট হতো না, একটা ওয়েব অ্যাপ ছিল যেটার মাধ্যমে এই কনভারসেশনের কাজ করতাম। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন তখন স্মার্টফোনের যুগও তেমন শুরু হয়েছিল না, কিন্তু মোবাইল ব্যবহার করেই পিসির কাজ করে ফেলতাম। আর এখনকার গল্প তো সম্পূর্ণই আলাদা, এখনকার ফোনে ল্যাপটপের থেকে বেশি পরিমাণে র্যাম ইন্সটল থাকতে দেখা যায়, ফোনের প্রসেসরও অনেক ক্ষমতাবান হয়ে গেছে। তাহলে কি আমাদের আর পিসির দরকার নেই, মোবাইল দিয়েই কি পিসির সব কাজ করা যেতে পারে?
চলুন, এই আর্টিকেলে আলোচনা করা যাক মোবাইল বনাম পিসি (কম্পিউটার) নিয়ে!
মোবাইল Vs পিসি
মৌলিকভাবে দেখতে গেলে বর্তমানে মোবাইল আর পিসির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই, এরা টেকনিক্যালভাবে একই স্টাইলে কাজ করে। পিসির যেমন র্যাম, সিপিইউ, জিপিইউ, মাদারবোর্ড, বা অপারেটিং সিস্টেম থাকে স্মার্টফোনের ক্ষেত্রেও একই হার্ডওয়্যার থাকতে দেখা যায় এবং এরা একইভাবেই কাজ করে। আর জেনারেল পারপাসে পিসি দিয়ে যে যে কাজ করানো যেতে পারে স্মার্টফোন দিয়েই সেই সেই কাজ করানো যেতে পারে।
ওয়েব ব্রাউজিং, ভিডিও প্লে, ভিডিও কনভার্ট, অডিও মিক্সিং সবকিছুই ফোন এবং পিসি উভয় ডিভাইজ দিয়েই করানো যেতে পারে। আর এক কথায় বলতে আপনার হাতে যে স্মার্টফোন ডিভাইজটি রয়েছে সেটা একটা কম্পিউটারই! আজকাল তো ল্যাপটপের থেকে ফোনেরই দাম বেশি হয়ে থাকে। একটি ফ্ল্যাগশিপ ফোনের দাম দিয়ে অনেক শক্তিশালী গেমিং পিসি বিল্ড করা যেতে পারে।
এখন পিসি আর মোবাইল যে সম্পূর্ণই একাকার হয়ে গেছে বা পিসির আর কোন প্রয়োজনীয়তাই নেই এমনটা কিন্তু নয়। এই দুই ডিভাইজ একেক টাইপের টাস্ক এবং নানান বিজনেস মডেলের উপরে তৈরি করা হয়েছে। স্মার্টফোন বিশেষ করে পোর্টাবিলিটির কথা চিন্তা করে এবং লো পাওয়ারে ডিসেন্ট পারফর্মেন্স দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে। অপরদিকে ডেক্সটপ, ল্যাপটপ, বা ট্যাবলেট পিসিকে হেভি ওয়ার্ক লোড সহ্য করার জন্য এবং বেশি পাওয়ার ইউজ করে বেস্ট পারফর্ম করার জন্য তৈরি করা হয়েছে।
হ্যাঁ ফোনেও আপনি ভিডিও রেন্ডার করতে পারবেন, কিন্তু পিসির তুলনায় সেটা কয়েক গুন বেশি স্লো হবে। একই দামের মধ্যে একটি ফোন এবং একটি পিসির মধ্যে তুলনা করলে পিসি সব সময়ই বেশি পারফর্ম করবে। ফোন অনেক ছোট সাইজের হয়ে থাকে, মানে আপনি পকেটে করে এমন হাই কনফিগারের কম্পিউটার নিয়ে ঘুরে বেরাতে পারেন। আর ফোন লো পাওয়ারে অপারেট হতে পারে। এই ছোট ডিভাইজে এতো শক্তি একত্র করতে কোম্পানিদের বেশি টাকা খরচ হয়েই জন্যই পিসির তুলনায় ফোন অনেক দামি হয়ে থাকে।
অপরদিকে ডেক্সটপ বা ল্যাপটপ সাইজে অনেক বড় হয়ে থাকে, এদের প্রসেসর অনেক বড় হয় কুলিং সিস্টেম বেশি ভালো হয় ফলে বেশি ভালো পারফর্মেন্স প্রদান করতে পারে। মোবাইলে এক ছোট্ট জায়গায় সব হার্ডওয়্যার গুলো ঠেসে চেপে লাগানো থাকে এবং কুলিং সিস্টেমও ভালো থাকে না, তাই ফোন সেই পরিমাণে পারফর্ম করতে পারে না, আর ফোনে ফিজিক্যাল লিমিটেশন তো রয়েছেই!
স্মার্টফোন
- এটা বিশেষ করে পোর্টেবল সাইজের বানানো হয় যাতে পকেটে বহনযোগ্য হতে পারে।
- প্রয়োজনে ফোন তার পারফর্মেন্স ডাউন করে দেবে তারপরেও যেন ব্যাটারি লাইফ বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়, কেননা এটা পোর্টেবল ডিভাইজ আর ব্যাটারি পাওয়ার ছাড়া ফোন ডেড হয়ে যাবে!
- ফোনের একটি প্রদান কাজ হচ্ছে সেলফোন নেটওয়ার্কের সাথে কানেক্টেড থাকা, ভয়েস কল করা, এবং সেলুলার ডাটা ব্যবহার করা।
- ফোনের সাইজ অনেক ছোট হয়ে থাকে তাই পিসির মতো এতে টেরাবাইটস অফ স্টোরেজ আঁটানো সম্ভব হয় না। তবে এখনকার ফোনে ৫১২ গিগাবাইট পর্যন্ত স্টোরেজ সাপোর্ট চলে এসেছে, শীঘ্রই হয়তো কয়েক টেরাবাইট পর্যন্তও স্টোরেজ দেখা যাবে, কিন্তু পিসি যে পরিমাণে স্পেস সাপোর্ট করতে পারে সেটা ফোনের ক্ষেত্রে সেইভাবে সম্ভব হবে ফিজিক্যাল সাইজ লিমিটেশনের জন্য!
- এতে ডে টু ডে লাইফ ইউজেসের জন্য অ্যাপ গুলো কাজ করে, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাপ বা ফটো এডিট বা এমনই কিছু লাইটওয়েট কাজ করার জন্য ফোনকে তৈরি করা হয়, ফোন হাই এন্ড ওয়ার্কলোড সহ্য করার জন্য তৈরি করা হয় না।
- ফোনের বেশিরভাগ অ্যাপ্লিকেশন গুলো ব্যাকএন্ড সার্ভারের সাহায্যে কাজ করে, যেমনটা আমি এই আর্টিকেল শুরুর দিকেই বর্ণনা করেছি। এই অ্যাপ গুলোর প্রসেস সরাসরি ফোনে রান না থেকে সার্ভারে রান হয়ে থাকে।
পিসি (কম্পিউটার)
- পিসি স্মার্টফোনের মতো সাইজের দ্বারা প্রভাবিত নয়, এর বড় বড় যন্ত্রাংশ অনেক কমদামেই কিনতে পাওয়া যায় (যেমন- ম্যাকানিক্যাল হার্ড ড্রাইভ, র্যাম, সলিড স্টেট ড্রাইভ)
- পিসিতে আপনি ইনপুট/আউটপুট ডিভাইজ কানেক্ট করতে পারবেন, হ্যাঁ ফোনেও কানেক্ট করা যায় কিন্তু কিন্তু ফোনে একটা লিমিটেশন থাকে যেটা পিসির ক্ষেত্রে থাকে না।
- পিসি হাই এন্ড ওয়ার্কলোডে কাজ করানোর জন্য বিশেষভাবে অপ্টিমাইজড হয়ে থাকে, ফলে ক্যাড ডিজাইন, বড় ডাটাবেজ হ্যান্ডেল করা, হাই রেজুলেশন ভিডিও রেন্ডারিং, সফটওয়্যার কম্পাইল করা, সার্ভার অ্যাপ্লিকেশন রান করা, এগুলো পিসিতে অনেক বেশি সহজ এবং এফিসিয়েন্ট!
- আপনি ল্যাপটপকে ব্যাটারির জন্যও অপ্টিমাইজ করতে পারবেন আবার এর থেকে বেস্ট পারফর্মেন্সও বের করে নিতে পারবেন, পিসির সিস্টেমের উপরে ফোন চেয়ে আপনি বেশি কন্ট্রোল খুঁজে পাবেন!
- ফোনে যতোই ১২ জিবি বা ১৬ জিবি র্যাম থাকুক না কেন, পিসির মতো এতো এফিসিয়েন্ট মাল্টি টাস্কিং করার ক্ষমতা স্মার্টফোন গুলো এখনো অর্জন করতে পারেনি, অনেক বড় সাইজের র্যাম থাকার পরেও ব্যাকগ্রাউন্ড টাস্ক গুলো ফোনে ধরে রাখতে পারে না!
তো আশা করছি, ফোন এবং পিসির মধ্যের পার্থক্য গুলো আপনি এতক্ষণে বুঝে গেছেন। আর হ্যাঁ কম্পিউটারের সাথে আপনি একটি বড় স্ক্রীন পান সেখানে কাজ করা অনেক বেশি সহজ হয়ে যায়। কিন্তু মোবাইলের স্ক্রীন অনেক ছোট হওয়াতে সব টাইপের কাজ এতে করা সম্ভব হয় না। হ্যাঁ, মোবাইলেও এক্সটারনাল স্ক্রীন কানেক্ট করা যায়, কিন্তু মোবাইল তো আর এক্সটার্নাল স্ক্রীনে চালানোর জন্য না, তাই না?
আপনি যে ফোনে এই আর্টিকেলটি পড়ছেন, টেকনিক্যালভাবে সেটা একটি কম্পিউটারই! তবে এই কম্পিউটার লাইটওয়েট টাস্ক গুলো হ্যান্ডেল করার জন্য বিশেষভাবে তৈরি করা। আর পিসি হেভি ওয়ার্কলোড গুলো সহ্য করার জন্য! তো বুঝলেন তো ব্যাপার গুলো?