চোখের কোণাটা খচখচ করছে মোবিন সাহেবের,চেষ্টা করে জায়গাটা চুলকাতে পারছেন না। বারবার মাথাটা এপাশ ওপাশ করে ব্যাপারটা কন্ট্রোলের চেষ্টা করলেন,কিন্তু বরং খচখচানিটা তার নিজের অবস্থাতেই থাকলো। অনুভব করলেন,তার হাতটাও নাড়াতে পারছেন না…পা টাও না।তিনি কি মারা গেছেন ?
যদি আদৌ গিয়ে থাকেন তাহলে তার চোখ খচখচ করছে কেন ? শরীরটা তো হালকা লাগার কথা,তাহল ঘটনা কি ? তার বাপ দাদার আমলের লেখকরা বলেছেন,গায়ে চিমটি দিয়ে স্বপ্ন না বাস্তব দেখা হত,আচ্ছা,কেউ মারা গেছে কিনা সেটাও কি পরীক্ষা করা হত ?
মোবিন সাহেব মনে মনে একটু খুশিই হলেন,অবশেষে তার এই অথর্ব্য জীবন থেকে মুক্তি এসেছে।কারন একটু আগেই তার মাথায় এসেছে তিনি প্যারালাইজড,ভয়াবহ রকমের প্যারালাইজড।শরীরের ঐচ্ছিক পেশির ক্রিয়া সেকেন্ডের একটা ছোট ভুলের জন্য থেমে গেছিলো,এখন তাকে শ্বাস পর্যন্ত নিতে হয় ভেন্টিলেটর এর সাহায্যে।তার মনের সুখটা ৬০ ওয়াটের বাল্বের মত ফিউজ হয়ে গেল যখন তিনি অনুভব করলেন,একটা ঠান্ডা হাত তার মাথা টিপে দিচ্ছে।
অর্থাত মবিন শিকদার,এমএসসি,পিএইচডি,এমফিল এখনো জীবিত,ভয়াবহ রকমের জীবিত।
জোর করেই চোখটা খুললেন,ভেবেছিলেন তার সাধের চিন্তাসুখের বারোটা বাজানো হাতের অধিকারীকে একটা কড়া কথা শোনাবেন।কিন্তু না,তার বদলে তার সামনে উপস্থিত হল বৃষ্টি আর কুয়াশার হালকা সাদা পর্দা।বৃষ্টি তখনো পড়ছে,ঝিরঝির আওয়াজ আসছে একটানা।তার মেডিকেল বেড থেকে একটা জানালা দেখা যায়,তারপরে হাসপাতালের শ্যাওলা আর মস জমা একটা দেয়াল আর তারপর…কিছুই না। চোখ ঘুরিয়ে পরিবেশটা বোঝার চেষ্টা করলেন,তিনি আজ তিন হপ্তা হাসপাতালে।
“এখন কেমন বোধ করছো?” একটা পরিচিত নারী কন্ঠ এর সাড়া দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন,তুলির কথার কোন উত্তর দিতে ইচ্ছা করছে না। তাও ঘাড় ঘুরিয়ে মুখটা দেখলেন,চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে,অনেক কথাই বলছে তুলোর বলের মত মুখটা…তাও কোন কথার জবাব তিনি দেবেন না।একটা শ্বাস ছেড়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যায় সে,হয়তো ডক্টর এর সাথে আলাপ করবে।
নার্স এসে তার শরীর পরিষ্কার করে দিয়ে গেলেন,পুরোটা সময় চুপচাপ থাকলেন।তার মাথায় চিন্তার ঝড় চলছে এখন। কে যেনো জানলাটা খুলে দিয়ে গেছে,নিশ্চয় তুলি।একটু আগে বৃষ্টি ছিল,কিন্তু এখন শুধুই দমকা হাওয়া।তার রুমে একটা উইন্ড চাইম আছে,বাতাসে সেটা পাগলের মত দুলছে,ভেসে আসছে কোন অজানা জাপানি সুর। একমুহূর্তের জন্য মোবিন সাহেব অনুভব করলেন,পুরোনো স্মৃতি আর ক্ষোভের সাগরে তিনিও দুলছেন।
“দেখো,মানবদেহ জন্ম থেকেই ত্রুটি সম্পন্ন।আমরা নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব বলি ঠিকই,কিন্ত কিছু ক্ষেত্রে আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি।এটা আসলে আমাদের সীমাবদ্ধতাই নির্দেশ করে”,নিজের রুমে স্মোক করতে করতে কথাগুলো আশফারকে বলছিলেন মোবিন সাহেব।
“চিন্তা করে দেখো,এমন একটা সিচুয়েশন তৈরি হল,যেখানে তোমার সিদ্ধান্ত তোমার জীবনসহ বাকি সবার জীবন বাচিয়ে দিবে,অথচ দেখা গেলো তুমি নির্বোধের মত আঙুল চুষছ…”
আশফার ভেবে দেখে ব্যাপারটা,মোবিন স্যার আসলে কি চান…কন্ঠে স্পষ্ট পূর্ব দেশীয় টানে প্রশ্ন করে সে, “স্যার আপনার কথা স্পষ্ট নয়”।তার দিকে তাকিয়ে একটা চতুর হাসি দেন মোবিন সাহেব, “আমরা হয়তো স্ট্যাক ইমিপ্লেন্ট করতে চলেছি”। ঘরে যেনো একটা মৃদু বজ্রপাত হলো,একমুহূর্তে আশফার এর মনে হল সময় থেমে গেছে।“স্যার,আপনি ঠিক আছেন কিনা জানিনা,কিন্তু এবিষয়ে আইনটা আমি একটু স্মরণ করিয়ে দেই,”ঠান্ডা গলায় বলতে থাকে সে , “আপনি হয়তো ভুলে গেছেন,সম্প্রতি নিও সি গ্রুপের চাপে পার্লামেন্ট এ একটি বিল পাশ হয়েছে এই মর্মে যে,যেহেতু মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব,সুতরাং মানুষের জৈবিক উন্নতি হয় এমন কোন পরীক্ষা বা যন্ত্র এর সংযুক্ত চলবে না”,এক নিঃশ্বাসে বলে থামলো সে।
মোবিন সাহেব চাপা হাসলেন,আর দমের জন্য আশফার তার উত্তরের অপেক্ষায় রইল। “যদি আমি পাইয়োনিয়ারদের পক্ষে চালটা দেই?” আশফার ভ্রু কুচকালো,তাহলে আইনটা মাঠে প্রয়োগের সম্ভাবনাটা আটকানো যাবে।
গতশতকের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক যুদ্ধ বলতে যদি কিছুর নাম করা হয়,তাহলে নিও সি বনাম পাইয়োনিয়ার দের যুদ্ধটা সবার আগে চলে আসবে,এটা এখনো চলছে।যদিও পার্লামেন্ট পরিচালিত হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পদ্ধতিতে নির্বাচিত একদল নারী পুরুষের দ্বারা,তবুও আইন বিতর্ক (সংসদীয় বিতর্কের নতুন নাম) এ এই দুই দলের প্রাধান্য বেশ লক্ষণীয়।স্বভাবতই,দুই দলের উদ্দ্যেশ্য সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর,সাধারণ মানুষের জীবনে এসব প্রবেশ করে কমই।
কিন্তু মোবিন সাহেব আর আশফার এর মত নীতির প্রয়োগ এবং ব্যবহার সংক্রান্ত পেশার মানুষের জন্য এই আইনগুলোই খেয়াল রাখার মত বিষয়। যেকোন পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ থাকার শপথ করলেও এক সময় না এক সময় একটা দল বাছতেই হয়।
মোবিন সাহেব স্পষ্টতই একটা পক্ষ নিতে চান, “আশফার দেখ,আমরা যদি আমাদের কাজে সফল হই তাহলে পাইয়োনিয়াররা একটা শক্ত ভীতের উপর দাড়িয়ে যাবে,হাসপাতালে চিকিতসা নিতে আসা পঙ্গু লোকদের যান্ত্রিক সাহায্য দিতে কোন বাধাই থাকবে না”। আশফার এ ঘাড় নাড়ানো ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
এরপরের ঘটনা প্রবাহ স্রোতের মত।স্ট্যাকের ডিজাইন থেকে ইমপ্রুভমেন্ট সব করা হয় মোবিন সাহেবের পরিকল্পনামাফিক,পাইয়োনিয়াদের কোন একটি গোপন ফ্যাসিলিটিতে।যদিও খরগোশ বা বানরের দেহে সফল অস্ত্রপচার সম্পন্ন হয় এবং দেখা যায়,তাদের একটি নির্দিষ্ট প্যাটার্নের সিগনালের প্রতি সাড়া দেবার সক্ষমতা বাড়ছে,কিচ্ছু ক্ষেত্রে সেটা বিজ্ঞানীদের আন্দাজকেও ছাড়িয়ে গেল।
পাইয়নিয়ার দলের বিজ্ঞানীরা সাফল্যের হাসি হাসলেন,কিন্তু একটা প্রশ্ন তাদের চেহারায় উকিঝুকি মারা শুরু করে,এই স্ট্যাকের প্রয়োগ কোন মানুষের উপর হবে,কেউ কেউ প্রস্তাব করলেন কোন ডি ক্লাস পার্সনেল এর উপর করার,কিন্তু বাকিরা সেই প্রস্তাব সমূলে নাকচ করলেন ।কেই বা চায় ,কোন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত কয়েদী হুট করে প্রখর বুদ্ধিমান হয়ে উঠুক……যদিও সফল অস্ত্রপচার এর ইতিহাস থাকলেও মৃত্যুর সম্ভাবনা তখন প্রায় ৩০%।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !! গল্পে গল্পে মমি নিয়ে কিছু অদ্ভুত আবিষ্কার (১ম পর্ব) অ্যান্টার্ক্টিকা: চলুন ঘুরে আসি পৃথিবীর দক্ষিণ প্রান্ত থেকে! |
সবাইকে অবাক করে দিয়ে মোবিন সাহেব উঠে দাড়ালেন,কূট যুক্তি দিয়ে আদায় করলেন সবার সম্মতি।শুধু হার মানলেন তুলির কাছে,কিন্তু সে কথায় কান দেবার সময় খুবই নগণ্য…সামনে মানবজাতির উন্নতি বা ধ্বংসের দরজা,তাকে যে জানতেই হবে তার ওপর পাশের কি আছে।তাই,কোন এক ঝড়ের রাতে বিদায় নিলেন তিনি,গোপনীয়তার স্বার্থে সেই দিন তারিখ আর জায়গার নাম উল্লেখ করা হল না।
বাইরের বৃষ্টি থেমে গেছে ,বাতাসের গতিও তেমন নেই।উইন্ড চাইমটা হালকা পলকা দুলছে ,টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে।খুট করে কেবিনের দরজা খুলে গেলো,আশফার আর তুলি একটা ক্রেট ঠেলতে ঠেলতে ঢুকলো ভেতরে,তুলি আবার এসে বসে মোবিন সাহেবের পাশে ।
আশফাফ ক্রেট খুলতে হাত লাগিয়েছে,এবং শেষ পর্যন্ত যা বের হল সেটাকে একটা এক্সো স্কেলিটন বলা যায়।মোবিন সাহেব তুলির দিকে তাকিয়ে একটা শ্বাস ছাড়লেন,গলা দিয়ে শব্দ করার চেষ্টাও করলেন সামান্য।ডাক্তার এসে তার অবস্থা ব্যাখা করে গেছে,তিনি প্যারালাইজড নন কিন্তু তার দেহ একটা দীর্ঘ দূর্বলতায় আক্রান্ত।ব্রেন সিগন্যাল এবং মাসল রিসেপ্টর এর কাজে নতুন স্ট্যাকটা ওভারল্যাপ করছে।এই দূর্বলতা আদৌ যাবে কিনা বা বাড়বে কিনা…তিনি যে মারা জাননি সেটাই উজ্জ্বাপনের ব্যাপার এখন।
আশফার তার মিনি ল্যাপটপটা খুলে এক্সো স্কেলিটন এর প্রোগ্রাম সেটাপ করতে থাকে,উইন্ড চাইমের টুংটাং শব্দের জায়গা দখল করে নিলো কি বোর্ডের শব্দ। “আমরা আসলে আপনার স্ট্যাকের সাথে এই স্কেলিটন এর একটা কানেকশন তৈরি করছি,ওভারল্যাপ জনিত সমস্যা আশা করি তাতে কাটানো যাবে।তখন আপনার মাসল এবং ব্রেইন এ্যাকটিভিটি পর্যবেক্ষণ করে আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারবো’।মোবিন সাহেবের ঠোটটা বেকে গেল সামান্য,সেটা হাসি কিনা তিনিই বলতে পারবেন।
DAy 150……
এক্সোস্কেলিটন এবং স্ট্যাক ভালই কাজ করছেন,ভাল বললে ভুল হবে…সিগন্যাল ওভারল্যাপের যে সমস্যা ছিল তা নেই বলেই চলে।কিন্তু মোবিন সাহেব একটা বিষয় অনুভব করছেন,তা খুবই জটিল,এবং এতই জটিল যে,তিনি ছাড়া ব্যাপারটি কেউ হয়তো বুঝবে না। খুব সহজ করে বললে,তিনি স্ট্যাক এর অধীনে চলে যাচ্ছেন।তার সচেতন চিন্তা সুস্পষ্ট দুটো ভাগে বিভক্ত,যার একটা অংশ নিয়ন্ত্রণ করে স্ট্যাক।
তিনি অনেক বেশি শুনছেন,বেশি অনুভব করছেন,কিন্তু সেসবের সমন্বয় করতে পারছেন না।আবার চিন্তার তার অংশের সমন্বয় ক্ষমতা ভাল হলেও স্ট্যাকের অংশটি সেটা সাথে সাথে নাকচ করে দিচ্ছে।ফলে সৃষ্টি হচ্ছে একটা দ্বন্দের,মাঝখান থেকে অবচেতন মন থেকে আসা অবসাদ মোবিন সাহেবকে গ্রাস করছে।কি বলা যায় কে? হয়তো নতুন কোন নাম হবে এই রোগের ।
এমন অনেক কাজ করছেন মোবিন সাহেব যার কোন ব্যাখা নেই,তবে এখন যা করছেন তাতে তার স্ট্যাকের কোন হাত নেই,বরং শক্তিশালী একটি ইলেক্ট্রিক ইম্পালস ব্যবহার করে স্ট্যাককে দমিয়ে রেখেছেন।মোবিন সাহেব সুইসাইড করতে চান,তার বলা প্রতিটা কথা তার মনে বাজছে……সুইসাইড করলে তার সচেতন মনের মোবিন অংশ মারা যাবে,স্ট্যাক এসে দখল করবে সেটা।এভাবে পুনর্জন্ম হবে তার,তবে তিনি মোবিন হিসেবে বাচবেন না কোন বাইনারি পরিচয় নিয়ে বাচবেন সেটা পরের বিষয়।
আড়াই ঘন্টা পর,সেটাপ কমপ্লিট,এটা একটা নাইট্রোজেন চেম্বার।নাইত্রোজেন সাধারণ বায়ু চাপে নিষ্ক্রিয় তবে উচ্চচাপে এটি কোন জীবিত দেহে চালনা করলে একটি শান্তিদায়ক মৃত্যু ঘটে।মোবিন সাহেব আস্তে করে চেম্বার এর দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন,মাথাটা আস্তে আস্তে দপদপ করছে। স্ট্যাকের কাজ,তিনি বুঝলেন।তাকে এখন জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে,কিন্তু তার আগেই তিনি নাইট্রোজেন ভালভ অন করে দিলেন।
তার চোখে ভেসে উঠলো তুলির মুখ,সে কি এই ধাক্কা সামলে উঠতে পারবে…হয়তো পারবে,তুলি অনেক শক্ত মেয়ে।তার মাথাটা দপদপ করছে,ঝিমুনিও আসছে হালকা হালকা,তিনি কি তবে মারা যাচ্ছেন ? তবে সে চিন্তা বেশিক্ষণ রইলো না,তার আবার বাচার চেতনা জেগে ওঠে,তার এখনো নিও সি দের সামনে একটা উদাহরণ দাড় করানো বাকি।আচ্ছা ,তার এই চিন্তা কেন আসছে মাথায়,তার তো মারা যাবার কথা।কিছু উচ্চারণ করার আগেই মোবিন সাহেব চেম্বারের মেঝেতে পড়ে জ্ঞান হারালেন,নাইট্রোজেন তার ফুসফুস দখল করে নিয়েছে।
মোবিন সাহেব হাসপাতালের বেডে শোওয়া,মাথার পাশে আশফার জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে আছে।“এত তাড়াতাড়ি মারা গেলে হবে স্যার,অন্তত প্রথম কোন স্ট্যাক ব্রেইন কোল্যাব স্পেসিমেন তো হারাতে চাই না”,মোবিন সাহেব ঘাড়টা ঘুরিয়ে রাখলেন…স্ট্যাকটা তাকে মরতে দেয়নি,উল্টে সবাইকে খবর পাঠিয়েছে।
প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে তার,কথা বলতে ইচ্ছা করছে না ।