আকাশের তারার সাথে আমাদের সবারই ভালো পরিচয় আছে। আমাদের গ্যালাক্সি ‘আকাশগঙ্গা’য় প্রায় ৪০,০০০ কোটি তারা আছে; আর আমাদের ব্রহ্মান্ডের দৃশ্যমান অংশে প্রায় ২০,০০০- ৫০,০০০ কোটি গ্যালাক্সি আছে। সুতরাং ব্রহ্মাণ্ডের মোট তারার সংখ্যা হিসেব করতে কম্পিউটার প্রয়োজন। আজ শুনবো কিছু রহস্যময় তারা সম্পর্কে।
১।আর্দ্রা
হেমন্তের সন্ধ্যায় পুব আকাশে যে নক্ষত্রময় শিকারি পুরুষ উদিত হয় সে হল কালপুরুষ (Constellation Orion)। ওই কালপুরুষের বাঁ কাঁধের রক্তবর্ণ বিস্ময় ভরা তারাটি হল আর্দ্রা। গ্রিক নাম বেটেলগিউজ (Betelgeuse)। পৃথিবী থেকে ওর দূরত্ব প্রায় ৬৫০ আলোকবর্ষ। সূর্যের চেয়ে ২০ গুণ ভারী আর্দ্রার বয়স মাত্র ২০ কোটি বছর। যেখানে আমাদের সূর্যের বয়স প্রায় ৪৫০ কোটি বছর। আর ৪৫০ কোটি বছর বয়সেও সূর্য নবীন যুবক তারা; কিন্তু আর্দ্রা ২০ কোটি বছরেই মৃত্যুপথযাত্রী! কিন্তু কেন তার মৃত্যু আসন্ন? সেটা জানতে গেলে নক্ষত্রের বিবর্তন কাহিনি অল্প কথায় জেনে নিতে হবে।
প্রথমে দেখা যাক, নক্ষত্রের জন্ম হয় কীভাবে?
অতিকায় এক হাইড্রোজেন গ্যাসপিণ্ড জমাট বেঁধে তারার জন্ম দেয়। ঐ সুবিশাল গ্যাসপুঞ্জ একত্রিত হলে বিপুল অভিকর্ষীয় চাপে তার কেন্দ্রস্থলে হাইড্রোজেন গ্যাসের নিউক্লিয় দহন শুরু হয়। সরলতম নিউক্লিয় দহনে হাইড্রোজেন গ্যাস অন্তত ১,৩৫,০০,০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পুড়ে হিলিয়াম গ্যাস তৈরি করে এবং নির্গত করে আলোকশক্তি।
সূর্যের কেন্দ্রে এই প্রক্রিয়ায় প্রায় ১,৫০,০০,০০০ সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় প্রতি সেকেন্ডে ৬০ কোটি টন হাইড্রোজেন পুড়ে হিলিয়াম আর আলো তৈরি হচ্ছে। প্রায় এই হারেই সূর্য তার হাইড্রোজেন জ্বালানী পুড়িয়ে এসেছে গত ৪৫০ কোটি বছর ধরে। কিন্তু এর পরেও সূর্যে যে পরিমাণ হাইড্রোজেন জ্বালানী মজুত আছে তাতে আরো ৫০০ কোটি বছর তো চলবেই, ১০০০ কোটি বছরও চলতে পারে।
তাহলে আর্দ্রার এমন মুমূর্ষু দশা কেন?
সূর্যের চেয়ে ২০ গুণ জ্বালানী রয়েছে ওর ঘরে, বয়সও মাত্র ২০ কোটি বছর, অথচ মৃত্যু ওর নিকটবর্তী! কারণ সৃষ্টি থেকেই আর্দ্রার জীবনধারা আলাদা ছিল। জন্মের সময় আর্দ্রার ভর ছিল আরো অনেক বেশি– সূর্যের ভরের প্রায় ৩০ গুণ। ওই সুবিশাল ভরের চাপে ওর কেন্দ্রের তাপমাত্রা হয়ে ওঠে অত্যধিক, প্রায় ৩,০০,০০,০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। অত তাপে হাইড্রোজেন হু-হু করে পুড়ে সব জ্বালানী শেষ। যেই জ্বালানী শেষ হল, অমনি কেন্দ্র থেকে শক্তির নির্গমন বন্ধ হল, আর অভিকর্ষীয় বলের চাপে কেন্দ্রীয় অঞ্চল চুপসে যেতে শুরু করল।
কেননা, ওই বহির্মুখী শক্তিই ঠেলে রেখেছিল অন্তর্মুখী অভিকর্ষীয় বলকে। এবারে যেই কেন্দ্রীয় অংশ চুপসে যেতে থাকল, অমনি তারকার বহির্মন্ডলে শুরু হল হাইড্রোজেনের নিউক্লিয় দহন যা তারকার বহির্ভাগকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বিশাল থেকে বিশালতর করে তুলতে লাগল। আমাদের পরিচিত আকাশে জ্যেষ্ঠা, রোহিণী, স্বাতী– সব তারার এখন এই দশা। এই মৃত্যুকালীন দশার নাম লোহিতদানব দশা (Red giant stage)।
২।পিস্তল তারকা
পৃথিবী থেকে ২৫০০০ আলোকবর্ষ দূরে ধনুরাশিতে থাকা ‘পিস্তল তারকা’ (Pistol star) আর এক আশ্চর্য তারা। গত শতাব্দীর নব্বই দশকে এই তারাটি আবিষ্কারের পর মনে করা হয়েছিল এটিই আকাশগঙ্গা গ্যালাক্সির সবচেয়ে ভারী তারা। এর ভর সৌরভরের প্রায় ১৩০ গুণ। ধনুরাশির (Constellation Sagittarius) আলো আর ধুলোর আড়ালে থাকা এই তারার নাম পিস্তল তারা কেন হল তার উত্তর লুকিয়ে রয়েছে এর বদমেজাজী চরিত্রে।
আজ থেকে প্রায় ৬০০০ এবং ৪০০০ বছর আগে পিস্তল তারা নিজের শরীরে দুটি ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রায় ১০ সৌরভর পরিমাণ বিপুল গ্যাস বাইরে ছুঁড়ে দেয়। ওখানেই সে থেমে থাকেনি। তার গরম মেজাজের শরীর ঘিরে এখনো বইছে তীব্র নাক্ষত্রিক বাতাস– সৌরবাতাসের ১০০০ কোটি গুণ বেগে। ঐ বেগে বাতাস সূর্যের শরীরে বইলে সূর্য কবেই ছিন্নভিন্ন হয়ে যেত। পিস্তল তারকার উজ্জ্বলতা সূর্যের উজ্জ্বলতার ১৬,০০,০০০ গুণ।
সূর্যে গোটা এক বছরে যে আলোকশক্তি উৎপাদন হয়, পিস্তল তারকা মাত্র ২০ সেকেন্ডেই ঐ শক্তি উৎপাদন করে দিতে পারে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বলছেন, পিস্তল তারার বয়স মেরে কেটে ৪০ লক্ষ বছরের বেশি নয়। জন্মকালে তার ওজন ছিল অনেক বেশি, প্রায় ২০০ সৌরভর।
বদমেজাজী করে বিপুল পরিমাণ গ্যাস বাইরে নিক্ষেপ করায় এখন তার ভর অনেক কমে গেছে। কিন্তু ভর কমলেও জ্বালানী ফুরোয়নি। সে মৃত্যুপথযাত্রী নয়, সে যুবক তারকা। বিজ্ঞানীরা এই শ্রেণীর তারাদের নাম দিয়েছেন নীলবর্ণ উজ্জ্বল বিষমতারা (Luminous blue variable)। আকাশগঙ্গার ৪০০০০ কোটি তারার মধ্যে মাত্র ১০০টি তারা এই শ্রেণীর। পিস্তল তারার বয়স এখন ৪০ লক্ষ বছর। আগামী ১০-২০ লক্ষ বছরের মধ্যেই বিপুল হাইপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে ওর মৃত্যু হবে।
৩।ইটা ক্যারিনা
শোনা যাক দক্ষিণ আকাশের নৌকাতল মন্ডলীর (Constellation Carina) তারা ইটা ক্যারিনার কথা। পৃথিবী থেকে প্রায় ৮০০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা এই তারাটির ভর সৌরভরের ১২০ গুণ। জন্মকালে তারাটির ভর ছিল প্রায় ১৫০ সৌরভর। অতিকায় এই তারার উজ্জ্বলতা গত তিন শতাব্দী ধরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে-কমেছে।
এর প্রকৃত উজ্জ্বলতা হিসেব করে বিজ্ঞানীরা দেখলেন তা সূর্যের উজ্জ্বলতার প্রায় ৫০,০০,০০০ গুণ। তারাটি ৩০ সৌরভরের একটি তারাকে এবং অতিকায় এক নীহারিকাকে অভিকর্ষ বলের টানে নিজের চারদিকে ঘোরাচ্ছে। ইটা ক্যারিনার ব্যাস বিশাল, সৌরব্যাসের ২৪০ গুণ। ইটা ক্যারিনাও সুপারনোভা বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে।
৩।এনএমএল সিগনাই
উত্তর আকাশে হংসমণ্ডলীর (Constellation Cygnus) তারা ‘এনএমএল সিগনাই’ অমনই এক বিচিত্র তারা। ওর ব্যাস সৌরব্যাসের ১৬৫০ গুণ। অর্থাৎ ওর ভেতর কোটি সূর্যের ঠাই হয়ে যাবে। পৃথিবী থেকে ৫৩০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা এই তারাটি খালি চোখে দেখা যায় না; হংসমন্ডলীর আলো আর ধুলোর আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে।
সৌরভরের ৩০ গুণ ভরযুক্ত এই নক্ষত্রটিও রয়েছে মৃত্যুকালীন লোহিত দানব দশায়। তারাটি কিন্তু ওর নক্ষত্রজীবনের মূলপর্যায়ে নেই; রয়েছে মৃত্যুপথযাত্রী লোহিতদানব (Red giant) পর্যায়ে। নক্ষত্রকেন্দ্রের সমস্ত হাইড্রোজেন নিউক্লিয় দহনে শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারকাটির বহিঃস্তর ফুলেফেঁপে উঠে এমন বিচিত্র দশায় পৌঁছেছে। তারাটির দুর্দশা ওই ফুলেফেঁপে বিশালাকৃতি ধারণেই শেষ হয়নি। প্রতি বছর ও সৌরভরের ০.০২ শতাংশ জ্বলন্ত গ্যাস ( ৪ x ১০২৫ কিলোগ্রাম ) বাইরে ছুঁড়ে ফেলছে।
জ্বলন্ত গ্যাস বাইরে ছুঁড়ে ফেলার বিচারে এযাবৎ জানা নক্ষত্রদের মধ্যে এনএমএল সিগনাই সবচেয়ে এগিয়ে। নিকট ভবিষ্যতে এটা সুপারনোভা বিস্ফোরণে ফেটে যাবে।
৪।পিওনি তারকা
ছায়াপথের দ্বিতীয় উজ্জ্বলতম তারা ‘পিওনি স্টারে’র (Peony nebula star) দিকে এবার তাকানো যাক। ধনুরাশির গভীরে ছায়াপথের কেন্দ্রের কাছে অর্থাৎ পৃথিবী থেকে প্রায় ২৬০০০ আলোকবর্ষ দূরে আছে এই তারাটি। পিওনি নীহারিকার আলো-ধুলোর আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকা এই অত্যুজ্জ্বল তারার জন্মকালীন ভর অন্ততপক্ষে সূর্যের ভরের ১৭৫ গুণ ছিল। এর পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা প্রায় ২৫০০০ কেলভিন। বয়স মাত্র ৩০ লক্ষ বছর।
উলফ-রায়েট শ্রেণিভুক্ত পিওনি তারকা খুব দ্রুত বিবর্তিত হয়ে মৃত্যুকালীন হাইপারনোভা বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে শীঘ্রই (শীঘ্র মানে জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসেবে আগামী ১০-২০ লক্ষ বছরের মধ্যে)। জীবনের মূলপর্যায়ের ভর ২০ সৌরভরের বেশি হলে সেগুলি বিবর্তিত হয়ে উলফ-রায়েট তারায় পরিণত হয়।
এই ব্লগটি পড়তে ভুলবেন না ! |
এই তারাদের পৃষ্ঠতল অত্যন্ত উত্তপ্ত ,৩০০০০ থেকে ২,০০,০০০ কেলভিন পর্যন্ত তাপমাত্রা হতে পারে। বহির্মণ্ডলে নাক্ষত্রিক বাতাস (stellar win) অত্যন্ত তীব্র, ২০০০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা। ফলে প্রতি বছর এই শ্রেণীর নক্ষত্রগুলির শরীর থেকে সৌরভরের এক লক্ষ ভাগের একভাগ পরিমাণ বিপুল জ্বলন্ত প্লাজমা বাইরে নির্গত হয়, যা সূর্যের ওজন-হ্রাসের প্রায় ১০০ কোটি গুণ।
৫।ভি ৮৩৮ মোনোসেরোটিস
২০০০০ আলোকবর্ষ দূরে থাকা মধ্য আকাশের একশৃঙ্গ তারকামণ্ডলের (Constellation Monoceros) অদ্ভুত সুন্দর তারা ‘ভি ৮৩৮ মোনোসেরোটিস’কে দেখতে হলে হাবল বা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির স্পেস টেলিস্কোপগুলির সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তারাটির চারপাশে বহুবর্ণী আলোয় মাখা গ্যাস ও ধুলিপুঞ্জ তারাটির বিস্ফোরণের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে। ৪০ লক্ষ বছর আগে তারাটির ভর ছিল সূর্যের ভরের ৬৫ গুণ।
কিন্তু তারাটি বিপুল পরিমাণ জ্বলন্ত গ্যাস বাইরে নিক্ষেপ করায় ওর ভর এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৫ সৌরভরের সমান। তাপমাত্রা ৩০০০০ কেলভিন থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৩২৭০ কেলভিনে। ভি ৮৩৮ মোনোসেরোটিসের অবস্থান ছায়াপথের ঘূর্ণনতল (galactic disk) থেকে অনেকটাই দূরে।
তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী, গ্যালাক্সির ঘূর্ণনতল থেকে বেশি দূরে অতিকায় নক্ষত্র এর জন্ম হওয়া সম্ভব নয়। তাই কীভাবে এই তারার জন্ম হল তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা দ্বিধান্বিত আছেন। ধোঁয়াশা রয়েছে নক্ষত্রটির বিবর্তন নিয়েও। সুন্দর এই নক্ষত্রটি নক্ষত্রজীবনের ঠিক কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীমহলে বহু মত আছে।
কেউ মনে করেন, এর কেন্দ্রীয় তারাটি কার্বন আর অক্সিজেনের সমন্বয়ে তৈরি শ্বেত বামন (White dwarf) তারা। কেউ মনে করেন, এটি ৮ এবং ০.৩ সৌরভরযুক্ত দুটি তারার সংঘর্ষজনিত বিস্ফোরণ। আবার কেউ মনে করেন যে, তারাটির তীব্র অভিকর্ষীয় টানে কোন গ্রহ তারা টির আবহমন্ডলে ঢুকে পড়ায় ঘর্ষণজনিত তীব্র উত্তাপে ডয়টেরিয়ামের নিউক্লিয় দহন শুরু হওয়ায় আবহমন্ডল ফুলে উঠেছে।
এইরকম হাজার হাজার রহস্যময় তারা রয়েছে এই মহাবিশ্বে। যেগুলো প্রতিনিয়ত নতুন নতুন রহস্য বিজ্ঞানীদের সামনে আনছে। এদের শেষ যে কোথায় এই মূহুর্তে তা ভাবাটাও নিছক বোকামি!
কিছু সোর্স:
https://en.m.wikipedia.org/wiki/WR_102ka
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Pistol_Star
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Eta_Carinae
https://www.constellation-guide.com/v838-monocerotis/
https://en.m.wikipedia.org/wiki/Ardra_(nakshatra)