ইন্টারস্টেলার মুভিতে একটি দৃশ্য রয়েছে যেখানে তিনজন নভোচারী একটি মহাকাশযানে করে একটি গ্রহে যান ও ছোট একটি স্কাউটশিপে করে দুইজন নভোচারী ওই গ্রহে নেমে সেখানে কয়েক মিনিট অতিবাহিত করে যখন মূল মহাকাশযানে ফিরে আসেন, তখন দেখেন তৃতীয় নভোচারী অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছে। যা সময় সম্প্রসারনের বেশ ভালো একটি উদাহরণ।
বৈজ্ঞানিক অনেক সিনেমা থেকে সময় সম্প্রসারণ সম্পর্কে আমরা বিভিন্ন সময়ে জানতে পারি। এসব সিনেমার মাধ্যমে আমাদের সময় সম্প্রসারণ সম্পর্কে দিন দিন কৌতূহল বেড়ে চলছে। আমরা সাধারণ মানুষ মনে করি, সময় সাধারণত স্থির কিন্তু সময় সম্প্রসারণ বিষয়টি সামনে আসার পর সবার কাছে এটি পরিষ্কার হলো যে সময় স্থির নয়, আপেক্ষিক।
কালদীর্ঘায়ন বা সময় সম্প্রসারণ বোঝার আগে আমাদের বুঝতে হবে স্থানকাল কী? আগে, অর্থাৎ অতীতে আমরা সবাই ভাবতাম যে, আমাদের পুরো মহাবিশ্বটা হলো ত্রিমাত্রিক মানে শুধু দৈর্ঘ্য, প্রস্থ আর উচ্চতাবিশিষ্ট। কিন্তু আইনস্টাইনের মতে, আমাদের মহাবিশ্ব হলো চতুর্মাত্রিক অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা আর সময়কে নিয়ে গঠিত। আর এই স্থানের তিন মাত্রা আর সময়ের একমাত্রাকে মিলিতভাবে একসাথে বলে স্থানকাল বা স্পেস-টাইম। সোজা কথায় চতুর্মাত্রিক এই মহাবিশ্বের প্রতিটা অংশই হলো স্থানকাল (Space-time)। যখন একটা বস্তুকে আমরা মহাকাশে স্থাপন করব তখন সেই বস্তুটা তার চারপাশের স্থানকালকে বাঁকিয়ে ফেলবে। কোনো একটি বস্তুর কারণে স্থানকালের যে ধরনের বক্রতা তৈরী হয় তাকেই বলে স্থানকালের বক্রতা বা Space-time Curvature।
জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি অনুযায়ী, কোনো বস্তুর উপর স্থানকালের বক্রতার প্রভাবই হলো মহাকর্ষ আর এই প্রভাব কোনো প্রকার আকর্ষণবল নয়। কোনো একটি বস্তুকে মহাকাশে স্থাপন করলে বস্তুটি শুধুমাত্র তার চারপাশের স্থান বা স্পেসকেই বাঁকিয়ে ফেলে না বরং সময়কেও বাকিয়ে ফেলে। এইকারণে স্থানকালের বক্রতার কারণে সময় ধীরে চলে, একে বলা হয় মহাকর্ষীয় কাল দীর্ঘায়ন বা Gravitational Time dilation। আবার একইভাবে কোনো একটি বস্তুর স্থানকালের বক্রতার ফলে বস্তুটির চারপাশের স্পেস বা স্থানও বেঁকে যায়।
এখন যদি কোনো বস্তু যথেষ্ট শক্তিশালী স্থানকালের বক্রতা তৈরী করতে পারে তাহলে বস্তুটি তার চারপাশের স্থানকে বা স্পেসকে এমনভাবে বাঁকিয়ে দেয় যে, কোনোকিছু এমনকি আলোও তা থেকে বের হতে পারে না। কারণ তখন বস্তুটির চারপাশের স্পেস এমনভাবে বেঁকে যায় যে, যাই এর ভেতরে একবার ঢোকে তা বার বার একই জায়গায় ফিরে আসে; ফলে তা কখনো বের হতে পারে না। যেমন ব্ল্যাকহোলের ক্ষেত্রে হয়। ব্ল্যাকহোল তার চারপাশের স্পেসকে এমনভাবে বাকিয়ে দেয় যে, যা এর ভেতরে একবার ঢোকে তা কখনো বের হতে পারে না।
জার্মান বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের কথা আমরা কমবেশি সবাই জানি। কিন্তু এর ব্যাখ্যা কি জানা আছে?
ধরা যাক, একজন পরীক্ষার্থী তার অবস্থানে বসে পরীক্ষা দিচ্ছে। ঠিক তখন সে ঘড়িতে সময় দেখছে, আর পরীক্ষক রুমের এক পাশ থেকে অপর পাশে চলন্ত অবস্থায় গার্ড দিতে দিতে ঘড়ি দেখছেন। চলন্ত পরীক্ষকের ঘড়ি, স্থির পরীক্ষার্থীর ঘড়ির চেয়ে ধীরে ধীরে ঠিক পরিমাপ করবে। সে সময় পরীক্ষক মনে মনে চিন্তা করেন, “সময় যেন কাটে না ! বড় বোরিং বোরিং লাগে…!” আর পরীক্ষার্থী মনে মনে চিন্তা করে, ‘এই টাইম যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো !’ অতএব চলন্ত অবস্থায় শিক্ষকের ঘড়ি ধীরে চলছে বলে মনে হবে; আর স্থির অবস্থানে বসে থাকা পরীক্ষার্থীর ঘড়ি চলছে অতি দ্রুত! এটাকেই কাল দীর্ঘায়ন বা সময় প্রসারণ বলে। অতএব, সময় পরম বা ধ্রুব নয়, সময় হচ্ছে আপেক্ষিক।
আপনি যদি ফেসবুকে পাঁচ ঘণ্টা ধরে অনলাইনে থাকেন, তাহলে আপনার মনে হবে, আপনি যেন মাত্র পাঁচ মিনিট ধরে অনলাইনে আছেন। কিন্তু আপনি যদি পাঠ্যপুস্তকের সামনে পাঁচ মিনিটও বসে থাকেন, তাহলে আপনার মনে হবে, আপনি যেন অনন্তকাল ধরে বসে আছেন! অর্থাৎ সময় পরম নয়, সময় আপেক্ষিক।
অন্যদিকে ৫বছর ধরে দুজন মহাকাশ গবেষক একসাথে গবেষণা করছিল। এরমধ্যে প্রধান গবেষকের ও তার এসিস্টেন্টের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাই তারা এ সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে গেলে সমস্যার সম্মুখীন হয়।কারণ প্রধান গবেষকের বয়স তার এসিস্টেন্ট থেকে ২০বছর বেশি অর্থাৎ গবেষকের বয়স ৫০বছর এবং এসিস্টেন্টের বয়স ৩০বছর এখন তাদের পরিবার এ সম্পর্ক মেনে নিবে না।তাই গবেষক আলোর বেগের ৯৮% বেগে মহাকাশে ৪ বছরের জন্য রওনা হলেন এবং যখন তিনি পৃথিবীতে ফিরে এলেন তখন তাদের উভয়ের বয়সই একই হয়ে গেল (এক্ষেত্রে পৃথিবীর সাপেক্ষে গবেষকের বয়স পরিমাপ করা হয়েছে) এবং তারা তাদের সম্পর্ককে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে পারেন। যা কাল দীর্ঘায়নের কারণে সম্ভব হয়েছে।
দৈর্ঘ্য সংকোচনঃ
আবার ধরা যাক, আপনি সারা রাত ফেসবুক চালানোর পর সকালে পরীক্ষা দিতে গিয়ে প্রশ্ন পেয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসে আছেন। আপনি যখন কিছুই পারছেন না, আপনার সামনের বন্ধুটি প্রতি মিনিটে ১০০ শব্দ লিখে যাচ্ছে! আপনি তার লেখা দেখার জন্য আকুতি করলেও তার কোনো ভাবান্তর হচ্ছে না। পরীক্ষার শুরুতে তার প্রতি আপনার মনে যত ‘দৈর্ঘ্যের’ বন্ধুত্বসুলভ অনুভূতি ছিল, পরীক্ষা চলার সময় তার গতিশীল বিরতিহীন লেখার জন্য সেই অনুভূতি সংকুচিত হতে শুরু করল। বন্ধুকে মনে হতে লাগল চিরশত্রু। তার লেখার গতি বৃদ্ধি পায় আর আপনার মনে বন্ধুত্বসুলভ অনুভূতি কমতে থাকে। এই প্রভাবকেই দৈর্ঘ্য সংকোচন বলে।
স্থান আর কালের আপেক্ষিকতার ব্যাপারটা সবাই মেনে নিলেও ভরের আপেক্ষিকতার কথায় হয়তো অনেকেই ভ্রু কুঁচকে ফেলবেন। অনেকেই হয়তো প্রশ্ন করবেন, ‘এ আবার কেমন কথা? ভর ধ্রুবক না তো কী? ভর পরিবর্তন হয় নাকি?’ হ্যাঁ, ভরও আসলে ধ্রুবক নয়; ভর আপেক্ষিক এবং শক্তিতে রূপান্তরযোগ্য। ভর এবং শক্তি প্রকৃতপক্ষে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। অর্থাৎ কোনো পদার্থের ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায়, আবার শক্তিকেও ভরে রূপান্তর করা যায়।
মনে করা যাক, আপনার কলেজের মেজাজযুক্ত স্যারটির বাঁ হাতের ভর আড়াই কেজি, সেটি আপনার কানের নিচে এসে থাপ্পড়ে পরিণত হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সেই হাতে ৪২০ কিলোজুল শক্তি সঞ্চিত হবে। থাপ্পড় যখন আপনার কানের নিচে স্থাপিত হবে, তখন আপনার কান ভারী হয়ে যাবে এবং একটি তীক্ষ্ণ শব্দ শুনতে পাবেন। আর আপনি তো জানেন, শব্দ এক প্রকার শক্তি। অর্থাৎ ভরকে শক্তিতে রূপান্তর করা যায়। অর্থাৎ E=mc^2.
গ্র্যাভিটেশনাল টাইম ডায়ালেশন হলো সময়কে বিভক্ত করার একটি রূপ যা মহাকর্ষীয় ভর থেকে পৃথক দূরত্বে অবস্থিত পর্যবেক্ষক দ্বারা পরিমাপকৃত দুটি ঘটনার মধ্যে অতিবাহিত সময়ের একটি বাস্তব পার্থক্য। মহাকর্ষীয় সম্ভাবনা যত কম হবে (মহাকর্ষের উৎসের সাথে ঘড়িটি আরও কাছাকাছি থাকবে), ধীরে ধীরে সময় অতিবাহিত হয়, মহাকর্ষের সম্ভাবনা বাড়ার সাথে সাথে গতি বাড়ছে।
পৃথক পৃথক উচ্চতায় (এবং একইভাবে বিভিন্ন মহাকর্ষীয় সম্ভাবনায়) পরমাণু ঘড়িগুলি বিভিন্ন সময় প্রদর্শন করবে তা উল্লেখ করে প্রমাণিত হয়েছে। পরীক্ষাগুলিতে সনাক্ত হওয়া প্রভাবগুলি খুব কম, ন্যানোসেকেন্ডে পার্থক্যগুলি পরিমাপ করা হয়। কোটি কোটি বছর ধরে পৃথিবীর বয়সের সাথে সম্পর্কিত, পৃথিবীর মূলটি তার পৃষ্ঠের তুলনায় কার্যকরভাবে 2.5 বছর কম বৃহত্তর প্রভাবগুলি প্রদর্শনের জন্য পৃথিবী থেকে বৃহত্তর দূরত্ব বা বৃহত্তর মহাকর্ষীয় উৎসের প্রয়োজন হবে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স, পারমাণবিক ক্ষেত্রকে পরিচালিত করে গতি তত্ত্বের দিকে, একটি ঘড়িকে এমনভাবে চলতে দেয় যেন এটি একই সাথে দুটি ভিন্ন গতিতে ভ্রমণ করে: গতির একটি কোয়ান্টাম “সুপারপজিশন”। আর সুপার পজিশন হলো একই সময়ে কোয়ান্টা যখন একাধিক অবস্থায় থাকে। যেমনঃ আলো যখন কোয়ান্টা আকারে গুচ্ছ হিসেবে আসে তখন এটি দ্বৈত আচরণ দেখায়।
গবেষণায় এই সম্ভাবনাটিকে বিবেচনায় নিয়েছে এবং সময় রক্ষণ সম্পর্কে একটি সম্ভাব্য তত্ত্ব দেয়, যা কোয়ান্টাম সময় বিচ্ছিন্ন হওয়ার পূর্বাভাসের দিকে নিয়েছিল।
সময় সম্প্রসারণের নতুন তত্ত্বটি বিকাশের জন্য, কোয়ান্টাম ইনফরমেশন সায়েন্স থেকে আধুনিক কৌশলগুলি সংযুক্ত করে ১৯৮০-এর দশকে বিকশিত একটি তত্ত্বের সাথে সংযুক্ত করে যা ব্যাখ্যা করে যে কীভাবে মহাকর্ষের কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে সময় বের হতে পারে।
জৈবিক পদার্থের বয়স নির্ধারণের জন্য যেভাবে কার্বন ডেটিং ক্ষয়কারী পরমাণুর উপর নির্ভর করে, উত্তেজিত পরমাণুর আজীবন একটি ঘড়ি হিসাবে কাজ করে। যদি এইরকম একটি পরমাণু বিভিন্ন গতির একটি সুপারপজিশনে চলে যায়, তবে তার জীবন দশায় একটি নির্দিষ্ট গতিতে চলমান পরমাণুর সাথে সম্পর্কিত সুপারপজিশনের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে বৃদ্ধি বা হ্রাস পাবে।
পরমাণুর জীবন দশায় সংশোধন এতটাই ছোট যে, মানবিক স্তরে অর্থবোধ করে এমন পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তবে এই প্রভাবটির জন্য অ্যাকাউন্টিং করার ক্ষমতা সর্বাধিক উন্নত পারমাণবিক ঘড়ি ব্যবহার করে কোয়ান্টাম টাইম ডিলিয়েশনের একটি পরীক্ষা সক্ষম করতে পারে।
অতিবাহিত সময় এবং একযোগে পরিমাপের বিবেচনা একটি গুরুত্বপূর্ণ আপেক্ষিক প্রভাবের দিকে পরিচালিত করে।