স্বপ্ন! কত কিছুই তো হতে পারে, তাইনা?! হাতির বাচ্চা ডায়নোসর হওয়া থেকে শুরু করে নিজের বাচ্চাকাচ্চা হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু এক স্বপ্ন দেখতে দেখতে সেখান থেকে আরেক স্বপ্নে যাওয়ার মানে কী?!
ঘটনাটা এমন- এলার্ম ক্লকের আওয়াজে আপনার ঘুম ভাঙলো, আপনি এলার্ম অফ করে ফ্রেশ হয়ে কফি বানাচ্ছেন, কফি খেলেন, ব্রেকফাস্ট করলেন, শুক্রবার, তাই আপনার মনে হলো আরেকবার ঘুম দেওয়া যাক। এই ভেবে আপনি আবার ঘুমালেন, ঘুমে বাজে স্বপ্ন দেখে আপনার চোখ খুলে গেলো, আপনি উঠে বসলেন। এখন এই মুহুর্তে এসে দেখলেন, আপনি ব্রেকফাস্ট করেননি, আজ বৃহস্পতিবার, আপনি কফি খাননি, আপনি দাঁত ব্রাশ করে ফ্রেশ হননি। অর্থাৎ আপনি কেবল ঘুম থেকে উঠলেন, স্পেসিফিকালি বলতে গেলে একটা স্বপ্ন দেখে উঠে পড়লেন। কিন্তু আসলে একটা স্বপ্নই কি দেখেছেন?! আপনি তো ঘুম থেকে উঠে সব কাজ করে আবার ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন, তারপর আপনার স্বপ্নের ভিতর আরেকটা স্বপ্ন দেখছিলেন, তাহলে ওটা কি মিথ্যে ছিলো?!
A Dream Within A Dream- বিখ্যাত কবিতার ব্যাখ্যা না, আমাদের স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন দেখাকে বিজ্ঞানের ভাষায় কি বলে তা নিয়েই এই লেখা। এখন পর্যন্ত অনেক গবেষণা হয়েছে “স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন দেখা” নিয়ে। সেইগুলো নিয়ে বিস্তর আলোচনা- দ্বিমত রয়েছে। তবে কিছু জিনিসের সাথে গবেষকরা একমত পোষণ করেছেন।
এই সারসংক্ষেপে যেই বিষয়গুলোতে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে-
- False Awakening
- Anxiety dream within a dream
- Falling asleep in our consciousness
- Nested Loops
1. False Awakening:
যখন আপনি ঘুম থেকে উঠে নিত্যকর্ম করতে শুরু করেন, এবং স্বপ্নেই সেইসব করছেন, বাস্তবে না। এই False Awakening এর সময় অনেকেই বুঝতে পারে যে তারা স্বপ্ন দেখছে, তখন সেইটাকে লুসিডিটি-র আওতায় আনা হয়। আবার অনেকে বুঝতেই পারেন না যে আসলে তারা ঘুম থেকে জেগে কাজ করছেন না, বরং সব স্বপ্নে হচ্ছে। কিছু কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এই False Awakening একসাথে অনেকবার রিপিট করতে পারে।
সাধারণত আমাদের REM (rapid eye movement) এর কারণে False Awakening ঘটে। (rapid eye movement হলো সেই সময় যখন আমাদের মস্তিষ্ক স্বপ্ন দেখার জন্য প্রস্তুত হতে থাকে)। রাশিয়ায় একটি গবেষণা থেকে ধারণা করা হচ্ছে- False awakening এর সাথে REM phenomena র কিছু সম্পর্ক রয়েছে। REM phenomena র মধ্যে রয়েছে- বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস, লুসিড ড্রিমিং ইত্যাদি। স্লিপ প্যারালাইসিস এ ব্যক্তি মানসিকভাবে সম্পূর্ণ সজাগ থাকে, কিন্তু তারা হাত-পা এর পেশি নাড়াতে পারছে না, বা উঠতে পারছেনা সেই সময়টা। আর লুসিড ড্রিমিং এর ক্ষেত্রে ব্যক্তি পুরোপুরিভাবেই ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, কিন্তু তিনি জানেন যে তিনি স্বপ্ন দেখছেন এমনটা।
স্বপ্ন-এর মাঝে বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস নিয়ে আরো পড়ুন: বোবাই ভূত বা স্লিপ প্যারালাইসিস কী? এর থেকে মুক্তির উপায়
2. Anxiety dream within a dream:
অনেক সময় তাড়া, উদ্বিগ্নতা থেকে স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ, ঘুম থেকে উঠতে মিটিং এ দেরি হয়ে গেলো, বা ক্লাস মিস গেলো এইসব দেখতে থাকি। তাই তারা স্বপ্নে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে টেবিলে বসলেও বাস্তবে তো এর অস্তিত্ব নেই। অর্থাৎ ব্যক্তি তন্দ্রাচ্ছন্ন।
3. Falling asleep in our consciousness:
মাঝেমধ্যে অনেকে স্বপ্নে দেখি যে আমরা ঘুমিয়ে পড়ছি, বাস্তবে তা না। এই ধরনের স্বপ্ন আমাদের মনে থাকে, আমরা কিছু আধসচেতন ভাবে চলাফেরা করি দেখে অনেক সময় আমাদের ঘুমে এরকম স্বপ্ন দেখে থাকি। এটার সাথে সম্পর্কিত একটি রোগ আছে, যার নাম নারকোলেপ্সি। বেশিরভাগ রোগীই বুঝতে পারেন না যে তারা নারকোলেপ্সিতে আক্রান্ত। নারকোলেপ্সি রোগটি বিশ্বে অনেক বেশি ছড়িয়ে আছে। আমেরিকাতে প্রায় দুই লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। বিশ্বব্যাপী প্রায় ২০০০ জনে ১ জন মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়।
নারকোলেপ্সি নিয়ে বিস্তারিত জানতে পড়ুন: নারকোলেপ্সি: নিদ্রা যখন হয়ে উঠে দুঃস্বপ্ন
4. Nested loops:
এই টার্মটা হিপনোসিসদের ক্ষেত্রে বেশি ইউজ হয়। এইখানে হিপ্নোথেরাপিস্ট স্বপ্নে মেটাফোর এর মাধ্যমে একটার পর একটা কাহিনী বর্ণনা করতে থাকেন। যতগুলো এবং যে জায়গায় প্রব্লেম স্বপ্নে তাকে সেই জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরকমভাবে স্বপ্নে লুপ সংখ্যা বাড়তে থাকে যতক্ষণ না অব্দি তার সমাধান পাওয়া যায়। সমাধান পাওয়া মাত্রই শেষ লুপ থেকে ধীরে ধীরে আগের লুপগুলোর সমাধান বের করানো হয়। এই স্বপ্নে সাধারণত ক্লায়েন্টদেরকে এর সুন্দর সমাধান অব্দি নিয়ে আসা হয়। কিছুটা ইনসেপশন মুভির মতো মনে হলেও হতে পারে।
এখন কথা হলো, আমরা এই ধরনের স্বপ্ন কেন দেখি? একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
নিউরোসায়েন্স অনুযায়ী আমাদের ব্রেইনের তিনটি বেসিক অবস্থা রয়েছে:
- সম্পূর্ণ জাগ্রত অবস্থা
- REM (Rapid Eye Movement)
- NREM (non-Rapid Eye Movement)
আমাদের অধিকাংশ স্বপ্ন আমরা REM অবস্থাতে দেখি। এই তিনটি অবস্থার তৈরি করার পেছনে দায়ী ব্রেনস্টেম- উৎপন্ন নিউরোট্রান্সমিটার (অ্যামিনার্জিক এবং কোলিনার্জিক মড্যুলেশন) এক্টিভিটি এবং পাশাপাশি ফোরব্রেন অ্যাক্টিভেশন এবং ডিঅ্যাক্টিভেশন প্যাটার্নগুলির একটি সংমিশ্রণ। মস্তিষ্কের এই তিনটা অবস্থার কার্যক্রম কখনো আংশিক, কখনো সম্পূর্ণ। যখন আংশিক অবস্থার পরিবর্তন হয় তখন আমরা হাইব্রিড ব্রেইন স্টেট পাই। যেমন: REM + waking, বা NREM + waking বা REM + NREM. মস্তিষ্কের এই হাইব্রিড অবস্থার জন্য আমরা বিভিন্ন জিনিসের সম্মুখীন হই।
উদাহরণস্বরূপ, স্লিপ প্যারালাইসিস হয় আমাদের REM + waking এর হাইব্রিড অবস্থার কারণে। ধারণা করা হয়, স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন দেখাটা আমাদের REM + waking এর হাইব্রিড অবস্থায় হয়, এই সময় আমাদের dorsolateral prefrontal cortex আংশিকভাবে সক্রিয় হয়। REM এ থাকা অবস্থায় যখন এটি সক্রিয় হয়, তখন ব্যক্তি বুঝতে পারে যে সে স্বপ্ন দেখছে। False awakening এ ব্যক্তি এই জিনিস বুঝতে পারে না, আর সে স্বপ্নটাকে সত্যিই হিসেবে দেখতে থাকে।
এই ছিলো আমাদের স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্ন দেখার বিভিন্ন ধরন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে “স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন দেখা” কে False Awakening এর আওতায় ফেলেছেন গবেষকগণ। এছাড়া যেই কারণ/ ঘটনা থাকতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে তা হচ্ছে বাকি তিনটে। এর মধ্যে ফ্রয়েড এর একটি থিওরি বেশ কিছুকাল চলে এসেছিলো, কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
কখনো নিজের দৈনন্দিন জীবনের একটা সামঞ্জস্যতা ধরে রাখার জন্য, কিংবা কখনো উদ্বিগ্নতা/তাড়া থেকে, কখনো অবচেতন মনে, কখনো একটা সমাধান খোঁজ এর আশায় আমাদের মস্তিষ্ক স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্নের সৃষ্টি করে। সে যাই-ই হোক, স্বপ্নের ভিতর স্বপ্ন দেখাটা আদতে খারাপ না, এখন পর্যন্ত তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। তাই এই নিয়ে দুশ্চিন্তারও কোনো কারণ নেই। এখনো হাজারো গবেষণা চলছে, দেখা যাক, বিজ্ঞানীরা এরপর নতুন কি আবিষ্কার করতে পারেন।