পৃথিবীজুড়ে মানুষের আবাসস্থল যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, এক সময় গ্রামীণ কৃষি জমি বিলীন হয়ে যাবে, একথা বলাই বাহুল্য। কৃষি জমি হ্রাস পাওয়ার সাথ সাথে হ্রাস পাবে কৃষিজ ফলন। যেকারণে মানুষের কাছে অর্থ থাকলেও খাবার মতো শাকসবজি, ফলমূল এমনকি যেকারণে মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে সেই খাবার চাল ও থাকবে না।
আর এই সমস্যা মোকাবেলার জন্য বিজ্ঞানের এক অনন্য আবিষ্কার হাইড্রোপনিক পদ্ধতি। মাটি ছাড়াই কৃষিকাজ সম্ভব এমনটাই হবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতির সাহায্যে। এটি একটি অত্যাধুনিক ফসল চাষ পদ্ধতি। চলুন জেনে নেওয়া যাক কি এই নতুন উদ্ভাবন।
হাইড্রোপনিক কৃষি কি ?
ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় খনিজ পুষ্টি উপাদান পানিতে যোগ করে মাটি ছাড়াই সে পানিতে উদ্ভিদ জন্মানোর প্রক্রিয়াকে বলা হয় হাইড্রোপনিক কৃষি। গাছের জন্য সরবরাহকৃত পানিতে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান বিদ্যমান থাকলে মাটি ছাড়াও গাছ উৎপাদন করা যায়। হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনের জন্য এ ধারণাকে কাজে লাগিয়ে মাটির পরিবর্তে পানিতে ফসল উৎপাদন করা হয়ে থাকে। এ প্রক্রিয়ায় ফসলের সব খাদ্য উপাদান দ্রবণে মিশিয়ে সেখানে গাছ রোপণ করা হয়।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতি ব্যবহৃত পুষ্টিগুলি বিভিন্ন উত্স থেকে আসতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে মাছের উত্স, হাঁসের সার, ক্রয় করা রাসায়নিক সার বা কৃত্রিম পুষ্টির সমাধান। হাইড্রোপনিকভাবে উত্থিত উদ্ভিদের মধ্যে টমেটো, মরিচ, শসা, লেটুসের মতো মডেল গাছ রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান, তাইওয়ান, চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনেক আগে থেকেই বাণিজ্যিকভাবে হাইড্রোপনিক পদ্ধতির মাধ্যমে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। বাংলাদেশও এ পদ্ধতি ব্যবহারে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।
হাইড্রোপনিক কৃষির ইতিহাসঃ
মাটি ছাড়া স্থলজ উদ্ভিদ ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৬২৭ সালে ‘A Natural History’ বা ‘একটি প্রাকৃতিক ইতিহাস’ বই এ যা ফ্রান্সিস বেকন লিখেছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর পর এক বছর মুদ্রিত ছিল। ১৬৯৯ সালে জন উডওয়ার্ড ‘পানি সংস্কৃতি পরীক্ষা’ করেন পুদিনা চাষ করে। তিনি দেখেন যে স্বল্প পানির উত্সগুলিতে গাছপালা পাতিত পানিতে উদ্ভিদের চেয়ে চেয়ে ভাল বড় হয়েছি।
১৯৩০ এর চারদিকে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা কিছু নির্দিষ্ট গাছের রোগের তদন্ত করেছিলেন এবং এর মাধ্যমে বিদ্যমান মাটির অবস্থার সাথে সম্পর্কিত লক্ষণগুলি পর্যবেক্ষণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে নিয়ন্ত্রিত অবস্থার মধ্যে একই জাতীয় লক্ষণ সরবরাহের আশায় ‘জল সংস্কৃতি’ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছিল। প্রথমে এটিকে জলজ চাষ বলে অভিহিত করেছিলেন তবে পরে দেখতে পেয়েছিলেন যে জলজ জীব আগে থেকেই জলজ জীবের সংস্কৃতিতে প্রয়োগ হয়েছিল।
ডেনিস রবার্ট হোয়াগল্যান্ড এবং ড্যানিয়েল ইস্রায়েল আর্নন ১৯৩৮ সালে একটি ধ্রুপদী বুলেটিন লিখেছিলেন, জল ছাড়াই গাছের জন্মানোর জন্য জল সংস্কৃতি পদ্ধতি,যা হাইড্রোপনিক ফসলের দাবি করেছে। তবে এই গবেষণাটি হাইড্রোপনিক অন্যান্য কী কী উপকারিতা রয়েছে তা যথাযথভাবে প্রশংসা করতে পারেনি।
Have you Read These? |
হাইড্রোপনিক পদ্ধতির প্রথম সাফল্যগুলির একটি হলো (Wake Island)ওয়েক আইল্যান্ডে ১৯৩০ এর দশকে, যা প্রশান্ত মহাসাগরের একটি পাথুরে প্রবালপ্রাচীর ( Pan American Airlines) প্যান আমেরিকান এয়ারলাইনসের এক জ্বালানি ভরার স্টপ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। যাত্রীদের জন্য সবজি চাষ করা হতো হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে কারণ, সেখানে কোন মাটি ছিল না এবং তাজা শাকসবজি বিমানপথে বহন করা অনেক ব্যয়বহুল ছিল।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতির সুবিধাঃ
১। এ পদ্ধতিতে আবাদি জমির প্রয়োজন হয় না।
২। পদ্ধতিটি মাটিবিহীন চাষ পদ্ধতি হওয়ায় মাটিবাহিত রোগ ও কৃমিজনিত রোগ হয় না।
৩। কীটপতঙ্গের আক্রমন কম হওয়ার কারণে এই পদ্ধতিতে কীটনাশকমুক্ত সবজি উৎপাদন করা যায়।
৪। এই পদ্ধতিতে ছোট এবং বড় পরিসরে স্বাস্থ্য সম্মত এবং পরিচ্ছন্নভাবে ফসল উৎপাদন করা যায়।
৫। এটি হোম-ফারমিং এর জন্য একটি আদর্শ প্রযুক্তি বিধায় অধিক লাভজনক, অর্থকরী ও মানসম্পন্ন ফসল উৎপাদন করা সম্ভব।
১. ক্রমবর্ধমান চেম্বার (ট্রে)
২. জলাধার।
৩. নিমজ্জিত পাম্প:
৪. ডেলিভারি টিউব:
৫.Aerators বা বায়ু পাম্প:
৬. গ্রো লাইট বা এল.ই.ডি. লাইট
সাধারনত ২টি উপায়ে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায় :
১.সঞ্চালন পদ্ধতি (Circulating System)
২.সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি (Non-Circulating System)
সঞ্চালন পদ্ধতিঃ
এ পদ্ধতিতে গাছের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদানসমূহ যথাযথ মাত্রায় মিশ্রিত করে একটি ট্যাংকিতে নেয়া হয় এবং পাম্পের পাইপ এর মাধ্যমে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ (Nutrient Solution) সঞ্চালন করে ফসল উৎপাদন করা হয়। প্রতিদিন অন্ততঃপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা পাম্পের সাহায্যে এই সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু রাখা দরকার।
এই পদ্ধতিতে প্রাথমিকভাবে প্রথম বছর ট্রে, পাম্প এবং পাইপের আনুসাঙ্গিক খরচ একটু বেশী হলেও পরবর্তী বছর থেকে শুধুমাত্র রাসায়নিক খাদ্য উপাদানের খরচ প্রয়োজন। ফলে ২য় বছর থেকে খরচ অনেকাংশে কমে যাবে।
Have You Read These? |
সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিঃ
এই পদ্ধতিতে একটি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানসমূহ পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল চাষ করা হয়। এই পদ্ধতিতে খাদ্য উপাদান সরবরাহের জন্য কোন পাম্প বা পানি সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে খাদ্য উপাদান মিশ্রিত দ্রবণ ও তার উপর অবস্থিত কর্কশীটের উপরে মাঝে ২-৩ ইঞ্চি পরিমান জায়গা ফাকা রাখতে হবে এবং কর্কশীটের উপরে ৪-৫ টি ছোট ছোট ছিদ্র রাখতে হবে যাতে সহজেই বাতাস চলাচল করতে পারে এবং গাছ তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন কর্কশীটের ফাঁকা জায়গা থেকে সংগ্রহ করতে পারে।
ফসলের প্রকারভেদে সাধারণতঃ ২-৩ বার এই খাদ্য উপাদান ট্রেতে যোগ করতে হয়। আমাদের দেশে সহজেই সাধারন মানুষ এই পদ্ধতি অনুসরণ করে প্লাস্টিক বালতি, পানির বোতল, মাটির পাতিল, ইত্যাদি ব্যবহার করে বাড়ির ছাদ, বারান্দা, এবং খোলা জায়গায় সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন করতে পারে। এতে খরচ অনেক কম হবে।
ধাপ ১: হাইড্রোপনিক সিস্টেম জমায়েত করুন।
ধাপ ২: ট্যাঙ্কে পুষ্টিকর এবং জল মিশ্রিত করুন।
ধাপ ৩: ক্রমবর্ধমান টিউবগুলিতে উদ্ভিদ যুক্ত করুন।
ধাপ ৪: গাছপালা ট্রেলিসের সাথে বেঁধে রাখুন।
ধাপ ৫: প্রতিদিন পাম্পটি চালু করুন এবং সিস্টেমটি পর্যবেক্ষণ করুন।
ধাপ ৬: উদ্ভিদ বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ।
ধাপ ৭: কীটপতঙ্গ ও রোগের জন্য পরীক্ষা করুন।
বাংলাদেশের হাইড্রোপনিক ফসলঃ
প্রচলিত কৃষিতে পানি দশমাংশ কম ব্যবহার করে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে বাংলাদেশে জন্মানো যাবে পাতা জাতীয় সবজির মধ্যে লেটুস, গিমা কলমি, বিলাতি ধনিয়া, বাঁধাকপি এসব। ফল জাতীয় সবজির মধ্যে টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, শসা, ক্যাপসিকাম, মেলন ও স্কোয়াস উল্লেখযোগ্য। ফলের মধ্যে আছে স্ট্রবেরি এবং ফুলের মধ্যে উৎপাদন করা যাবে গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড ও চন্দ্রমল্লিকা। ভবিষ্যতে যোগ হতে পারে তালিকায় আরও অনেক নতুন ফসলের নাম।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এ পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে ট্রে, প্লাস্টিক বালতি, পানির বোতল ও মাটির পাতিল ব্যবহার করে বাড়ির ছাদ, বারান্দা এবং খোলা জায়গায় সবজি উৎপাদন করতে পারবে। গ্রিন হাউস, প্লাস্টিক হাউস, ফিনাইল হাউসে এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়।
অ্যাগ্রো সার্কিট ফার্মের বিশেষভাবে ডিজাইন করা ২ হাজার বর্গফুট গ্রিনহাউসে সবুজ শাকসব্জী যেমন পালং শাক, টমেটো এবং লেটুস এক ফুট বিছানায় বৃদ্ধি পায় এবং কোনও মাটি নেই। কীটনাশক বা কীটনাশক স্প্রে করা বা এমনকি সার ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। উদ্ভিদের বৃদ্ধির জন্য পুষ্টি, গ্রিনহাউসের অভ্যন্তরে পৃথক জলের ট্যাঙ্কে চাষ করা 8,000 মিঠা পানির মাছ — তেলাপিয়া এবং কার্প থেকে আসে ।
হাইড্রোপনিক পদ্ধতির চ্যালেঞ্জঃ
নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ফসল ফলনের ক্ষেত্রে সনাতন কৃষির তুলনায় হাইড্রোকালচার চাষে প্রায় ১০ গুণ বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব। ফসলে সনাতন কৃষির চক্রের তুলনায়োয় ১৩ গুণ কম পানি ব্যবহার করা হয়। ঐতিহ্যবাহী কৃষিকাজের চেয়ে প্রতি কেজিতে গড়ে ১০০ গুণ বেশি লাভ হয়। হাইড্রোপনিক ফার্মিং কেবল চারা উৎপাদনের সময় ছাড়া কোনো উৎপাদন মিডিয়া ব্যবহার করার দরকার হয় না। এ পদ্ধতিতে পাত্রে পাথর নুড়ি বা স্পঞ্জ দিয়ে পূর্ণ করে তাতে শুধু চারা উৎপাদন করা হয়। পরবর্তিতে নিউট্রিয়েন্ট দ্রবণে এ চারা রোপণ করে ফসল চাষ করা সম্ভব হবে। মাধ্যম হিসেবে অজৈব ও জৈব উভয় প্রকার মাধ্যমই ব্যবহার করা যাবে।
বালি কণা, গ্রাভেল, বা কৃত্রিম কাদা অজৈব মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হয়। এক্ষেত্রে তিন মিলিমিটার ব্যাসার্ধের চেয়ে কম আকারের বালি কণা ব্যবহৃত হয়। কৃত্রিম কাদাতে সাধারণত শোভাবর্ধনকারী গাছ লাগানো হয়। জৈব উপাদানের মধ্যে কাঠের গুড়া এবং ধানের তুষ বা তার ছাই ব্যবহার করা হয়। এতেও ড্রিপিং পদ্ধতিতে নিউট্রিয়েন্ট সরবরাহ করতে হবে।
এ পদ্ধতিতে সার্বক্ষণিক অথবা সময় সময় ফসলের মূলে নিউট্রিয়েন্ট স্প্রে করা লাগে। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে জেনে শুনেই আগ্রহী কৃষকদের কাজ শুরু করতে হবে। প্রযুক্তিকে সামর্থের সাথে মিলিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আগ্রহীদের সহায়তার জন্য সরকারি পর্যায়েও প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা দেয়ার ব্যবস্থা গড়ে উঠতে হবে।