আমাদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল অ্যান্টিবায়োটিক। অ্যান্টিবায়োটিক হলো এমন একটি উপাদান যা ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস থেকে সংগ্রহ করে তা অন্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস কে ধ্বংস বা তার বংশবৃদ্ধি রোধ করার জন্য ব্যবহার করা হয়।
১৮ শতকের দিকে ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গাস জনিত কারণে অনেক মহামারীর সৃষ্টি হয়েছিল, মারা গেছে লাখ লাখ মানুষ। স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং ভুল করে আবিষ্কার করে ফেলেন এক মহা ঔষধ , তিনি মূলত পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন যা এক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক। তার এই ভুল করে করা আবিষ্কারই রক্ষা করে পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষের জীবন। সূচনা হয় চিকিৎসা বিজ্ঞান ও ওষুধ বিজ্ঞানের এক নতুন অধ্যায়।
পেনিসিলিন আবিষ্কারের ঘটনা আমরা কমবেশি সবাই জানি তাই সেটা নিয়ে কথা না বাড়িয়ে চলে যাই আমাদের আজকের মূল আলোচনাতে।
★এখন প্রশ্ন হলো, কেনো এই আশীর্বাদই বর্তমানে আমাদের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে?
এজন্য আগে এন্টিবায়োটিক কি এবং এর প্রকারভেদ কি তা নিয়ে একটু বলি-
অ্যান্টিবায়োটিক মূলত আমরা শরীরের বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া এবং ফাঙ্গাসের আক্রমণকে প্রতিহত করতে গ্রহণ করে থাকি।
রাসায়নিক গঠনের উপর ভিত্তি করে আন্টিবায়োটিককে নানা ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভাগ গুলো হলোঃ
- বিটা-ল্যাক্টাম জাতীয় (beta-lactum)
- পেনিসিলিন জাতীয়
- সেফালোস্পোরিন জাতীয়
- প্রথম প্রজন্মের সেফালোস্পোরিন
- দ্বিতীয় প্রজন্মের সেফালোস্পোরিন
- তৃতীয় প্রজন্মের সেফালোস্পোরিন
- চতুর্থ প্রজন্মের সেফালোস্পোরিন
- পঞ্চম প্রজন্মের সেফালোস্পোরিন
- কার্বাপেনেম জাতীয়
- ইমিপেনেম
- মেরোপেনেম, ইত্যাদি
- মোনোব্যাক্টাম জাতীয়
- অ্যাজট্রিওনাম
- সালফোনামইড জাতীয়
- ক্লোরাম্ফেনিকল জাতীয়
- ক্লোরাম্ফেনিকল,
- থিয়াম্ফেনিকল,
- আজিডাম্ফেনিকল, ইত্যাদি
- কুইনোলোন জাতীয়
- ন্যালিডিক্সিক অ্যাসিড
- ফ্লুরোকুইনোলোন জাতীয়
- নরফ্লক্সাসিন
- সিপ্রোফ্লক্সাসিন ইত্যাদি
- ম্যাক্রোলাইড জাতীয় (Macrolides),
- এরিথ্রোমাইসিন,
- অ্যাজিথ্রোমাইসিন,
- স্পাইরামাইসিন
- ক্লারিথ্রোমাইসিন, ইত্যাদি
- অ্যামিনোগ্লাইকোসাইড জাতীয় (Aminoglycosides),
- স্ট্রেপ্টোমাইসিন,
- জেন্টামাইসিন,
- সিসোমাইসিন,
- টোব্রামাইসিন, ইত্যাদি
- টেট্রাসাইক্লিন জাতীয় (Tetracyclin)
- টেট্রাসাইক্লিন,
- ডক্সিসাইক্লিন,
- মিনোসাইক্লিন, ইত্যাদি
- পলিপেপটাইড জাতীয়(Polypeptide)
- পলিমিক্সিন বি, পলিমিক্সিন ই,
- ব্যাসিট্রাসিন,
- ক্যাপ্রিয়োমাইসিন,
- ভ্যাঙ্কোমাইসিন, ইত্যাদি
- পলিয়িন জাতীয়
- অ্যাম্ফোটেরিসিন বি,
- নাইস্টাটিন ইত্যাদি
- ইমাইডাজোল
- ফ্লুকোনাজোল,
- ইট্রাকোনাজোল, ইত্যাদি
- বেঞ্জোফুরান জাতীয়
- গ্রিসোফুল্ভিন ইত্যাদি
- আন্সামাইসিন জাতীয়
- রিফামাইসিন ইত্যাদি
- লিনোসামাইড জাতীয়
- ক্লিন্ডামাইসিন,
- লিঙ্কোমাইসিন, ইত্যাদি
★ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কি এবং কেনো হয়?
আমাদের শরীরে ব্যাকটেরিয়া জনিত কারণে অনেক রোগ হয়ে থাকে।
এই ঔষুধগুলো ব্যাকটেরিয়াকে নিষ্ক্রিয় করে বা ভেঙে ফেলে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে দীর্ঘদিন একই ধরনের ঔষুধের যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে ব্যাকটেরিয়াগুলো ঔষধের গঠনগত দিক চিনে ফেলে বিধায় নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদে ব্যাকটেরিয়াগুলো নিজেদের মধ্যে জেনেটিক মিউটেশন করে ফেলে ও গঠনগত এবং তাদের কাজের ধরণ পরিবর্তন করে সেই ঔষধকে অকার্যকর করে ফেলে।
আরেকটি ব্যাপার হলো, ব্যাকটেরিয়া গুলো তাদের মেমোরিতে ঔষধের ধরন এবং কাজগুলোকে সেভ করে রাখে যার ফলে তাদের পরবর্তী জেনারেশন কেও তারা এর বিরুদ্ধে কাজ করতে শিখিয়ে দিয়ে যায়। কোনো ব্যাকটেরিয়া এভাবে কোনো নির্দিষ্ট এন্টিবায়োটিক এর বিরুদ্ধে্ জেনেটিক মিউটেশন ঘটিয়ে নিজের রূপ পরিবর্তন করে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করলে আমরা সেই ব্যাকটেরিয়া কলোনি কে ঐ এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বলে থাকি।
চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা যখন নতুন নতুন কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবনে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, তখন ভোক্তা ও চিকিৎসকদের অযৌক্তিক ও অবিবেচনাপ্রসূত আচরণের কারণে মানবসভ্যতা এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে পড়ল। যে অ্যান্টিবায়োটিককে মনে করা হতো রোগ চিকিৎসার অন্যতম হাতিয়ার , যা যেকোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে অব্যর্থ- সেই অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার এমন এক মাত্রায় পৌঁছে গেল যে জীবাণুগুলো হয়ে উঠল অপ্রতিরোধ্য, অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতার প্রতি উল্টো চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল তারা।
অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ও অপব্যবহারের ফলে জীবাণুগুলো নিজেদের কাঠামো পরিবর্তন করে ফেলছে নিজে নিজেই।
বর্তমানে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স একটি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে আমাদের সামনে দাঁড়িয়েছে। এখন আর অ্যান্টিবায়োটিক আমাদের শরীরে কাজ করছে না ফলে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন মারাত্মক ইনফেকশনজনিত রোগে, কিন্তু তা থেকে মুক্তির উপায় পাচ্ছে না। আমি নিজে একজন ফার্মাসি বিষয়ের ছাত্রী হওয়ায় এই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স নিয়ে কিছু কাজ করার সুযোগ হয়েছিলো। একটি অ্যানালাইসিসে প্রায় ১০০০ প্রেসক্রিপশন অ্যানালাইসিস করে এর মধ্যে ৮৭০ টির মধ্যে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। তাহলে আপনারাই একবার ভাবুুুন আমরা কোন বিপর্যয়ের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছি।
★ এর জন্য দায়ী কারা?
১.আমার মতে, এর জন্য প্রথমতো দায়ী হলো অসচেতন এবং হাতুড়ে চিকিৎসক।
কারণ তারা অযৌক্তিকভাবে ইচ্ছেমতো প্রেসক্রিপশনে গাদাগাদা অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেয়।
এর পেছনে ২টি
কারণ থাকে। তাদের ব্যাবসায়িক মনোভাব এবং দ্বিতীয়ত
রোগীদের মনস্তাত্ত্বিক ধারণা। তারা মনে করে প্রেসক্রিপশন যতো বড় হবে তাদের সুুুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ততো দ্রুত বৃদ্ধি পাবে।
২. দ্বিতীয়তো, আমরা জনসাধারণ।
আমরাতো মুড়ির মতো অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছি প্রতিনিয়ত। একটু সাধারণ জ্বর কাশি হলেই আমরা সাথে সাথেই পাশের ফার্মেসি দোকান থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো প্রেসক্রিপশন ছাড়াই কিনে খাচ্ছি। নিয়ম-নীতি, নিষেধের কোনো তোয়াক্কাই করছি না আমরা। সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে দ্রুত আরোগ্য লাভের জন্য আমরা একাধিক অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছি। শুধু যে আমরা ডাক্তারের ওপর ডাক্তারি ফলিয়ে ওষুধ খাচ্ছি তা নয় বরং অন্য কেও উদ্ভুদ্ধ করছি প্রেসক্রিপশন ছাড়া এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে। এখন এমন কেউ নেই যে এন্টিবায়োটিক এর নাম জানেনা।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!! গল্পে গল্পে মমি নিয়ে কিছু অদ্ভুত আবিষ্কার (১ম পর্ব) উদ্ভিদের হরমোন সিস্টেম : পরিবেশের সাথে মিথস্ক্রিয়ায়? নাকি উদ্ভিদের ফলন বৃদ্ধিতে? |
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো শুধু যে আমরা মানুষ নিজেরা এন্টিবায়োটিক নিজের ইচ্ছামত খাচ্ছি তাই নয়
গৃৃৃৃহপালিত পশুপাখিদের মোটাতাজাকরনেও ব্যাবহার করছি অ্যান্টিবায়োটিক। যার পরবর্তী প্রভাব কিন্তু ঘুরে ফিরে আবার আমাদের দিকেই আসছে। আমরা সেই গৃহপালিত পশুপাখির মাংস খাচ্ছি যার ফলে সেই এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স কিন্তু আমাদের দেহে তৈরি হচ্ছে। মানে আমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করছে প্রতিনিয়ত।
এই প্রবণতা কে থামাতে গেলে কিছু গঠনমূলক ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে যেমন –
- কঠোর আইনের মাধ্যমে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ দেওয়া কে বন্ধ করতে হবে।
- সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনতা সপ্তাহের মত নিজ নিজ দেশেও এইরকম সচেতনতা অভিযান চালানো।
- চিকিৎসা ক্ষেত্রে সঠিক নিয়মানুবর্তিতা পালন হচ্ছে কিনা তা গুরুত্ব সহকারে পর্যবেক্ষণ চালাতে হবে।
- নিজের এবং নিজের চারপাশের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে।
- মাঝপথে ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিয়ে নিজে ডাক্তারি না ফলিয়ে, বরং প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ডাক্তারের পরার্মশ অনুযায়ী কোর্স কমপ্লিট না হওয়া অবদি ঔষুধ খেয়ে যান।
- কৃষিক্ষেত্র এবং গৃহপালিত পশুপাখির উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে অনাবশ্যক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন।
- ওষুধের ব্যবহার হয়ে গেলে যত্রতত্র তার খাপ বা মোড়ক ফেলে দেওয়ার থেকে নিজেদের বিরত রাখা।
এখন আধুনিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে খুব সহজেই জানতে পারা যায় কেউ অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট কিনা।
সুতরাং, এরপর থেকে কখনো ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া দয়া করে ওষুধ কিনে এবং তা খেয়ে নিজেকে ও নিজের চারপাশের বৃহত্তর সমাজকে এই বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ার থেকে বিরত থাকুন।