আমরা যারা ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে কাজ করি অথবা যাদের ইলেক্ট্রনিক্স নিয়ে আগ্রহ রয়েছে তারা সকলেই একবার হলেও রেজিস্টর বা রোধের কথা শুনে থাকব। আবার অনেকে হয়ত ছোটকালে ব্যাটারি দিয়ে লাইট জ্বালানোর সময় রোধ ব্যাবহার করেছি।
আমরা সকলেই জানি রোধের কাজ হল তড়িৎ প্রবাহকে বাধা দেয়া। কিন্তু কেন এটি তড়িৎ প্রবাহকে বাধা দেয়, কিভাবে বাধা দেয়, কিভাবেই বা এটি ব্যবহার করা হয়– এই প্রশ্নগুল আমাদের মনে সবসময়ই ঘুরতে থাকে। তাই আর দেড়ি না করে পরে ফেলুন সকল প্রশ্নের উত্তর নিয়ে লেখা এই ব্লগটি।
ব্লগটি ২ টি পার্ট এ থাকবে, ১ম পার্ট এ রেজিস্টর নিয়ে A to Z আলোচনা করা হবে। আর ২য় পার্ট এ রেজিস্টর এর মান নির্ণয় { কালার কোড } ও রেজিস্টর এর সমবায় { অর্থাৎ যেসকল ভাবে বর্তনীতে রেজিস্টর যুক্ত করা হয়। } নিয়ে আলোচনা করা হবে।
রেজিস্টর কি?
রোধক বা রেজিস্টর(Resistor) তড়িৎ বর্তনীতে (Electric Circuit) ব্যবহৃত, দুই প্রান্ত বিশিষ্ট একপ্রকার যন্ত্রাংশ । এর কাজ হল তড়িৎ প্রবাহকে (Electric Current) রোধ করা বা বাধা দেয়া। তড়িৎ বর্তনীতে থাকা অবস্থায় রোধক তার দুই প্রান্তের মধ্যে বিভব পার্থক্য (Potential Difference) সৃষ্টি করার মাধ্যমে তড়িৎ প্রবাহকে বাধা দেয় ।
মনে প্রশ্ন আসতে পারে হঠাৎই বা কোন পদার্থ তড়িৎ প্রবাহকে বাধা দিতে যাবে কেন?
এটা হয় পদার্থের রোধকত্ব বৈশিষ্ট্যের জন্য। এখন বলবেন এটা আবার কি? আচ্ছা বলছি,
এগুলো পড়েছেন ? |
রোধকত্ব কি?
রোধকত্ব (Resistivity) বস্তুর একটি বৈশিষ্ট্য। কোন বস্তু তার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আধানের (Electric Charge) প্রবাহকে কী পরিমাণ বাধা দিবে তা তার রোধকত্বের উপর নির্ভর করে। একক দৈর্ঘ্যের, একক (সুষম) প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট কোন বস্তুর রোধই ওই বস্তুর রোধকত্ব। যে পদার্থের রোধকত্ব যত বেশি সে পদার্থ তড়িৎ আধানের প্রবাহকে তত বেশি বাধা দেয়। সাধারণত ধাতব পদার্থের রোধকত্ব কম হয়।
বস্তুর রোধকত্ব তার তাপমাত্রার উপরও নির্ভরশীল। সাধারনত গ্রীক অক্ষর ρ (উচ্চারনঃ রো) দ্বারা রোধকত্বকে প্রকাশ করা হয়। রোধকত্বের আন্তর্জাতিক একক ওহম-মিটার (Ohm-meter), সংক্ষেপে প্রকাশ করা হয় Ω⋅m ।
সত্যি কথা বলতে সকল পদার্থেরই রোধকত্ব ধর্মটি রয়েছে। কারো এত বেশি যে তা দিয়ে রেজিস্টর বানানো যায় {যেমন- কার্বন এর কম্পোজিশন দিয়ে রোধ বানানো হয়।} , আবার কারো এত কম যে রোধ থাকা আর না থাকা সমান { যেমন- সুপরিবাহী তার }।
তাহলে বুঝতেই পারছেন রেজিস্টর সেইসকল পদার্থ দিয়েই তৈরি করা হয় যেগুলোর রোধকত্ব বেশি।
অর্থাৎ একটি রেজিস্টর তড়িৎ প্রবাহকে কী পরিমাণ বাধা দিবে তা নির্ভর করে তার রোধের (Resistance) উপর। L মিটার দৈর্ঘ্যের A বর্গমিটার সুষম প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট কোন পরিবাহীর রোধ নিম্নোক্ত সূত্র দিয়ে নির্ণয় করা যায়:
R*A = ρ*L
যেখানে,
ρ = তারটি যে পদার্থের তৈরি সেটির রোধকত্ব।
R = বস্তুটির রোধের মান।
আচ্ছা সবই ঠিক আছে। এখন ধরুন একটি রেজিস্টর একটি বর্তনীতে ব্যবহার করা হয়েছে। আপনি বর্তনীর বিভব পার্থক্য এবং তড়িৎ প্রবাহ জানেন। এখন কিভবে বুঝবেন, এখানে কত মানের রেজিস্টর ব্যবহার করা হয়েছে?
চিন্তার কোন কারণ নেই, আমাদের জন্য গেয়র্গ সিমোন ও’ম সাহেব খুবি সুন্দর একটি সুত্র আবিষ্কার করে রেখে গিয়েছেন।
ও’মের সূত্র:
তড়িৎ বর্তনীতে অবস্থিত কোন পরিবাহীর রোধ, এর মধ্যদিয়ে প্রবাহিত তড়িৎ প্রবাহের পরিমাণ এবং এর দুই প্রান্তের মধ্যে বিভব পার্থক্য নিম্নোক্ত ও’মের সূত্র দ্বারা বর্ণনা করা যায়:
V = IR
যেখানে,
V = বিভব পার্থক্য (Volt),
I = তড়িৎ প্রবাহের পরিমাণ (Ampere) এবং
R = রোধ (Ohm )
এখানে যেকোনো ২টির মান জানা থাকলে আরেকটা মান খুব সহজেই জানা যাবে।
রেজিস্টারের পাওয়ার রেটিংঃ
পাওয়ার রেটিং বলতে কোনো রেজিস্টর কি পরিমাণ তাপ সহ্য করতে পারে তা বুঝায় । অর্থাৎ এটির মধ্য দিয়ে সর্বোচ্চ কত পরিমাণ কারেন্ট প্রবাহিত হতে পারবে । এটিকে ওয়াটে (watt) প্রকাশ করা হয় । যে সমস্ত জায়গায় বেশি বিদ্যুৎ খরচ হয় সে সব ক্ষেত্রে বেশি ওয়াটের রেজিস্টর ব্যবহার করা হয় । কারণ, এক্ষেত্রে কম ওয়াটের রেজিস্টর ব্যবহার করলে রেজিস্টরটি তাড়াতাড়ি গরম হয় এবং জ্বলে নষ্ট হয়ে যায় । রেজিস্টরের ওয়াটেজ যত বেশি হয় রেজিস্টরটি তত বেশি বড় অর্থাৎ লম্বা এবং মোটা হয় । সার্কিটে নষ্ট রেজিস্টর পরিবর্তনের সময় অবশ্যই সম ওয়াট বা তারও বেশি ওয়াটের রেজিস্টর ব্যবহার করতে হয় ।
এখানে,
P = (Imax)2×R ওয়াট
যেখানে,
P = রেজিস্টরের ওয়াট
Imax = সর্বোচ্চ নিরাপদ কারেন্ট (A)
R = রেজিস্টরের রেজিস্ট্যান্স (Ohm)
রোধের কিছু বৈদ্যুতিক বৈশিষ্ট্যঃ
১। রেজিস্টর একটি দুই টার্মিনাল বিশিষ্ট ডিভাইস
২। এটি নন-পোলার ডিভাইস
৩। এটি লিনিয়ার ডিভাইস
৪। এটি প্যাসিভ ডিভাইস
এগুলো পড়েছেন ? |
সাধারণতঃ রেজিস্টরের রেজিস্ট্যান্স দুই টার্মিনালের মধ্যে ক্রিয়া করে এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে এর দুটি টার্মিনাল থাকে বলে একে দুই টার্মিনাল ডিভাইস বলে। তবে কিছু পরিবর্তনশীল মানের রেজিস্টর আছে যাদের তিনটি টার্মিনাল রয়েছে, যেমন পটেনশিওমিটার এবং রিহোস্ট্যাট। কোন সার্কিটের দুটি অংশের মাঝে পরিবর্তনশীল মানের রেজিস্ট্যান্স প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিংবা ভোল্টেজ ডিভাইডার হিসাবে এগুলি ব্যবহার হয়। এগুলির কার্যকরী উপাদান রেজিস্টর হলেও এগুলিকে সরাসরি রেজিস্টর নামে অভিহিত করা হয় না বরং বলা হয় পটেনশিওমিটার এবং রিহোস্ট্যাট।
নন-পোলার বলতে বুঝায়, যার কোন পোলারিটি বা ধণাত্বক-ঋণাত্বক প্রান্ত নেই। অনুরূপ রেজিস্টরের কোন পোলারিটি নেই। একে যে কোন ভাবে সার্কিটে সংযুক্ত করা যায় অর্থাৎ রেজিস্টরকে সার্কিটে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে পোলারিটি বিবেচনা করার প্রয়োজন হয় না।
লিনিয়ার ডিভাইস বলতে এমন ডিভাইস বুঝায়, যার আড়াআড়িতে প্রযুক্ত ভোল্টেজ এবং উক্ত ভোল্টেজ সাপেক্ষে প্রবাহিত কারেন্টের মধ্যে সম্পর্ক সর্বদা সরল রৈখিক হয়।
প্রকারভেদঃ
বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে রেজিস্টরের শ্রেনীবিভাগ করা যায়। তা নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
রেজিস্ট্যান্সের ধরনের উপর ভিত্তি করে রেজিস্টর দুই ধরনের হয়ে থাকেঃ
১। স্থির মানের রেজিস্টর
২। পরিবর্তনশীল মানের রেজিস্টর (পটেনশিওমিটার এবং রিহোস্ট্যাট)
রেজিস্টিভ উপাদানের (যে উপাদানে রেজিস্টর তৈরী হয়) উপর ভিত্তি করে নিম্নলিখিত প্রকারের হয়ে থাকেঃ
১। কার্বন কম্পোজিশন রেজিস্টর (সর্বদা স্থির মানের হয়)
২। ওয়্যার উন্ড রেজিস্টর (স্থির ও পরিবর্তনশীল উভয় মানের হয়)
৩। ফিল্ম-টাইপ রেজিস্টর (স্থির ও পরিবর্তনশীল উভয় মানের হয়)
৪। সারফেস মাউন্ট রেজিস্টর (সর্বদা স্থির মানের হয়)
৫। ফিউজ্যাবল রেজিস্টর (সর্বদা স্থির মানের হয়)
৬। আলোক সংবেদনশীল রেজিস্টর (সর্বদা পরিবর্তনশীল মানের হয়)
৭। তাপ সংবেদনশীল রেজিস্টর (সর্বদা পরিবর্তনশীল মানের হয়)
আশা করি এতক্ষণে রেজিস্টর নিয়ে ভালো ১ টি ধারণা এসে গিয়েছে। আরো বিশদ জানতে ২য় পার্ট পরে ফেলুন। ২য় পার্ট এ রেজিস্টর এর মান নির্ণয় { কালার কোড } ও রেজিস্টর এর সমবায় { অর্থাৎ যেসকল ভাবে বর্তনীতে রেজিস্টর যুক্ত করা হয়। } নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
২য় পর্ব যদি না পরে থাকেন অতি শীঘ্রয়ই পরে ফেলুন – ইলেক্ট্রনিক্সে রেজিস্টরের গল্পসল্প পর্ব ২