আমরা তো প্রায় সবাই জানি, নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশিদিন বাঁচে। কিন্তু একই বয়সে পুরুষদের তুলনায় নারীদের বয়সে বেশি দেখায় কেন?
প্রফেসর মবিন, বাড়ির বারান্দায় চেয়ারে বসে আছেন। খবরের কাগজ উল্টাতে উল্টাতে বলছেন-
:: লিসা, এক কাপ চা দিও তো।
মিসেস লিসা: সকাল থেকে এই পর্যন্ত ২ কাপ চা খেলে, আরও চাও?
প্রফেসর মবিন: আহ্ লিসা, তুমি তো জানোই, আমার চা খেতে ভালো লাগে, আরেক কাপ চা খেলে কিই বা হবে এমন?
মিসেস লিসা: তোমার চা ভালো লাগে, তাই বলে তো অতিরিক্ত খেলে চলবে না। অতিরিক্ত চা খাওয়ার ফলে হাড়ের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্যসহ, কিডনীরও রোগ হতে পারে।
প্রফেসর মবিন: আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। চা কমিয়ে খাবো। এখন এক কাপ দাও, প্লিজ।
মিসেস লিসা: আচ্ছা দিচ্ছি, কিন্তু মাথায় রেখো আজকে আর পাবে না।
প্রফেসর মবিন: ঠিক আছে, মাথায় রাখলাম।
হঠাৎ ই প্রফেসর মবিন এর নাতি নবিন দৌড়াতে দৌড়াতে আসলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো-
:: দাদু, আগামীকাল আমার এসাইনমেন্ট আছে, কিন্তু আমি তো…
প্রফেসর মবিন: আচ্ছা দাদুভাই থামো, এত হাঁপাচ্ছো কেন? শান্ত হয়ে বলো। কী এসাইনমেন্ট?
নবিন: (শান্ত হয়ে) আসলে দাদু, আগামীকাল আমাকে স্কুলে একটা এসাইনমেন্ট সাবমিট করতে হবে। বিষয় হলো: “একই বয়সে পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের বয়সে বেশি দেখায় কেন?”
প্রফেসর মবিন: তাতে সমস্যা কী? রেডি করো।
প্রফেসর মবিন: আচ্ছা কীভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি বলো।
নবিন: তুমি আমাকে এসাইনমেন্টের মূল বিষয়গুলো বলো, আমি খাতায় লিখে নিই, তাহলে আমি সহজেই এসাইনমেন্ট রেডি করতে পারবো।
প্রফেসর মবিন: আচ্ছা চেষ্টা করতেছি। তোমার প্রশ্নটা কী ছিলো যেন?
নবিন: প্রশ্নটি হলো- একই বয়সে পুরুষদের তুলনায় নারীদের বয়সে বেশি দেখায় কেন?
প্রফেসর মবিন: আচ্ছা আমরা তো প্রায় সবাই জানি, নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশিদিন বাঁচে। তুমি জানো?
নবিন: না তো দাদু, আজ প্রথম শুনলাম।
প্রফেসর মবিন: আচ্ছা এটা নিয়ে আরেকদিন বলবো, আপাতত জেনে রাখো, নারীরা পুরুষদের তুলনায় বেশিদিন বাঁচে। অর্থাৎ, স্বাভাবিকভাবে ধরতে গেলে তোমার দাদী আমার থেকে বেশিদিন বাঁচবে। তবে একজন পুরুষের আর একজন নারীর বয়স যদি প্রায় একই হয়, তবে খেয়াল করলে দেখা যাবে পুরুষটির তুলনায় নারীটির চেহারায় বয়সের ছোপ বেশি পড়ে।
নবিন: তবে এটি কী আদৌও আশ্চর্যের বিষয়?
প্রফেসর মবিন: না, এটার কারণগুলো জানতে পারলে সেটা স্বাভাবিক-ই মনে হবে। কেননা গর্ভাবস্থা থেকে মেনোপজ পর্যন্ত প্রচুর কারণ রয়েছে যার কারণে নারীদের বয়সে বেশি দেখায়।
নবিন: যেমন?
প্রফেসর মবিন: একটা গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো- নারীরা পুরুষদের চেয়ে বেশি মানসিক চাপে ভোগেন। বিশেষত তারা যদি অফিসের চাকরীর সাথে যুক্ত থাকেন তবে তাদের অতিরিক্ত কাজের চাপ থাকে। যে চাপ শারীরিক এবং মানসিক উভয়ই হতে পারে।
নবিন: মানসিক অবসাদের সঙ্গে বয়স বেশি দেখানোর সম্পর্ক কোথায়?
প্রফেসর মবিন: দাদুভাই, সম্পর্ক হলো- মানসিক অবসাদের কারণে মানুষের দেহের কোষগুলোর বয়স বেড়ে যায়। আর লন্ডন শহরের প্রাইরির ওয়েলবেইং সেন্টারের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডঃ জুডিথ মোহরিং এর মতে, নারীরা মানসিক অবসাদের ঝুঁকিতে বেশি রয়েছে।
নবিন: আচ্ছা দাদু, কাজের চাপ ছাড়া আর কী কী কারণ মানসিক অবসাদের জন্য দায়ী?
প্রফেসর মবিন: আর হরমোনগত পার্থক্য কিংবা হরমোনের ওঠানামা মূলত হতাশার জন্য দায়ী। এছাড়া SAD তে আক্রান্তদের ক্ষেত্রে অস্থিরতা পুরুষদের চেয়ে নারীদেরকে বেশি প্রভাবিত করে।
প্রফেসর মবিন: SAD হলো Seasonal Affective Disorder Affects নামে একটা মানসিক রোগ। এতে আক্রান্ত রোগী বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় মানসিক অবসাদে ভোগে। এটা নিয়েও আরেকদিন আলোচনা করবো, মনে করিয়ে দিও।
নবিন: ঠিক আছে দাদু।
প্রফেসর মবিন: তাহলে এ থেকে কী বুঝলে?
নবিন: বুঝলাম যে, প্রতিনিয়ত মানসিক চাপ নিশ্চিতভাবে নারীদের বয়সে বেশি দেখানোর কারণ!
প্রফেসর মবিন: একদম সঠিক। এবার তাহলে দ্বিতীয় কারণে আসি। জর্জ মেসন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত একটি গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, গর্ভাবস্থায় একজন নারীকে তার প্রকৃত বয়সের চেয়ে ১১ বছর বেশি বয়সী দেখায়। অর্থাৎ, যেসব মহিলারা সন্তান প্রসব করেছেন তাদের টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য, যে নারীরা সন্তান প্রসব করে নি তাদের তুলনায় কম।
নবিন: টেলোমিয়ার কীভাবে বয়স বেশি দেখানোর সাথে যুক্ত?
প্রফেসর মবিন: তোমাকে জীববিজ্ঞান বইটি ভালো করে পড়তে হবে দাদুভাই। কারণ সেখানেই বলা আছে, টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্যকে কোষের বয়স নির্ধারণকারী চিহ্ন হিসেবে ধরা হয়। সেক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য যত কম হবে সেই ব্যক্তিকে তত বেশি বয়স্ক দেখাবে।
নবিন: ওহ, ভুলেই গিয়েছিলাম (একটু লজ্জিত হয়ে)
প্রফেসর মবিন: হুম, আবার গর্ভাবস্থাকালীন শারীরিক ও মানসিক চাপ কিন্তু অস্বাভাবিক নয়, এটিও বার্ধক্যের গতি ত্বরান্বিত করে।
নবিন: আর কী কী কারণ হতে পারে?
প্রফেসর মবিন: আরেকটা কারণ হলো- পুরুষদের ত্বক ঘন হয়। চর্ম বিশেষজ্ঞের মতে, পুরুষদের ত্বক নারীদের ত্বকের চেয়ে ২৫% পুরু হয়। হয়ত ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি এই শতাংশের কিছুটা ব্যতিক্রম থাকে, তবে গড়ে প্রায় একই থাকে। এর ফলে কী হয় বলো তো?
নবিন: কী দাদু?
প্রফেসর মবিন: ফলে নারীদের তুলনায় পুরুষদের মুখের বলিরেখার পরিমাণ কম থাকে।
নবিন: কোনো হরমোন কী দায়ী নয়?
প্রফেসর মবিন: হুম, মহিলাদের মুখের জন্য ইস্ট্রোজেন হরমোন দায়ী, অপরদিকে পুরুষদের ক্ষেত্রে দায়ী টেস্টোস্টেরন হরমোন।
নবিন: আর টেস্টোস্টেরনের উচ্চ মাত্রা বার্ধক্য কমিয়ে দিতে সাহায্য করে। তাই তো দাদু?
প্রফেসর মবিন: একদম সঠিক। যদিও ইস্ট্রোজেন অ্যান্টি-এজিং হরমোন হিসাবেও কাজ করে, কিন্তু এর উৎপাদন টেস্টোস্টেরনের চেয়ে দ্রুত হ্রাস পায়। এই কারণেই নারীদের মূলত পুরুষদের আগে মুখে বলিরেখা দেখা যায়।
নবিন: আচ্ছা বুঝতে পেরেছি।
প্রফেসর মবিন: এছাড়াও নারীদের মেনোপজের সময় বিভিন্ন হরমোনের হ্রাস হয়, যা বয়সের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। সে সময় নারীদের দেহে আগের মতো কোলাজেন উৎপন্ন হয় না। যার ফলে ত্বকের স্থিতিস্থাপকতার হ্রাস ঘটে এবং নারীদের বয়স বেশি দেখায়। আরো অনেক কারণ আছে, আশা করি এতেই তোমার এসাইনমেন্ট হয়ে যাবে।
নবিন: জ্বী দাদু, হয়ে যাবে।
প্রফেসর মবিন: তবে দাদুভাই, ভুলেও তোমার দাদীর সাথে এসব বলো না। চরম খেপে যাবে।
নবিন কারণ বুঝতে পারলো এবং হো হো করে হাসতে লাগলো। ঠিক তখনই, প্রফেসর মবিন এর স্ত্রী মিসেস লিসা চা হাতে নিয়ে হাজির। বললো-
:: কী নিয়ে এত হাসাহাসি হচ্ছে?
প্রফেসর মবিন: না, কিছু না, কই চা এনেছো? দাও।
মিসেস লিসা: কী লুকোচ্ছো, বলোতো?
আরও পড়ুনঃ বয়সের তুলনায় কিছু মানুষকে অল্পবয়স্ক দেখায়, কিন্তু কেন!
প্রফেসর মবিন চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললো-
:: না তেমন কিছু না, দাদুভাইয়ের স্কুলের একটা এসাইনমেন্টে সাহায্য করছিলাম। আচ্ছা শুনো দাদুভাই, পরে কোনো একদিন তোমাকে “বুড়ো হলে মানুষ ভুলোমন কেন হয়ে যায়?” এই নিয়ে বলবো। মনে করিয়ে দিও। কারণ আজকাল দেখছি, তোমার দাদী আমার চায়ে চিনি দিতেও ভুলে যাচ্ছে।
আবার নবিন হো হো করে হাসতে লাগলো…