মানুষের দেহে সর্বদা রক্ত সঞ্চালিত হচ্ছে। সবার দেহে এর বর্ণ লাল হয়ে থাকলেও এগুলো কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। আজকাল ‘এ’ নেগেটিভ, ‘বি’ নেগেটিভ, ‘ও’ নেগেটিভ এবং ‘এবি’ নেগেটিভ রক্ত দিতেই মানুষ হিমশিম খেয়ে যায়।
আর এমন যদি হয় যে একধরনের ব্লাড টাইপ যা পৃথিবীতে মাত্র ৪৩ জন মানুষের মধ্যে বিদ্যমান তাহলে ব্যাপারটি কেমন দাড়ায়? খুবই অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়ই!! এই বিরল রক্তই ‘গোল্ডেন ব্লাড’ নামে সুপরিচিত।
আপনি কি জানেন গোল্ডেন ব্লাড (Golden Blood) বা সোনালী রক্ত কি? হয়তো নাম শুনে থাকবেন; আর যদি নাও শুনে থাকেন তবে আপনি ভাবছেন এটি আবার কেমন রক্ত! তাই না?
গোল্ডেন ব্লাড (Golden Blood) – এটি পৃথিবীতে সবচেয়ে বিরল রক্ত যা বিগত ৫৬ বছর ধরে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৪৩ জন মানুষের মধ্যে পাওয়া গিয়েছে। এই রক্ত যেমন বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও ব্লাড ট্রান্সফিউশন (রক্ত সঞ্চালনের প্রক্রিয়া) এর জন্য উপকারী তেমনি এই বিরল রক্ত নিয়ে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে চলাফেরা করা বেশ বিপজ্জনকও বটে।
প্রথমত গোল্ডেন ব্লাড সম্পর্কে বুঝতে হলে আপনাকে এর টাইপগুলো সম্পর্কে অবগত হতে হবে। আগেই বলেছি রক্তের বর্ণ দেখতে একইরকম হলেও এগুলো ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির হয়ে থাকে। মানব রক্তকণিকা পৃষ্ঠতলে ৩৪৬ ধরনের অ্যান্টিজেন থাকে। অ্যান্টিজেনগুলো মূলত এক ধরনের অণু যা অ্যান্টিবডি উৎপাদনে সহায়তা করে এবং এই ধরনের অ্যান্টিজেনের ঘাটতির কারনে একেকজনের রক্তের গ্রুপ একেক রকম হয়ে থাকে।
তন্মধ্যে ১৬০ টি অ্যান্টিজেন প্রায় সবার মধ্যেই বিদ্যমান, তাই এগুলোকে সাধারন (Common) হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু কোনো ব্যক্তির মধ্যে যদি এমন কোনো অ্যান্টিজেন থাকে যা ৯৯ শতাংশ মানুষের মধ্যে বিদ্যমান নয় তবে সেই ব্যক্তির রক্তকে বিরল হিসেবে গণ্য করা হয়।
আবার এমনও যদি হয় যে কোনো একটি অ্যান্টিজেন ৯৯.৯৯ শতাংশ মানুষের মধ্যে বিদ্যমান কিন্তু ঐ ব্যক্তির মধ্যে নেই তবে সেই ব্লাড টাইপ আরও বিরল বলা হয়ে থাকে।
এখন অবধি ৩৬ টি ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম রয়েছে এবং ৩৪৬ টি অ্যান্টিজেন এই ৩৬ টি সিস্টেমের অন্তর্গত। তন্মধ্যে ‘আরএইচ বা রেসাস’ (Rh/Rhesus) সিস্টেম হলো দ্বিতীয় বৃহত্তর ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম এবং প্রায় ৪৯ টি অ্যান্টিজেন এই সিস্টেমের অন্তর্ভুক্ত। মানুষের মধ্যে এই অ্যান্টিজেনগুলোর একটি অনুপস্থিতি অস্বাভাবিক কিছু নয়।
উদাহরণস্বরূপ, প্রায় ১৫ শতাংশ ককেশিয়ানদের মধ্যে ‘ডি অ্যান্টিজেন’ অনুপস্থিত (আরএইচ সিস্টেমের মধ্যে অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি অ্যান্টিজেন হলো ‘D’)। অপরদিকে, এশিয়দের মধ্যে ‘আরএইচ নেগেটিভ’ (Rh-) খুব কমই দেখা যায়। কিন্তু এমন যদি হয় যে কোনো মানুষের মধ্যে এই ৪৯ টি অ্যান্টিজেন অনুপস্থিত? – এই রক্তকেই ‘আরএইচ নাল’ (Rh-null) বা গোল্ডেন ব্লাড বলা হয়।
৫৬ বছর আগ পর্যন্ত ডাক্তাররা এটিই বিশ্বাস করতেন যে কোনো ভ্রূণের পক্ষে এই ৪৯ টি অ্যান্টিজেন ছাড়া জরায়ুতে বেঁচে থাকা অসম্ভব ; ঠিকমতো বেড়ে উঠা তো আরও দূরের কথা।
পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে একজন অস্ট্রেলিয়ান মহিলার মধ্যে ‘আরএইচ নাল’ পাওয়া যায় অর্থাৎ আরএইচ ব্লাড সিস্টেমের সকল অ্যান্টিজেন তার মধ্যে অনুপস্থিত। আবার ১৯৭৪ সালে ১০ বছর বয়সী একজন শিশু টমাস একধরনের ইনফেকশনের জন্য ‘ ইউনিভার্সিটি হসপিটাল অব জেনেভা’ তে রক্ত পরীক্ষার জন্য যায়। রক্ত পরীক্ষার পর দেখা যায় তার রক্ত সেই ৩৬ টি গ্রুপের কোনটির সাথেই মিল নেই।
অর্থাৎ পজিটিভ বা নেগেটিভ তো দূরে থাক; ছেলেটির মধ্যে কোনো আরএইচ সিস্টেমের নমুনা ছিল না। ডাক্তাররা খুবই অবাক হয়েছিলেন কারন ছেলেটির জীবিত থাকার কথা না এবং পুনরায় তার রক্ত পরীক্ষার জন্য তাকে প্যারিস ও আমস্টারডামে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে জানা যায়, টমাসের রক্ত আরএইচ-নাল ছিল।
তবে ‘আরএইচ-নাল’ (Rh-null) কে ‘গোল্ডেন ব্লাড’ বলার দুটি কারন রয়েছে। প্রধান কারন হলো আরএইচ সিস্টেমের অন্তর্গত বিরল রক্ত বহনকারী যেকোনো ব্যক্তি এই গোল্ডেন ব্লাড গ্রহন করতে পারে। এই জীবন রক্ষাকারী রক্ত এতোটাই কার্যকারী যে ব্লাড ব্যাংক গোল্ডেন ব্লাড বহনকারী দাতার পরিচয় গোপন রাখে কারন বিজ্ঞানীরা প্রায়শই আরএইচ-নাল রক্তদাতাকে রক্ত অনুদানের জন্য অনুরোধ করেন এবং সবসময়ই তাদের সন্ধানে থাকেন। তবে এই রক্ত বিরল হওয়ার কারনে শুধুমাত্র গুরুতর ক্ষেত্রে ও ধৈর্য ধরে রক্ত প্রতিস্থাপন করা হয়।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !! চকোলেট তৈরীতে তেলাপোকাঃ পুরোটাই সত্য নাকি কেবলই ধোকা? |
দ্বিতীয়ত গোল্ডেন ব্লাডের বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে অনেক আবশ্যিকতা রয়েছে। কারন গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এর পিছনে অনেক রহস্যের সন্ধান পেতে পারে।
এছাড়া আরএইচ নেগেটিভ রক্ত বহনকারী যেকোনো ব্যক্তি এই আরএইচ-নাল গ্রহন করতে পারবে। কিন্তু এই রক্ত বহনকারী ব্যক্তির যদি কখনও ব্লাড ট্রান্সফিউশনের প্রয়োজন হয় তখন পরিস্থিতি খুবই ভয়ংকর হতে পারে। এমনকি তারা যদি পজিটিভ গ্রুপের কোনো ব্যক্তির রক্ত গ্রহন করে তখন তাদের অ্যান্টিবডিগুলো সেই দাতার রক্তের সাথে মিশে অসামঞ্জস্য বিক্রিয়া (Incompatibility Reaction) করতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে এই রক্ত এতোটাই বিরল হওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা এই রক্তকে স্বর্ণের সমতুল্য মনে করেন যার ফলে এই রক্তের নামকরণ ‘ গোল্ডেন ব্লাড ‘ করা হয়েছে। অবশ্য এই ব্যক্তি বিজ্ঞানীদের চোখে প্রাধান্য পেয়ে থাকলেও জীবনে চলার পথে অনেক ঝুঁকি থেকেই যায়।
তাই ‘ গোল্ডেন ব্লাড ‘ যেমন আশীর্বাদস্বরূপ তেমনি অভিশাপও বটে। একদিকে যেমন এই রক্তধারী ব্যক্তি অগণিত জীবন বাঁচাতে পারবে তেমনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তার ভয়াবহ চিন্তার সহিত বেঁচে থাকতে হবে।