কয়েক সপ্তাহ আগে নানু বাসায় বেড়াতে গিয়েছি। পৌঁছেই খেয়াল করলাম ভুলে ফোন টা ফেলে চলে এসেছি। মহামারীর এই সময়টা ফোন ছাড়া কিভাবে থাকবো! এর মধ্যে অনলাইনে ক্লাসও চলছে। যেহেতু বাসার দূরত্ব বেশি নয় তাই দেরী না করে ফোন নেওয়ার জন্য বাসায় দিকে রওনা দিচ্ছিলাম। এত ব্যস্ততার মধ্যেও, ঐ সময় টাতে নানু বলে উঠলেন কোথাও যাওয়া যাবে না, নানুর নাকি চোখের পাতা লাফাচ্ছে আর এটা নাকি অশুভ লক্ষণ। আমি অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়ে কোনোমতে বাসায় এসে তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিলাম আমি নিরাপদেই পৌঁছেছি। তখন থেকেই আমার ইচ্ছা এই ব্যাপারটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার।
আমাদের সমাজে চোখের পাতা লাফানো নিয়ে আছে নানা কুসংস্কার। এসব কুসংস্কার শুনতে শুনতে আমরা মানসিকভাবে মিথ্যাটা কেই সত্য হিসেবে মানতে বাধ্য হই। কারো চোখের পাতা লাফালে সে থাকে সর্বদা আতঙ্কগ্রস্ত। তার অবচেতন মন জানান দেয়, এই বুঝি কোনো খারাপ খবর এলো। কিন্তু এ ব্যাপারে আছে চিকিৎসা শাস্ত্রের কিছু ব্যাখ্যা। আজ সে সম্পর্কেই আপনাদের জানাবো।
চোখের পাতা লাফানো আসলে একটি শারীরিক ত্রুটি। চিকিৎসাশাস্ত্রে একে বলা হয় Myokymia (মায়োকিমিয়া)। চোখের নিচের অংশ আক্রান্ত হলে উপরের অংশে লাফানো শুরু হয়। চোখের মাংসপেশির সংকোচন হলে চোখ এরকম আচমকা লাফাতে থাকে এবং এটি খুব দ্রুত সংগঠিত হয় যার ফলে বাইরের কেউ দেখে বুঝতে পারেনা। সাধারণত চোখের পাতা লাফানো বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, তবে মাত্রাতিরিক্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
যেসব কারনে চোখের পাতা লাফাতে পারে :
১. অতিরিক্ত ক্যাফেইন এবং অ্যালকোহল এর সেবন।
২.প্রচণ্ড রকম ক্লান্তি, মানসিক চাপ এবং শারীরিক দুর্বলতার জন্য।
৩. চোখের এলার্জি বা অন্য কোন কারণে চোখ অতিরিক্ত শুষ্ক হলে। সাধারণত চোখে এলার্জি থাকলে হাত দিয়ে চুলকানোর ফলে চোখ থেকে পানির সাথে হিস্টামিন নামক পদার্থ নির্গত হয় যেটা চোখ লাফানোর জন্য অনেকাংশে দায়ী।
৪. চোখে ম্যাগনেসিয়াম এর মাত্রা কমতে শুরু করলে।
৫.কম্পিউটার, মোবাইল, টিভি এসবের স্ক্রিনে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখ শুষ্ক হয়ে যেতে পারে যা চোখ লাফানোর একটি কারণ।
৬. ঘুম কম হলে, হঠাৎ করে পরিশ্রম এর মাত্রা বেড়ে গেলে চোখ লাফানোর উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
কিছুক্ষণের জন্য চোখ লাফানো তেমন দুশ্চিন্তার কিছু নয়। সাময়িকভাবে মুক্তি পেতে চোখের পাতায় ধীরে ধীরে ম্যাসাজ করা যেতে পারে। তবে যাদের দিনে কয়েকবার এ সমস্যাটি হয় এবং সেটি সপ্তাহ বা মাসখানেক স্থায়ী থাকে তাদের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দেখা দিতে পারে। মাঝে মাঝে চোখের পাতা লাফানো স্ট্রোকের লক্ষণ হিসেবেও প্রকাশ পায়।
বিভিন্ন স্নায়বিক রোগ যেমন-Facial (nerve) Palsy, Parkinson’s Disease, Multiple Sclerosis ইত্যাদি দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা থেকে চোখের ভয়াবহ ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া যদি চোখ থেকে পানি বের হয়, চোখ লাল হয়ে ফুলে যায় এবং এরকম বারবার চোখ লাফাতে থাকলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !! ইনসাইড দ্য অ্যাপ্লিকেশন: কোরা এর আদ্যপান্ত |
সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায়:
১.চোখ যেহেতু সংবেদনশীল অঙ্গ তাই নিয়মিত এর যত্ন নেওয়া উচিত। এছাড়া ধুলাবালি থেকে রক্ষা পেতে চশমা ব্যবহার করা যেতে পারে।
২.টিভি কম্পিউটার মোবাইলের স্ক্রিনে বেশিক্ষন তাকিয়ে থাকা যাবে না। চোখকে বিশ্রাম দিতে হবে।
৩.নিয়মিত পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে এবং শরীরের সাথে অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে হবে।
৪.অ্যালকোহল সেবন এবং ধূমপান করা থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫.চা, কফি, ক্যাফেইন সোডা এসব খাওয়ার মাত্রা কমাতে হবে।
পরিশেষে বলব দুর্ঘটনার ওপর আমাদের নিজস্ব কোনো হাত নেই। মাঝে মাঝে দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা ভেবে নেই চোখ লাফানোর জন্যই বোধহয় হয়েছে। এটা ঘটলেই মন বিষণ্ণ করে ভাবতে থাকি এই বুঝি কোনো বিপদ ধেয়ে আসছে। এই অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপের ফলে হতে পারে আরো ভয়ানক ব্যাধি।
তাই খুব বেশি চোখের পাতা লাফালে দুশ্চিন্তা না করে যেকোনো পরিস্থিতি ঠান্ডা মাথায় সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করে সুস্থতা নিশ্চিত করতে হবে কারণ শরীরের সুস্থতা অনেকাংশে মনের সুস্থতাও নিশ্চিত করে। আর মন হাস্যজ্জ্বল থাকলে পুরো পৃথিবীকেই হাস্যজ্জ্বল মনে হবে।