“কী খবর আকিল? মন খারাপ নাকি?” আকিলকে মনমরা দেখে জিজ্ঞেস করলেন মবিন ভাই। আকিল বললো, “আসলে ভাইয়া, সাইন্স বী এর ওয়েবসাইটে সেদিন একটা ব্লগ পড়েছিলাম ডিপ্রেশন নিয়ে। সেখান থেকে ডিপ্রেশনের কারণ এবং লক্ষণগুলো জানার পর থেকে কেমন একটা অস্বস্তি কাজ করছে।”
“যেমন?” “না মানে, ভাইয়া! ভেবে দেখলাম এ সব লক্ষণই তো আমার আছে। তাই নিজেকে এখন মানসিক রোগী মনে হচ্ছে।” মবিন ভাই হাসলেন। তারপর বললেন, “ও আচ্ছা! এই ব্যাপার। কিন্তু তুই কী এটা জানিস যে ডিপ্রেশন চিকিৎসাযোগ্য এবং এ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব?” “না তো ভাইয়া। কিন্তু এতো জটিল রোগ থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব?”
“আচ্ছা শোন! আমার এক বন্ধু ডাক্তার। এই পাশেই চেম্বার। আজ বিকেলে চল আমার সাথে। ও বুঝিয়ে বললে বরং সেটা ভালো হবে।”
বিকাল চারটা। ডাক্তার কিবরিয়া উনার চেম্বারে বসে আছেন। রোগীদের ভিড় লেগেই আছে। একসময় মবিন ভাইদের ডাক এলো। আকিল আর মবিন ভাই ঢুকলেন চেম্বারে। কুশলাদি বিনিময়ের পর মবিন ভাই সবকিছু খুলে বললেন। ডাক্তার কিবরিয়া আকিলকে বললেন, “তুমি শুধু শুধু চিন্তা করো না তো। সব ধরণের হতাশাকেই রোগ হিসেবে নিতে হবে এমনটা না কিন্তু।”
ডাক্তার কিবরিয়া বলতে লাগলেন, “ডিপ্রেশন মানে হচ্ছে হতাশা। ঠিক আছে?” আকিল উপর-নিচ মাথা নাড়লো। ডাক্তার সাহেব উনার কথা চালিয়ে গেলেন,
“মানসিক ব্যাধিগুলির মধ্যে চিকিৎসার দিক দিয়ে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার মধ্যে রয়েছে ডিপ্রেশনের চিকিৎসা। ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ অবসন্নতা কিংবা হতাশায় আক্রান্ত রোগী চিকিৎসায় ভাল সাড়া দেন। প্রায় সমস্ত রোগী তাদের লক্ষণগুলি থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি পান।
তবে হ্যাঁ! শোনো আকিল, রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসার আগে, একজন পেশাদার চিকিৎসক কিংবা কাউন্সেলরের শরণাপন্ন হয়ে একটি সাক্ষাৎকার এবং একটি শারীরিক পরীক্ষা সহ সম্পূর্ণ ডায়াগনস্টিক মূল্যায়ন করা উচিত। কিছু ক্ষেত্রে, থাইরয়েড সমস্যার মতো পরিস্থিতির কারণে যে ডিপ্রেশন হয়নি, তা নিশ্চিত করার জন্য রক্ত পরীক্ষা করা যেতে পারে। মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট লক্ষণগুলি, চিকিৎসা এবং পারিবারিক ইতিহাস, সাংস্কৃতিক কারণ এবং পরিবেশগত কারণগুলি সনাক্তকরণ এবং কর্মক্রমের কোর্সটি পরিকল্পনা করা,এই বিষয়গুলির দিকে মনোযোগ দিতে হবে।”
আকিল মাথা নাড়লো উপর-নিচ। মানে, সে বুঝতে পেরেছে।
ডাক্তার সাহেব বললেন, “আসলে সব লক্ষণই যে ডিপ্রেশন বুঝায় তা কিন্তু না। তোমার অন্য রোগও থাকতে পারে। তাই আমি পরামর্শ দিবো, তুমি একজন ভালো মানসিক রোগের চিকিৎসকের কাছে যাও। আর আমি একটা লিফলেট দিচ্ছি। ওখানে মানসিক রোগের চিকিৎসার বিষয়ে বিস্তারিত পাবে। আর সবসময় মনকে প্রফুল্ল রাখবে। বুঝলে আকিল, এই বয়সে উচিৎ প্রতিদিন কিছুটা সময় হলেও প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকা। এতে করে মন প্রফুল্ল থাকবে। বন্ধুবান্ধবের সাথে আড্ডায় যোগ দিবে। ধর্মগ্রন্থ পাঠ করবে। নিয়মিত প্রার্থনা করবে। দেখবে অনেক ভালো বোধ করছো।”
লিফলেটটা নিয়ে আকিল আর মবিন ভাই ডাক্তার কিবরিয়া সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে বেরিয়ে এলেন। আকিল বাসায় গিয়ে লিফলেটটা পড়লো। তো চলুন পাঠক, দেখি আমরাও লিফলেটে কী লেখা ছিলো!
ডিপ্রেশন বা হতাশার নিরাময় হিসেবে সেই লিফলেটে যা ছিলো, তা হলো-
ঔষধ: মস্তিষ্কের রাসায়নিক পরিবর্তন কোনও ব্যক্তির ডিপ্রেশন ঘটানোর কারণ হতে পারে।এই কারণে, “এন্টিডিপ্রেসেন্টস” কোনও ব্যক্তির মস্তিষ্কের রাসায়নিক পদার্থের অসামঞ্জস্যতা সংশোধন করতে সহায়তা করার জন্য প্রেস্ক্রাইভড হতে পারে। এই ওষুধগুলি সহনশীল মাত্রা নিশ্চিত করে এবং তা ট্র্যাঙ্কুলাইজার নয়। কিন্তু তারপরেও এই ওষুধগুলো অভ্যাসে পরিণত করা যাবে না। সাধারণত ডিপ্রেশনের জন্য ওষুধ গ্রহণ করেন না, এমন লোকেদের প্রতিষেধক ওষুধগুলির মাধ্যমে সৃষ্ট কোনও উত্তেজক প্রভাব থাকে না।
প্রতিষেধক ব্যবহারের মাধ্যমে প্রথম এক সপ্তাহের মধ্যে কিছু উন্নতি ঘটতে পারে।
পুরোপুরি নিরাময় দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে ঘটে না। বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে যদি কোনও রোগী সামান্য কোনও উন্নতি অনুভব করেন, তবে তার মানসিক চিকিৎসার ঔষধের ডোজটি চিকিৎসক পরিবর্তন করতে পারেন বা অন্য কোনও এন্টিডিপ্রেসেন্টকে যুক্ত বা বিকল্প কোনো প্রতিষেধক ব্যবহার করতে পারেন। কিছু পরিস্থিতিতে অন্যান্য সাইকোট্রপিক ওষুধ সহায়ক হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। যদি কোনও ওষুধ কাজ না করে বা রোগী যদি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া অনুভব করেন তবে তা ডাক্তারকে অবহিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
সাইকিয়াট্রিস্টরা সাধারণত পরামর্শ দেন যে, রোগীদের লক্ষণগুলির উন্নতি হওয়ার পরেও ছয় মাস কিংবা আরও দীর্ঘসময় ধরে ওষুধ খাওয়া চালিয়ে যাওয়া উচিত। দীর্ঘমেয়াদী রক্ষণাবেক্ষণের চিকিৎসায় উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা রোগীর ভবিষ্যতের কোনো মারাত্মক ঝুঁকি হ্রাস করার পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে।
সাইকোথেরাপি: সাইকোথেরাপি বা “টক (Talk) থেরাপি” কখনও কখনও হালকা হতাশার চিকিৎসার জন্য প্রতিষেধক ছাড়াই ব্যবহৃত হয়; মাঝারি থেকে মারাত্মক হতাশার জন্য, মনো-চিকিত্সা প্রায়শই প্রতিষেধক ওষুধের পাশাপাশি ব্যবহৃত হয়। জ্ঞানীয় আচরণগত থেরাপি (সিবিটি) হতাশা নিরাময়ে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। সিবিটি হলো থেরাপির একটি মাধ্যম, যা বর্তমান এবং সমস্যা সমাধানের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। সিবিটি কোনও ব্যক্তির বিকৃত চিন্তাধারা সনাক্ত করতে এবং তারপরে আচরণ ও চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করতে সহায়তা করে।
সাইকোথেরাপিতে কেবলমাত্র ব্যক্তি জড়িত থাকতে পারে তবে এটিতে অন্যকে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পরিবার বা দম্পতির মধ্যকার থেরাপি,এই থেরাপি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যে সমস্যার সমাধান করতে সহায়তা করতে পারে। গ্রুপ থেরাপিতে সাধারণত একই ধরনের অসুস্থ ব্যক্তিরা জড়িত থাকেন।
হতাশার তীব্রতার উপর নির্ভর করে চিকিৎসা কয়েক সপ্তাহ বা আরও বেশি সময় নিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে, ১০ থেকে ১৫ সেশনে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটতে পারে।
ইলেক্ট্রোকনভুলসিভ থেরাপি (ইসিটি) একটি চিকিৎসা,যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গুরুতর বড় ডিপ্রেশন বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারযুক্ত রোগীদের জন্য ব্যবহার করা হয়, যারা হতাশার অন্যান্য চিকিৎসায় নিরাময় পাননি। এতে মস্তিষ্কের সংক্ষিপ্ত বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা জড়িত থাকে যখন রোগী অ্যানেসথেশিয়াতে থাকে।
একজন রোগী সাধারণত ছয় থেকে বারোটি চিকিত্সার জন্য সপ্তাহে দুই থেকে তিনবার ইসিটি পান। ইসিটি ১৯৪০-এর দশক থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, এবং বহু বছরের গবেষণায় বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে। এটি সাধারণত মনোচিকিৎসক, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট এবং একজন নার্স বা চিকিত্সক সহকারী সহ প্রশিক্ষিত মেডিকেল পেশাদারদের একটি দল দ্বারা পরিচালিত হয়।
স্ব-সহায়তা এবং মোকাবেলা:
একজন ব্যক্তি নিজেই হতাশার লক্ষণগুলি হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারেন এমন অনেকগুলি জিনিস রয়েছে। অনেক লোকের জন্য, নিয়মিত কোনো একটি ভালো কাজের অনুশীলন ইতিবাচক অনুভূতি তৈরি করতে এবং মেজাজ উন্নত করতে সহায়তা করে। নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো, স্বাস্থ্যকর ডায়েট এবং অ্যালকোহল বা মাদকদ্রব্য এড়ানোও হতাশার লক্ষণগুলি হ্রাস করতে সহায়তা করে।
হতাশা আসলেই একটি অসুখ এবং অবশ্যই এটি নিরাময়যোগ্য । যথাযথ নির্ণয় এবং নিরাময় পাওয়া যায় যথাযথ চিকিৎসা দ্বারা । হতাশায় আক্রান্ত বিশাল সংখ্যক লোক সুস্থতা লাভ করবে, যদি কেউ একজন হতাশার লক্ষণগুলি অনুভব করে থাকেন তবে প্রথমেই তার উচিৎ হবে পরিবার, চিকিৎসক বা মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে আলোচনা করা। একজন হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তির উচিৎ তার উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা সম্পর্কে কথা বলা।
এগুলো পড়তে ভুলবেন না !!! Transfusion associated graft-versus-host disease : কি এবং কেন |
অন্যদের উচিৎ হবে সেই ব্যক্তিকে পূর্ণ সহায়তা দেয়া। একজন হতাশায় আক্রান্ত ব্যক্তি বিশ্বস্ত সঙ্গী খুঁজেন, যার কাছে তিনি তার সকল কষ্টের কথা খুলে বলতে পারবেন। তাই মোটেও এটি অবজ্ঞা করা উচিৎ নয়। কারন, ডিপ্রেশন কিংবা হতাশা একজন মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়।
পরদিন মবিন ভাইয়ের সাথে আকিলের দেখা। মবিন ভাই জিজ্ঞেস করলেন, “কী অবস্থা আকিল?” “আসলে মবিন ভাই, সবার আগে দরকার একটা প্রফুল্ল মন। আর সবসময় নিজের যা আছে তা নিয়ে তুষ্ট থাকা। সেইসাথে জীবনে ঘটে যাওয়া খারাপ কিছু উচিৎ অন্য কারো সাথে শেয়ার করা। এতে করে ওষুধ ছাড়াই ডিপ্রেশন মুক্ত থাকা সম্ভব। আর তা না হলে তো চিকিৎসা আচজেই!”
মবিন ভাই আকিলের পিঠ চাপড়ে বললেন, “বেশ ভালো বলেছিস। আয়, আজ তোকে বার্গার খাওয়াবো।”